<p style="text-align:justify">লাল ইটের তৈরি বলে স্থানীয় মানুষের কাছে এটি ‘লাল গির্জা’ হিসেবে পরিচিত। প্রাচীন এ গির্জার নাম কেতাবি নাম ইপিফানি গির্জা হলেও এটি অক্সফোর্ড মিশন নামেই বেশ পরিচিত। গির্জাটি ১২২ বছর আগে গ্রিক স্থাপত্য শৈলীর অনুকরণে নির্মিত হয়েছে। </p> <p style="text-align:justify">নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণে গির্জাটি দেখতে এখনো ঝকঝকে তকতকে রয়েছে। গির্জার দক্ষিণ পাশে শানবাঁধানো বড় পুকুর। পুকুরের টলটলে জলে গির্জার মোহনীয় প্রতিবিম্ব আগের মতোই নজরকারে পর্যটকদের। বি‌শেষ ক‌রে ২৫ ডিসেম্বর বড়দি‌নে পর্যটকদের ঢল নামবে এই গির্জায়।</p> <p style="text-align:justify">বরিশাল নগরীর জীবনানন্দ দাশ সড়কের (বগুড়া রোড) পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে গির্জাটি। মূল গির্জাটির রং লাল হলেও এর আঙিনায় পরতে পরতে সবুজের সমারোহ। সুদৃশ্য পামগাছে ঘেরা গির্জার চারদিকের সীমানা। ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি গাঢ় সবুজ আঙিনা, বৃক্ষশোভিত উদ্যান, মাঠ, ফুল ও ঔষধি বাগান।</p> <p style="text-align:justify"><strong>ঐতিহ্যের স্মারক</strong></p> <p style="text-align:justify">ইতিহাস বলছে, গির্জাটি দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন পুরাকীর্তিগুলোর একটি। অক্সফোর্ড মিশন চার্চটি দেখতে একতলা হলেও উচ্চতায় প্রায় ৫ তলা ভবনের সমান। মূল গির্জার আদলে পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে একটি টাওয়ার, নাম তার বেল টাওয়ার। তাতে রয়েছে একটি সুদৃশ্য ঘণ্টা। এটি এশিয়ার অন্যতম বড় উপাসনালয়। তাই বলে এই গির্জা যে কেবল ধর্ম প্রচার কিংবা প্রার্থনার কেন্দ্রই নয়, শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি মানবসেবায় এটি শতবর্ষ ধরে অবদান রেখে চলেছে।</p> <p style="text-align:justify">দেশীয় প্রযুক্তিতে গির্জাটি নির্মিত হয়েছিল। এখানকার মাটি দিয়ে তৈরি আস্তনে পোড়া লাল শক্ত ইট দিয়ে। তার সঙ্গে রড, বালু, সিমেন্ট, কাঠ রয়েছে। শুধু দেশীয় নির্মাণসামগ্রীয় নয়, নির্মাণশ্রমিকরাও ছিলেন এই দেশের। শুধু ভেতরে চারটি বেদির মার্বেল-পাথর ভারতের কলকাতা থেকে আনা হয়েছিল। এছাড়া প্যালেস্টাইনের বেথলেহেম থেকে বড় ক্রুশটি আনা হয়। শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও গির্জাটির আদি ও অকৃত্রিম রূপের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।</p> <p style="text-align:justify">৪০টি খিলানের ওপর গির্জাটি দাঁড়িয়ে আছে। গ্রিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত অক্সফোর্ড মিশন গির্জার ভেতর আছে সুবিশাল প্রার্থনা কক্ষ। বিশাল ও নান্দনিক প্রার্থনাকক্ষটি এ গির্জার প্রধান আকর্ষণ। যিশুর আশীর্বাদ জ্ঞাপনস্বরূপ মূল বেদির ওপর একটি বিশাল আকৃতির ক্রুশ রয়েছে। যেটি শুধু খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের নয়, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। </p> <p style="text-align:justify"><strong>যেভাবে শুরু লাল গির্জার</strong></p> <p style="text-align:justify">ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ১৮৮৯ সালে ইংল্যান্ডের আর্চবিশপের নির্দেশে অ্যাংলিক্যান মিশনারিজের একটি গ্রুপ ভারতবর্ষে আসেন। ভারতের মাদ্রাজ থেকে তাদের মিশন শুরু হয়। এর পরই তাদের অপর একটি গ্রুপ আসে বাংলাদেশে। ধর্ম প্রচারের জন্য তারা বরিশাল শহর ও আগৈলঝাড়ায় জোবার পাড়ে তারা দুটি জায়গা বেছে নেন।তারই অংশ হিসেবে ১৯০৩ সালের ২৬ জানুয়ারি নগরীর জীবনানন্দ দাশ সড়কের এই গির্জার নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হয়। ওই দিনই ‘এপিফানি গির্জা ভগ্নী সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। লাল ইটের তৈরি এই গির্জা সিস্টার এডিথের স্কেচের আদলে মূল আকৃতি দেন ফাদার স্ট্রং। ১৯০৭ সালের দিকে গির্জার নির্মাণকাজ শেষ হয়। </p> <p style="text-align:justify">ফ্রেডরিক ডগলাস এটি নির্মাণ করেছিলেন। ডগলাস ইংল্যান্ড অক্সফোর্ডের ক্রাইস্টচার্চে শিক্ষা লাভ করেন। ১৮৯২ সালে তিনি প্রথম এই দেশে আসেন। একবার সন্ত্রাসী হামলায় মারাত্মক আহত এক পুলিশ সদস্যকে তিনি বাঁচিয়েছিলেন। তার এই মহৎ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর প্রতিকৃতি উপহার পেয়েছিলেন তিনি। সারা জীবন উপহারটি সঙ্গে রেখেছিলেন। </p> <p style="text-align:justify">১৯০৪ সালের ১৯ মার্চ ক্ষেত্রমণি দত্তের দেওয়া ২৫ হাজার টাকার এপিফানি গির্জার নির্মাণকাজ শুরু হয়। পরবর্তীতে ডগলাস তার বিদেশি বন্ধুদের আর্থিক সহায়তায় গির্জার কাজ এগিয়ে নিয়ে যান। গির্জার নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯০৭ সালে। পরবর্তীতে ডগলাস ১৯০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বরিশালে ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা করেন।</p> <p style="text-align:justify"><strong>জীবনানন্দ দাশ ও লাল গির্জা </strong></p> <p style="text-align:justify">রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের একটি বিখ্যাত কবিতা ‘আকাশে সাতটি তারা’। কথিত আছে, কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন তার প্রথম প্রেমিকা মনিয়াকে নিয়ে। এই অক্সফোর্ড মিশন গির্জাতেই মনিয়ার দেখা পেয়েছিলেন কবি। মুনিয়ার মা এই গির্জায় সেবিকার কাজ করতেন। বরিশালের এই পুরোনো গির্জাটির সঙ্গে জীবনানন্দের সম্পর্কও ছিল নিবিড়। </p> <p style="text-align:justify">ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, ছাত্রাবস্থায় অক্সফোর্ড মিশনের ছাত্রাবাসে থাকতেন জীবনানন্দ দাশ। ফলে এখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কবির ঘনিষ্ঠতা ছিল। শতবর্ষী এই গির্জাটির সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে জীবনানন্দ দাশের নাম। জীবনানন্দের বাড়ি থেকে দু-কদম এগোলেই গির্জাটির সীমানা। ধানসিঁড়ি বাড়ি থেকে একটু পূর্ব দিকে এগোলেই চোখে পড়বে পামগাছ ঘেরা অক্সফোর্ড মিশন।</p> <p style="text-align:justify"><strong>শিক্ষা আর মানবসেবায় লাল গির্জা</strong></p> <p style="text-align:justify">দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম (একতলা উচ্চতায়) এই ব্যাসিলিকা এপিফানি গির্জাটি ঘিরে ১০টি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এর মধ্যে একটি মাধ্যমিক, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চারটি শিক্ষার্থী হোস্টেল, মেটারনিটি ক্লিনিক, ব্রাদারহুড, সিস্টারহুড, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, মিশনপাড়া (কোয়ার্টার), কবরস্থান, সেন্ট মেরিজ (প্রতিবন্ধী ও অনাথ আশ্রম)।</p> <p style="text-align:justify">গির্জার ব্যবস্থাপক বললেন, গির্জাটি ঐতিহাসিক নিদর্শন ও ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ। এখানে দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষার্থী আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে সব ধর্মের এবং সম্প্রদায়ের মানুষ পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। মিশনের চিকিৎসাকেন্দ্রে মা ও শিশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।<br />  </p>