<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হওয়ার জন্য ড. মনসুরের চেয়ে অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ছিলেন বলে আমার মনে হয় না। জনাব মনসুর যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন, তখন সময়টা মোটেই তাঁর জন্য অনুকূলে নয়, বরং যথেষ্ট প্রতিকূলে। দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা রকম প্রতিকূল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অর্থনীতি বেশ চাপের মধ্যে ছিল বেশ কয়েক বছর ধরেই। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকারের পতন এবং নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ায় অর্থনীতির এই চাপের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে যে মাত্রায় হতাহত এবং ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা ঘটেছে, তাতে দেশের অর্থনীতি যে আরো অধিক চাপের মধ্যে পড়ে গেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি এবং বিদেশ থেকে রেমিট্যান্সপ্রবাহ</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এসব কিছুতেই একটা স্থবিরতা তো সৃষ্টি হয়েছে, যা পূর্ণমাত্রায় চালু হতে কিছুটা সময় লাগবে। তা ছাড়া দেশে একটি বড়মাপের পরিবর্তন হয়ে গেছে। যেকোনো পরিবর্তনের পর মানুষের মাঝে প্রত্যাশা বেড়ে যায় এবং নতুন সরকারের কাছেও মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকাই স্বাভাবিক। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বিশ্ব অর্থনীতি এখনো সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। উন্নত বিশ্বে এখনো উচ্চ সুদের হার বিরাজ করছে। উন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক সূচক নিয়েও আছে এক ধরনের সংশয় বা ধূম্রজাল। একদিকে বলা হচ্ছে উন্নত বিশ্বের সব দেশের অর্থনীতি উন্নতির দিকে। মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি চলে এসেছে। বেকারত্বের হারও সর্বনিম্ন পর্যায়ে আছে। চাকরির বাজার যথেষ্ট চাঙ্গা। শেয়ারবাজারেও তেজিভাব বিরাজ করছে এবং রিয়াল এস্টেট মার্কেটও ঊর্ধ্বমুখী। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে অর্থনীতির এতসব ইতিবাচক সূচক থাকা সত্ত্বেও এসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নীতি সুদ হার হ্রাস করেনি। অর্থনীতিবিদ, মুদ্রাবাজার বিশেষজ্ঞ এবং আর্থিক খাতের বিশ্লেষকদের দিক থেকে প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও এসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সুদের হার হ্রাস করেনি। সব দেশ তাকিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের দিকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে নীতি সুদ হার হ্রাসের কোনো রকম সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ডলার হার্ড কারেন্সি (অতি চাহিদার মুদ্রা) হিসেবে আরো অনেক দিন বিরাজ করবে। ফলে ডলারনির্ভর দেশে ডলার সংকটও খুব শিগগির কাটার সম্ভাবনা নেই, যদি না বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এ রকম একটি প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে গভর্নরের দায়িত্ব পালন করা কঠিন কাজ। যত অভিজ্ঞ এবং উপযুক্ত ব্যক্তিই গভর্নরের দায়িত্বে থাকুন না কেন, তাঁর পক্ষে এই গুরুদায়িত্ব পালন করা অনেকটাই দুঃসাধ্য। তাঁর সামনে থাকবে অনেক চ্যালেঞ্জ এবং অগ্রাধিকারের এক বিশাল তালিকা। পরিস্থিতি এমন যে কোথা থেকে শুরু করে কিভাবে এগিয়ে নিতে হবে, সেটি নির্ধারণ করাই সবচেয়ে কঠিন কাজ হয়ে দেখা দেয়। এ কারণেই নতুন গভর্নর সবচেয়ে যোগ্য ও উপযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সামনে থাকবে অনেক চ্যালেঞ্জ। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, ব্যাংক ও আর্থিক খাত সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত থাকাই তাঁর জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ। <img alt="ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফেরানো বড় চ্যালেঞ্জ" height="290" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/08.July/28-08-2024/1.jpg" style="float:left" width="321" />বর্তমান বাংলাদেশে গভর্নরের চেয়ে অন্য কেউ এসব বিষয়ে ভালো জানে বলে আমার মনে হয় না। কোনো বিষয়ে ভালোভাবে অবহিত থাকাই এক ধরনের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। কেননা তিনি বিষয়গুলো জানেন বিধায় দিনের শুরু থেকেই কাজ শুরু করে দেবেন, তেমনটাই সবার প্রত্যাশা। যেহেতু তিনি জানেন, তাই তাঁর যেমন বিলম্ব করার সুযোগ নেই, তেমনি ভুল করারও অবকাশ নেই। কিন্তু বাস্তবে বিষয়গুলো সেভাবে সব সময় কাজ না-ও করতে পারে। বিষয়গুলো জানা এক জিনিস, আর বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা বা ডেলিভারি করা আরেক জিনিস। এমন দৃষ্টান্ত অনেক আছে যে বিষয় সম্পর্কে ভালোভাবে জানা থাকা সত্ত্বেও সঠিকভাবে অবদান রাখা সম্ভব হয়নি। আমাদের নতুন গভর্নরের এমন কিছু হবে না এবং তিনি এই চ্যলেঞ্জ সফলভাবেই মোকাবেলা করতে পারবেন বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এই বিষয়টি বাদ দিলে বর্তমান গভর্নরের প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরানো। নানা কারণে দেশের ব্যাবসায়িক খাতে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। ব্যবসায়ীরা কিছুটা দ্বিধাবিভক্ত এবং এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। এসব কাটিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতে বিনিয়োগের সুযোগ পান, বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় ঋণ সুবিধা পান এবং পুরোপুরি ব্যাবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দেশের মূল্যস্ফীতি হ্রাস করা এবং দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা। আমাদের দেশের অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে। এ কথা ঠিক যে আমাদের দেশে যে বিশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা এবং সাপ্লাই চেইন পদ্ধতি, তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি দিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার কাজটি মোটেই সহজ নয়। তার পরও দৃশ্যমান একটি প্রচেষ্টা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে থাকতে হবে এবং বর্তমান গভর্নর এই চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবেলা করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হবেন। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দেশের ডলার সংকট এবং তারল্য সংকটের সমাধান। দেশে ডলার সংকট বিরাজ করছে  বেশ কয়েক বছর ধরে। এই সংকট কাটানোর উদ্যোগটি মোটেই সহজ কাজ নয়। কেননা ডলার সংকটের কারণ আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ সুদহারের বিনিময়ে হলেও তাদের ডলারকে হার্ড কারেন্সি হিসেবে ধরে রাখার কারণে ডলারনির্ভর দেশে এই সংকট থাকবে। তবে বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, যাতে দেশে ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি পায় এবং সংকটের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। শুধু রেমিট্যান্স এবং রপ্তানির মাধ্যমে এটি সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন আছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">চতুর্থ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার স্বার্থে সহায়ক মুদ্রানীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা। বিশেষ করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারাবাহিকতা যাতে বজায় থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করার প্রয়োজন আছে। মাত্র কিছুদিন আগেই দেশের অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে বর্তমান অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি নীরবে ঘোষিত হয়েছে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সেই মুদ্রানীতি সহায়ক না-ও হতে পারে। তাই মুদ্রানীতিটি পুনর্বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় সমন্বয়সহ নতুনভাবে ঘোষণা করার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পঞ্চম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে বাংলাদেশে ব্যাংকের খোয়া যাওয়া অর্থ উদ্ধারে করা মামলা সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং এই অর্থ উদ্ধারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ষষ্ঠ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কাজটি মোটেই সহজ না হলেও একেবারে যে কঠিন তেমন নয়। পাচার হওয়া অর্থের সঠিক তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে পারলে এই অর্থ ফেরত আনা তেমন কঠিন কাজ নয়। যেহেতু সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) ও টিআইবির (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল) মতো প্রতিষ্ঠান থেকে বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ করা হয়েছে। তাই তাদের কাছে এসংক্রান্ত সঠিক তথ্য-প্রমাণ নিশ্চয়ই আছে। এসব তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নিতে পারলেই পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। এই বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া উচিত এ কারণে যে এর সঙ্গে ডলার সংকট সমাধানের একটা যোগসূত্র আছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে এর মান উন্নয়ন এবং খেলাপি ঋণ সমস্যা সমাধানের মতো বিষয়গুলোকে অনেকেই প্রধান চ্যালেঞ্জ এবং অগ্রাধিকারের প্রথম দিকে রাখার চেষ্টা করবেন। এটি খুবই স্বাভাবিক। কেননা আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে এই সমস্যাগুলো প্রকট এবং দীর্ঘদিন থেকে বিরাজ করছে। ফলে এসব সমস্যার সমাধান নিশ্চয়ই করতে হবে এবং তা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতেই করতে হবে। তবে এই সমস্যা দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত এক অবস্থা, যা ভিন্নভাবে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে দীর্ঘ সময় নিয়ে করতে হবে। ফলে এসব সমস্যাকে দেখতে হবে ভিন্ন আঙ্গিকে এবং অন্যান্য গতানুগতিক সমস্যা থেকে একটু আলাদা করে। আসলে বর্তমান গভর্নরের সামনে যে চ্যালেঞ্জ এবং অগ্রাধিকারের তালিকা, তা লিখে শেষ করা যাবে না। তবে তাত্ক্ষণিক কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ অনতিবিলম্বে গ্রহণ করার কোনো বিকল্প নেই এবং নতুন গভর্নর সেটি করবেন বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">nironjankumar_roy@yahoo.com</span></span></span></span></p> <p> </p> <p> </p> <p> </p>