<p>পদ্ধতিগত সংস্কার করে নির্বাচিত সদস্যদের ভোটের ভিত্তিতে, অর্থাৎ ‘পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায়’ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধান ঠিক করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা এই মতের পক্ষে নানা যুক্তি দিয়েছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা এমনও বলছেন, চেয়ারম্যান বা মেয়র পদে রাজনৈতিক প্রার্থীর চিন্তা বাদ দিয়ে উভয়ের জন্যই সরাসরি ভোট হওয়াটাই উত্তম।</p> <p>‘পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায়’ স্থানীয় সরকার আলোচনাটি তুলেছেন স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ। এই আলোচনার পাশাপাশি স্থানীয় নির্বাচনের আগে নাকি পরে জাতীয় নির্বাচন—এমন বিষয়টিও প্রাধান্য পাচ্ছে।</p> <p>বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার (ইউপি সদস্য) ও চেয়ারম্যান পদে সরাসরি ভোট দেন ভোটাররা। পৌরসভা নির্বাচনে কাউন্সিলর ও মেয়র পদেও সরাসরি ভোট দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রেও একইভাবে মেয়র নির্বাচিত হন।</p> <p>যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে এবং সরকার যদি তা গ্রহণ করে, তাহলে ইউপি সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে তারা নিজেরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবেন। পাশাপাশি কাউন্সিলরা জনগণের ভোটে সরাসরি নির্বাচিত হয়ে মেয়র নির্বাচন করবেন। অর্থাৎ চেয়ারম্যান ও মেয়র পদে সাধারণ মানুষের ভোট দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না বা সুযোগ থাকবে না। সিটি করপোরেশনের মেয়রও হবেন একই প্রক্রিয়ায়।    </p> <p>গত শনিবার নির্বাচন কমিশনে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাতীয় সংসদে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা যেমন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেন, তেমনি নির্বাচিত স্থানীয় সরকার সদস্যরা তাদের সভায় প্রধান নির্বাচন করবেন। আর সব স্থানীয় সরকার গঠন হবে এক আইনে, এক নির্বাচনে।</p> <p>এ ক্ষেত্রে অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদের যুক্তি হলো, গত কমিশন যে স্থানীয় নির্বাচন করেছে, এতে ২৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ওই নির্বাচন আয়োজনে ১৯ থেকে ২০ লাখ লোকের প্রয়োজন হয়েছে। ভোটগ্রহণে সময় লেগেছে ২২৫ দিনের মতো। তাই স্থানীয় নির্বাচনে যদি পার্লামেন্টারি সিস্টেম নিয়ে আসা হয়, ইউনিয়ন, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনে যদি একই সিস্টেমে ভোটের আয়োজন করা যায়, তাহলে খরচ চলে আসবে ৬০০ কোটি টাকার মধ্যে। লোকবল কম লাগবে। সময়ও অনেক কম—মাত্র ৪৫ দিন লাগবে।</p> <p>এই স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞের মতে, ‘এ জন্য একটা কম্প্র্রিহেন্সিভ আইন হবে। সেই আইনের মধ্যে সব প্রতিষ্ঠান চলে আসবে। এতে একটা তফসিল দিয়ে স্থানীয় সরকারের সব কটি নির্বাচন করতে পারব। তাহলে নির্বাচন অনেক ব্যয় ও সময়সাশ্রয়ী হবে।’</p> <p>এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. তারিকুল ইসলাম। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকারে শৃঙ্খলার জন্য নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবার মতামত নেওয়া হবে। ড. মো তারিকুল ইসলাম স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন সংশ্লিষ্ট সব স্তরের সঙ্গে আলোচনা করেই সুপারিশ পেশ করবে। এখনো কিছু বলার মতো কোনো সুযোগ ও সময় আসেনি।</p> <p>ভিন্নমত দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল মোমেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, বর্তমানে জনগণের ভোটে চেয়ারম্যান ও মেয়র নির্বাচিত হচ্ছেন।  যদি তারা মেম্বার ও কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত হন, তাহলে এতে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীলের ধারণা পূর্ণাঙ্গভাবে হয় না। এতে জনগণের অধিকার খানিকটা হলেও লঙ্ঘিত হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।</p> <p>ড. নুরুল মোমেনের মতে, ‘ঐতিহ্যগতভাবে আমরা নির্বাচনমুখী। যারা জনপ্রতিনিধিত্ব রাখার ক্ষমতা রাখে, সেই সব মানুষকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত করা অবশ্যই উত্তম। সংসদ সদস্যদের ভোটে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, সেই যুক্তি দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদেও চেয়ারম্যান নির্বাচন করার প্রক্রিয়াটি খোঁড়া যুক্তি। আশা করছি, সংশ্লিষ্ট কমিশন সবার সঙ্গে কথা বলে সরকারের কাছে সুপারিশ করবে।’</p> <p>ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সাদিক হাসানও মনে করেন, ইউপি সদস্যদের ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচন করার প্রক্রিয়াটি ঠিক হবে না।</p> <p>তিনি মনে করেন, ‘যারা ইউপি সদস্য পদে নির্বাচন করেন, তাদের ভোটে অংশগ্রহণের যোগ্যতা, তাদের প্রতি জনগণের চাহিদা এবং চেয়ারম্যান পদের অংশগ্রহণের যোগ্যতা ভিন্ন। তাই ইউপি সদস্যদের ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচন করা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নযোগ্য হবে না।’</p> <p>এই অধ্যাপকের যুক্তি হলো, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান ভূমিকা রাখে। প্রার্থীরা নির্বাচিত হওয়ার পরও রাজনৈতিক দলের অধীনে থাকেন। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে সেটা সম্ভব নয়। যে প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে, সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীদের পার্টির অধীনে আসতে হবে। এতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আরো রাজনীতিকরণ হয়ে যাবে।</p>