<p>২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান পরবর্তীতে পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ মদদে যুদ্ধে রূপলাভ করে। এই যুদ্ধের শুরু থেকেই মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে ইউক্রেনকে সহায়তা অব্যাহত রাখতে থাকলেও সময়ের পরিক্রমায় এটি ক্রমেই বিস্তৃত হয়েছে। এর আগে আমরা দেখেছি যেকোনো বৈশ্বিক সংঘাতে যেখানে বড় এবং শক্তিশালী দেশগুলো মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে সংকট প্রশমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে চীন ছাড়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সব কয়টি দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে এই সংকট প্রশমনে কার্যত মধ্যস্থতাকারী দেশ হিসেবে এগিয়ে আসছে না কেউ। চীন এখন পর্যন্ত এই সংকট নিয়ে নিজেদের অবস্থান যতটুকু জানান দিয়েছে তা থেকে তারা এটা স্পষ্ট করেছে যে ন্যাটোর রাশিয়ামুখী বিস্তার নিয়ে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া তাদের আত্মরক্ষার অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। তা ছাড়া দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে তারা এখনো অটল রয়েছে। তবে বিভিন্ন সময়ে চীনের সরকারি পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া থেকে এই যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকেই দায়ী করা হয়েছে।</p> <p>এই অবস্থায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একটি সিদ্ধান্তের কারণে গোটা পরিস্থিতি আবারও এক অনিশ্চিত অবস্থার দিকে মোড় নিল। ইউক্রেনকে দেওয়া দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের সবুজ সংকেত দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ইউক্রেন এটি দিয়ে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে আঘাত করে বসে। মস্কোর তরফ থেকে এটিকে রাশিয়ার ভূখণ্ডে ইউক্রেনের মাধ্যমে মার্কিন হামলা হিসেবে দেখা হচ্ছে। দ্য আর্মি টেকটিক্যাল মিসাইল সিস্টেম বা এটিসিএমএস নামক ক্ষেপণাস্ত্রের দ্বারা ভূমি থেকে ভূমিতে ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা যায়। ইউক্রেন এবার এটার ব্যবহার করে আঘাত করেছে রাশিয়ার অভ্যন্তরে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এমন এক সময় রাশিয়ার ওপর এই ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহারের অনুমতি দিলেন, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন এবং আর মাত্র কিছুদিন পর রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষেক ঘটতে যাচ্ছে, যিনি দায়িত্ব নেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই যুদ্ধের সমাপ্তি টানার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক এমন একটা অন্তর্বর্তী সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে এ ধরনের একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়াটা কতটুকু যৌক্তিক ছিল। সেই সঙ্গে এটাও আলোচনায় উঠে আসছে যে এই যুদ্ধ বন্ধ করার উপায় থাকার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের একটি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য রাশিয়া এবং ইউক্রেনকে প্ররোচনা দেওয়াটাই বা কতটুকু সঠিক ছিল। এর মধ্য দিয়ে এটাও একটা চেষ্টা থাকতে পারে যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দায়িত্বে অভিষিক্ত হওয়ার আগেই যুদ্ধটিকে এমন এক অবস্থায় মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া, যাতে ট্রাম্প তার পূর্ব প্রতিশ্রুত যুদ্ধবিরতিতে ব্যর্থ হন।</p> <p><img alt="ইউক্রেন যুদ্ধের লাগাম এখন ট্রাম্প-পুতিনের হাতে" height="240" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/11.November/27-11-2024/5.jpg" style="float:left" width="321" />বাস্তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এ ধরনের পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে উত্তেজনা আরো বাড়বে কি না এর পুরোটাই অবশ্য নির্ভর করছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের ওপর। মার্কিন নির্বাচনের পর তিনি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আলোচনায় বসতে তার আগ্রহের কথা এরই মধ্যে বিভিন্নভাবে তিনি জানিয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট পুতিনের তরফ থেকেও এই যুদ্ধের একটা ফায়সালার বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। আসলে যুদ্ধ কোনো পক্ষকেই নিরঙ্কুশ সাফল্য এনে দেয় না, বরং এর ফলে সৃষ্ট ক্ষত মেরামতে অনেক ক্ষেত্রে যুগের পর যুগ সময় চলে যায়। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার তুলনায় ইউক্রেনের ক্ষতি এবং ধ্বংসের পরিমাণ বেশি হলেও আন্তর্জাতিক পরিসরে রাশিয়ার ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তা ছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যাংকে রাশিয়ার বিশাল অঙ্কের অর্থ বর্তমানে বাজেয়াপ্ত হয়ে পড়ে আছে, যার একটা অংশ এরই মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়ার দিক থেকে চাওয়া থাকবে অর্থনৈতিক গতিকে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার। অন্যদিকে ইউক্রেনের যে ক্ষতি হয়েছে, সেটা পূরণেও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে কিভাবে এবং কতটুকু সহায়তা দেওয়া যেতে পারে, এ বিষয়টি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধে ইউক্রেন এখন পর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলো থেকে যে পরিমাণ আর্থিক সহায়তা পেয়েছে, এর অর্ধেকের বেশি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বরাদ্দ করা। সুতরাং যুদ্ধ বন্ধ বা বিরতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাই এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।</p> <p>নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দিক থেকে শেষ সময়ে এসে উসকানির মধ্য দিয়ে এটিকে আরো ক্ষতিকর দিকে নিয়ে যাওয়ার যে উদ্দেশ্য দেখানো হয়েছে, প্রেসিডেন্ট পুতিনের পরিণত রাজনৈতিক মেধা এটিকে রোধ করে দিতে পারে। যদিও এই যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই রাশিয়ার পক্ষ থেকে একাধিকবার পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছিল, তবে তা ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্রদের তাদের তৈরি অস্ত্রের ব্যবহার রোধের বিষয়ে একধরনের হুঁশিয়ারি, এত দিন পর্যন্ত পশ্চিমারা এটিকে সচেতনভবেই এড়িয়ে এসেছে। তবে এই পর্যায়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে তাদের এটিসিএমএস ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে জো বাইডেনের দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডকেই প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। এই এটিসিএমএস এমন এক প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে শত শত বোমা দিয়ে একটি ওয়ারহ্যাড বানানো হতে পারে, যা একটি বড় এলাকাজুড়ে হালকা সাঁজোয়া যান ধ্বংস করতে পারে। আর অপরটি হচ্ছে একটিমাত্র বোমা, যার মধ্যে উচ্চ মাত্রার বিস্ফোরক দিয়ে ২২৫ কেজি ওজনের বোমা তৈরি করা হয়, যার মাধ্যমে শত শত সামরিক স্থাপনা এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ধ্বংস চালানো যেতে পারে।</p> <p>সংগত কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ সংকেতে তাদের তৈরি এই বোমা দিয়ে যখন ইউক্রেনের তরফ থেকে রুশ ভূখণ্ডে হামলা পরিচালনা করা হয়, এটিকে মার্কিনদের তরফ থেকে রাশিয়ার প্রতি একটি আক্রমণ হিসেবে তুলনা করা হলো। তবে এর মাধ্যমে ইউক্রেন যে অব্যাহতভাবে এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালাতে থাকবে, সেটাও ভাবার অবকাশ নেই। কারণ এর পর্যাপ্ত মজুদ নেই তাদের কাছে। যুক্তরাষ্ট্র এই সময়ে ইউক্রেনকে এটি দিয়ে কতটুকু সক্ষম করতে চাইবে বা পারবে সেটাও এক প্রশ্নের বিষয়। এ ক্ষেত্রে সংগত কারণেই প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কেন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এ ধরনের হামলার বিষয়ে ইউক্রেনকে সবুজ সংকেত দেওয়া হলো। এর উত্তরে এটাই বলা যেতে পারে যে এই যুদ্ধের পেছনে বাইডেন প্রশাসনের ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং এই সময়ে এসে রাশিয়ার দিক থেকে এমন কিছু প্রতিক্রিয়া দেখতে চাওয়া, যা পরবর্তী প্রশাসনকে এই যুদ্ধটি চালিয়ে নিতে বাধ্য করবে এবং এর দ্বারা বাইডেনের সিদ্ধান্তের এক ধরনের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত হবে।</p> <p>পুতিনের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এহেন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, এমন মন্তব্য করা হলেও এখানে তার ধৈর্যচ্যুতি কিংবা বাইডেন প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার প্রচেষ্টা সত্যিই এক বিপর্যয়ের জন্ম দিতে পারে। তবে বাস্তবে এর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যদিও এরই মধ্যে রাশিয়া প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতে যুদ্ধবিমান মোতায়েনসহ সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে তারা। বলা যায় সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে তারা। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেন সেটা বলা যাচ্ছে না—এমনটাই হয়তো আঁচ করছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। তবে তিনি নিশ্চয়ই ট্রাম্পের যুদ্ধ বন্ধের অঙ্গীকারের বিষয়ে আস্থাহীন হতে চাইবেন না। এ ক্ষেত্রে এই এটিসিএমএস-এর ব্যবহার প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য কিছুটা নিবারক হিসেবে কাজ করতে পারে। কারণ এত দিন ধরে ইউক্রেনের উত্তরের অংশগুলো একের পর এক অভিযান করে দখলে নিচ্ছিল রুশ বাহিনী। এই এটিসিএমএস ব্যবহারের ফলে এখন তারা এর আরো ব্যবহারের ঝুঁকিতে রয়েছে, যা ইউক্রেনকে এক ধরনের সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে। ফলত প্রেসিডেন্ট বাইডেন যা চাচ্ছেন, অর্থাৎ পুতিন যেন আরো আগ্রাসী হয়ে কোনো বড় ধরনের ভুল করে বসেন, বাস্তবে তা না ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। আর এমনটা হলে বাইডেন নিজের অজান্তেই তার উত্তরসূরি ট্রাম্পের জন্য একটা উপকার করে দিলেন। কারণ এর মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত রাশিয়া তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থা মজবুত করার স্বার্থে তাদের অভিযানের লাগাম টেনে ধরবে আর ট্রাম্প এসে যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়াকে আরো মসৃণভাবে এগিয়ে নিতে পারবেন।</p> <p>লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p>mfulka@yahoo.com</p>