<p style="text-align:justify"><span style="color:#c0392b">ম্যাচবক্স সাকিল হকের কাছে শুধু আগুনের বাক্স নয়। এটি একটি গ্রন্থ। বইয়ে যেমন প্রচ্ছদ থাকে, পুট থাকে, বইয়ের অভ্যন্তরে পাঠের জন্য অক্ষরমণ্ডিত পৃষ্ঠা থাকে, ম্যাচবাক্সও তাঁর কাছে তাই। ডিজাইন করতে জানলে ম্যাচবাক্স সত্যিই একটি বই</span></p> <p style="text-align:justify">শূন্য আকাশে ঝিলিক কেটে পাহাড়ের কোলে কিংবা বৃক্ষের শরীরে বজ্রপাত হলে দূর থেকে সে দৃশ্য দেখে বিস্মিত হয়েছিল আদিম মানুষ। একইভাবে পাহাড়ের ওপর থেকে পাথর গড়িয়ে নিচে অন্য পাথরের গায়ে ছিটকে পড়লে যে আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠেছিল, তা দেখেও বিস্ময়ের অন্ত ছিল না। এই আগুন কিভাবে জ্বালানো যায়, কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কালের বিবর্তনে তা শিখে নিতে আদিম মানুষের কেটে যায় হাজার বছর।</p> <p style="text-align:justify">অবশ্য শেষ পর্যন্ত মানুষ আগুন জ্বালানো এবং নিয়ন্ত্রণের সব কলাকৌশলই শিখে নেয়। লাখ লাখ বছর আগে জীবজন্তু ও আদিম মানুষের মধ্যে মোটাদাগে কোনো ফারাক ছিল না। আদিম মানুষ যেভাবে বন-জঙ্গলের জীবজন্তু শিকার করে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত, জীবজন্তুরাও মানুষ শিকার করে ক্ষুধা নিবারণ করত। তবে মানুষ যখন আগুনের ব্যবহার শিখে যায় তখন থেকে জীবজন্তু ও মানুষের মধ্যে আমূল পার্থক্য রচিত হয়। আগুনে পুড়িয়ে জীবজন্তুর মাংস যেমন উপাদেয় খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা শুরু করে মানুষ, একইভাবে আগুনের ব্যবহারে জীবজন্তুর আক্রমণ থেকেও নিজেদের রক্ষা করতে শিখে নেয়।</p> <p style="text-align:justify"><img alt=" বাক্সবন্দি আগুন" height="515" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/12 December/18-12-2024/88888.jpg" style="float:left" width="325" />ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মানবসভ্যতার বিবর্তনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে আগুন ও চাকা আবিষ্কার। আবিষ্কারের পর আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে না শিখলে আজকের এই পর্যায়ে কখনো পৌঁছতে পারত  না মানুষ। শুরুতে আগুন জ্বালাতে শিখলেও নিয়ন্ত্রণ জানা ছিল না। ফলে জ্বালানো আগুন যাতে নিভে না যায় সে জন্য গোত্রের লোকেরা পালা করে রাত-দিন পাহারা দিয়ে জ্বালিয়ে রাখত আগুন।</p> <p style="text-align:justify">আধুনিক কালের প্রত্ন গবেষণায় প্রাচীন পর্বতের গুহায় আদিম মানুষের যেসব ব্যবহৃত সামগ্রী পাওয়া গেছে, তার মধ্যে কাঠ-কয়লা এবং পশুর আধপোড়া হাড়ের সন্ধান মিলেছে। কোনো কোনো গুহায় পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোর চিহ্নও পাওয়া গেছে।</p> <p style="text-align:justify">এ তো গেল আবিষ্কারের শুরুর পর্যায়ে আগুন জ্বালানো ও নিয়ন্ত্রণের কথা। আধুনিক সভ্যতার আগুনের গল্পগাথা ভিন্ন। সেই গল্পগাথায় রয়েছে আগুনকে দিয়াশলাইয়ে রূপ দিয়ে কিভাবে নিরাপদ বাক্সবন্দি করা হলো তার ইতিবৃত্ত। সেটি বেশিদিন আগের কথা না। ১৮২৬ সালে ইংল্যান্ডের কেমিস্ট জন ওয়াকার দুর্ঘটনাবশত আবিষ্কার করেন দিয়াশলাই। সেখানকার হাই স্ট্রিট স্টকটনে তাঁর ছিল একটি কেমিস্ট ও ড্রাগিস্টের দোকান। সেটির পেছনে ছিল তাঁর গবেষণাগার। জন ওয়াকার একদিন তাঁর গবেষণাগারে কাজ করছিলেন। অ্যান্টিমনি সালফাইড, পটাসিয়াম ক্লোরেট, আঠা ও মাড়ের মিশ্রণে তাঁর তৈরি করা কিছুটা রাসায়নিক প্রলেপ টেবিলের ওপর থাকা কাঠির গায়ে লেগে যায়। পরে কাঠিটি অন্য বস্তুর সঙ্গে লেগে জ্বলে ওঠে। এভাবেই জন আবিষ্কার করেন ঘর্ষণপদ্ধতির পৃথিবীর প্রথম দিয়াশলাই। তবে জনের দিয়াশলাই ছিল টিনবন্দি। আর পেটেন্ট রাইট না করায় জনের পদ্ধতি হুবহু অবলম্বন করে লন্ডনের সেমুয়াল জোনস নিজের নামে পেটেন্ট রাইট করিয়ে ‘লুসিফার’ নামে প্রথম ম্যাচবক্স তৈরি করে বাণিজ্যিকভাবে বাজারে ছেড়ে দেন ১৮২৯ সালে।</p> <p style="text-align:justify">সেই থেকে ধীরে ধীরে ইউরোপসহ বিশ্বের দেশে দেশে গড়ে উঠতে শুরু করে বাণিজ্যিক ম্যাচবক্সের কারখানা। আগুনকে বাক্সবন্দি করে নিরাপদে ঘরে রাখা কিংবা নিশ্চিতে পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মাধ্যমে মানুষের হাতের মুঠোয় চলে আসে আগুনের নিয়ন্ত্রণ। সেই থেকে বিচিত্র ও বর্ণিল আকার-প্রকারের ম্যাচবক্স সংগ্রহ বিশ্বজুড়ে সংগ্রাহকদের কাছে বিশেষ কদর পেতে শুরু করে।</p> <p style="text-align:justify">মানুষের সংগ্রহের যেমন শেষ নেই, সংগৃহীত বস্তুরও সীমা নেই। বাংলাদেশে বাক্সবন্দি আগুনের দিয়াশলাই বক্সের অনন্য এক সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন সংগ্রাহক সাকিল হক। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে তাঁর সংগ্রহশালায় না গেলে বোঝা কষ্টকর—ম্যাচবাক্স কত প্রকারের, কত ধরনের হতে পারে। একই সঙ্গে সংগৃহীত ম্যাচবাক্সগুলো কিভাবে শৈল্পিক মর্যাদায় রাখা যায়, তারও উদাহরণ তৈরি করেছেন সাকিল হক।</p> <p style="text-align:justify">কথায় কথায় জানা গেল, সাকিল হক একজন গ্রাফিক ডিজাইনার। শুধু শখের বশে নয়, মূলত সংগ্রহের প্রবল নেশায় তিনি গড়ে তুলেছেন ম্যাচবাক্সের এই অনন্য সংগ্রহশালা। এরই মধ্যে তাঁর সংগ্রহশালায় ঠাঁই করে নিয়েছে ১৩৫ দেশের প্রায় ২৪ হাজার দিয়াশলাইয়ের বাক্স। সঙ্গে রয়েছে টিনের বাক্সে সংরক্ষিত প্রাচীন দিয়াশলাইও। একইভাবে ম্যাচবাক্সের আদলে বিশ্বের বহু দেশে যেসব ‘টয়’ তৈরি হয়েছে কিংবা হচ্ছে, তারও সংগ্রহ রয়েছে তাঁর সংগ্রহশালায়। গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ ম্যাচবক্স কালেক্টর্স ক্লাব। রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের ২৬ নম্বর গ্যালারিতে সাকিল হকের দিয়াশলাই সংগ্রহের একটি কর্নার রয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">দিয়াশলাইয়ের বাক্স সাকিল হকের কাছে শুধু আগুনের বাক্স নয়, বরং এটি একটি শিল্পকর্মও; যে কারণে তিনি ম্যাচবাক্সের ডিজাইনও করেন। শিল্পের নেশায় দেশে-বিদেশে পাঁচ শতাধিক বিচিত্র বর্ণিল রঙের ম্যাচবাক্সের ডিজাইন করেছেন তিনি। সাকিল হকের সংগ্রহের বেশির ভাগ ম্যাচবাক্স এরই মধ্যে অ্যান্টিকের মর্যাদা পেয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">প্রযুক্তির প্রাগ্রসরতায় ম্যাচবক্সের ব্যবহার ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছে। সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একে একে দিয়াশলাইয়ের কারখানা। কথা প্রসঙ্গে সাকিল হক জানালেন, ম্যাচবাক্স শুধু তাঁর কাছে আগুনের বাক্স নয়। এটি একটি গ্রন্থ। বইয়ে যেমন প্রচ্ছদ থাকে, ফুট থাকে, বইয়ের অভ্যন্তরে পাঠের জন্য অক্ষরমণ্ডিত পৃষ্ঠা থাকে, ম্যাচ বাক্সও তাঁর কাছে তাই। ডিজাইন করতে জানলে ম্যাচ বাক্স সত্যিই একটি বই। যেমন—ম্যাচবাক্সের কভারের বিষয় হতে পারে বিখ্যাত কোনো ব্যক্তি বা দর্শনীয় স্থান। উল্টো পাশে থাকতে পারে সেসবের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। শাকিল হক এ ধরনের বেশ কিছু ম্যাচবাক্সের ডিজাইন করেছেন, সংগ্রাহকদের কাছে যা বেশ সমাদৃত হয়েছে।</p>