<p>বাংলাদেশি শিল্পী হিসেবে প্রথমবার গ্র্যামির মনোনয়নে নাম উঠেছিল সংগীতশিল্পী আরমীন মূসার। সংগীত পরিবারে বেড়ে উঠেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বার্কলি কলেজ অব মিউজিকে সংগীতের ওপরেই নিয়েছেন উচ্চশিক্ষা। তাঁর হাত ধরেই দেশে প্রচলিত হয়েছে ‘কয়্যার’ সংগীত। এই সংগীতশিল্পীর সমসাময়িক ব্যস্ততা ও গানের জগত নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন কামরুল ইসলাম।</p> <p><strong>নতুন বছরের শুরুতেই (১১ জানুয়ারি) </strong><strong>‘</strong><strong>ঢাকা ড্রিমস</strong><strong>’</strong><strong> কনসার্টে পারফরম করবেন। কেমন পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন?</strong></p> <p>সাধারণত আমি একক পরিবেশনা করি। আর ঘাসফড়িং আলাদা পারফরম করে। সেখানে আমি গান করি না, নির্দেশনা দিই। এবার ঢাকা ড্রিমস বলল, তারা দুটিই চায়। সেভাবে পরিকল্পনা সাজাচ্ছি, আমার ও ঘাসফড়িংয়ের একটি বা দুটি সমন্বিত গান থাকবে। এ কনসার্ট নিয়ে আমি খুব এক্সাইটেড। গ্র্যামিতে মনোনয়ন পাওয়া আমার ‘জাগো পিয়া’ গানটি বার্কলির (এই দলের সঙ্গে সমন্বিতভাবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন) বাইরে কখনো পারফরম করিনি। এদিন প্রথমবার বাংলাদেশে করব। মজার ব্যাপার হলো, ১১ জানুয়ারি ঢাকা ড্রিমসে ওপেনিং পারফরম করব আমরা। সেদিন আমাদের ‘ঘাসফড়িং’-এর ১০ বছর হবে। কিভাবে যে মিলে গেল!</p> <p><strong>গানে সাম্প্রতিক ব্যস্ততা কী নিয়ে?</strong></p> <p>সিঙ্গেলস নয়, আমি অ্যালবাম ধরে কাজ করি। পাঁচ বছর ধরে একটি অ্যালবামের গান লিখেছি, সবগুলো ইংরেজি। শীতকালটা শেষ হলে কাজ শুরু করব। আমার স্টুডিও নেই, ফলে কোনো স্টুডিওতে যেতে হলেও অনেক ভাবনা-চিন্তা করতে হয়। সেটির জন্য নিজেকে সময় দিতে হবে। স্টেজ শোর ব্যস্ততায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না।</p> <p><strong>কয়্যার নিয়ে এক দশক ধরে কাজ করছেন। সংগীতের এ ধরনটা আসলে কেমন?</strong></p> <p>আমাদের এখানে যেমন দলীয় পরিবেশনা হয়, একই গান অনেক শিল্পী মিলে গায়। তবে কয়্যারের ভিন্ন দিক হলো, গানের শব্দ এক হতে পারে, তবে শিল্পীদের নোট আলাদা হয়। একই সঙ্গে চার-পাঁচটি নোট বাজতে পারে এবং সেটি সুন্দরও হয়। এটিকে বলে হারমনি, অর্থাৎ পাশাপাশি অনেক ধর্মের মানুষ মিলেমিশে থাকা। আমার জীবনের ভাবনা-দর্শনও এটি। আমি থেকে আমরা হওয়ার দর্শন এই গানের মধ্যে পাই। বার্কলি কলেজ অব মিউজিকের প্রথম সেমিস্টারে আমি কয়্যারের অডিশন দিয়েছিলাম। এর আগে কয়্যার সম্পর্কে জানতাম না। সেখানে গিয়েই জেনেছি। ভিন্ন ভিন্ন স্বর, অথচ একসঙ্গে যখন গাওয়া হয়, কত সুন্দর লাগে। আমি একা কিছু করলে সেটি শুধু আমার। কিন্তু বিশজন মিলে কিছু করলে সেটির আনন্দ অনেক বড়। আমার কয়্যার টিমেও বিভিন্ন ধর্ম, পেশা, সামাজিক শ্রেণির মানুষ আছে। গানের হারমনির সঙ্গে আমাদের জীবনেরও একটি মেলবন্ধন গড়ে উঠেছে।</p> <p><strong>দলবদ্ধ কাজ কঠিন মনে হয় না? মানে সবার মানসিকতার সমন্বয়, দল পরিচালনা, নানা চাপ তো থাকে...</strong></p> <p>আমার কাছে এটি সহজ মনে হয়। গান ভালোবেসে যে মানুষটি আমাদের দলে আসে, তার সঙ্গে মিলেমিশে থাকা খুব একটা কঠিন না; বরং একা চলাই কঠিন। এ শহরে একটি মেয়ে একা একা কম্পোজার, ব্যান্ড লিডার হওয়া অনেক কঠিন।</p> <p><strong>সম্প্রতি আপনার </strong><strong>‘</strong><strong>কনটেম্পরারি বাংলা কয়্যার</strong><strong>’</strong><strong> নামে একটি স্যাম্পল প্রকাশিত হয়েছে স্প্লাইস-এ। বিষয়টি একটু বুঝিয়ে বলবেন?</strong></p> <p>গানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কিছু দেখভাল করেন যিনি, সংগীতে তিনিই প্রযোজক। বিভিন্ন দেশের সংগীত প্রযোজকরা মিউজিকের স্যাম্পল করেন। যেমন ধরুন একটি পাখির শব্দ রেকর্ড করে সেটি গানে ব্যবহার করা। আর যখন অনেকগুলো পাখির সাউন্ড রেকর্ড করে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দেওয়া হয়, সেটি হলো স্যাম্পল লাইব্রেরি, যেখান থেকে অন্যরা নিজ নিজ প্রয়োজনে কিনে ব্যবহার করতে পারেন। গানের ক্ষেত্রে ‘স্প্লাইস’ হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্যাম্পল লাইব্রেরি। তারা বাংলা গানের একটা স্যাম্পল লাইব্রেরি করতে চাইল, দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। আমরা সরগম থেকে শুরু করে বাংলা সংগীতের প্রায় ২০০ স্যাম্পল করেছি।</p> <p><strong>বিদেশে সংগীত নিয়ে পড়াশোনা, গ্র্যামিতে মনোনয়ন, নানা সূত্রে ভিনদেশি শিল্পীদের সঙ্গে আপনার ভাবনার বিনিময় হয়। সেসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশ কোন দিক দিয়ে পিছিয়ে?</strong></p> <p>এত বছর এটি নিয়ে চিন্তাই করিনি। আমি দেশে এসে একটিই সরকার দেখেছি। শিল্প-সংস্কৃতির জন্য একটি বাজেট থাকে, সেটি সব সময় তাদের দলীয় লোকজনকে দেওয়া হতো। বিদেশে থেকে আমি বুঝেছি, শিল্প-সংস্কৃতির কোনো প্রকল্পে যদি যথাযথ শিক্ষিত মানুষ দায়িত্বে না থাকে, তাহলে দেশের আর্ট-কালচার হারিয়ে যায়। দেশে আসার পর থেকে দেখেছি, শিল্পকলার আয়োজনে ঘুরেফিরে একই শিল্পীরা পারফরম করছেন। আমাকেও ডাকা হয়েছিল, গিয়েছি কয়েকবার। গিয়ে মনে হয়েছে এটিও দুর্নীতির জায়গা। এগুলো দেখতে দেখতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। তবে জুলাইয়ের পর থেকে চিন্তার সাহস করছি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও অবকাঠামোগত দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে আমরা। এখন একটু আশাবাদী। এই যেমন বিজয় দিবসে শিল্পকলা একাডেমিতে আর্টসেল ও লালনের মতো ব্যান্ড পারফরম করল। মনে হচ্ছে, কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসবে। শূন্য থেকে অন্তত একে আসবে, মাইনাসে যাবে না।</p> <p><strong>এমন কোনো দিক আছে, যেটাতে বাংলাদেশ এগিয়ে?</strong></p> <p>আমাদের লোকসংগীত এত সমৃদ্ধ! ফোক গানের কথাগুলো যদি মানুষ পড়ত, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা পড়ত, লালনের দর্শন অনুসরণ করত, তাহলে দেশ অনেক এগিয়ে যেত। সমস্যা হলো, সমাজ এখন অর্থকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এখন শিক্ষিত মানুষের চেয়ে ধনীদের বেশি সম্মান করা হয়। ছোটবেলায় দেখেছি, যে মানুষটা দিনে ১০ ঘণ্টা রেওয়াজ করেন, তাঁকে বেশি সম্মান দেওয়া হতো। বড় হয়ে দেখছি, যাঁরা ধনী তাঁদেরই  বেশি সম্মান দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে কেউ তো শিল্প-সাহিত্যে যেতে চাইবে না।</p>