<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধীদলীয় প্রার্থী অনুড়া কুমারা দিশানায়েকে নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশটিতে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটতে যাচ্ছে। ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার পার্ট (এনপিপি) জোটের এই নেতার বিজয় দেশটির রাজনীতিতে নতুন চমক সৃষ্টি করেছে। এই জোটের অন্যতম দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) প্রধান তিনি। এর আগে ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ৩ শতাংশ ভোট পাওয়া দিশানায়েকে এবার ৫৭ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। দেশটি স্বাধীনতার পর থেকেই মূলত দুটি দল পালাক্রমে দেশ শাসন করছিল। এর মধ্যে দেড় দশক ধরে দেশ শাসন করে আসছিল রাজাপক্ষে পরিবার। ২০২২ সালের জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রথমে রাজাপক্ষে ভ্রাতৃদ্বয়ের মধ্যে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী মহিন্দা রাজাপক্ষে এবং পরে গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। সাংবিধানিক শূন্যতা পূর্ণ করতে সংসদ সদস্যদের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রনিল বিক্রমাসিংহে, এর আগে যিনি একাধিকবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><img alt="শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং আমাদের জন্য শিক্ষা" height="214" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/09.September/27-09-2024/5.jpg" style="float:left" width="321" />নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই সংসদ ভেঙে দেন অনুড়া দিশানায়েকে, নিয়োগ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী এবং আগামী নভেম্বর মাসের দ্বিতীয়ার্ধে দেশটির সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা হবে বলে জানানো হয়েছে। অনুড়া দিশানায়েকের নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি বিভিন্ন দিক দিয়েই বর্তমান সময়ে একটি আলোচিত ঘটনা। এর কারণ হিসেবে প্রথমেই বলতে হয়, যে রাজনৈতিক দলটিকে তিনি নেতৃত্ব দেন, সেটি ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন তো দূরের কথা, ২২৫ আসনের সংসদে মাত্র তিনটি আসন লাভ করেছিল। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, একদা মাত্র ৩ শতাংশ ভোট এবং তিনটি আসন লাভ করা দলটি দেশ শাসনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনের প্রচার চলাকালে তিনি একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাজাপক্ষে আমলের অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে দেশকে টেনে তুলবেন এবং ৬০ দিনের মধ্যে সংসদ ভেঙে দিয়ে দেশে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে তাঁর কথা রেখেছেন। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের মাত্র দুই দিনের মধ্যে তিনি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। দেশটিতে সংসদ নির্বাচনের নতুন তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন তাঁর নিজ দলের হরিণী অমরাসুরিয়া, যিনি দেশটির তৃতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী। তাঁর দলের তিনজন সংসদ সদস্যের সমন্বয়ে একটি ছোট মন্ত্রিপরিষদের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। এর মধ্য দিয়ে দেশটির জনগণ দেশ গঠন এবং সংস্কারের জন্য সাংবিধানিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করল। সাংবিধানিকভাবে পূর্ববর্তী সরকারের স্থলে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করল। এই নির্বাচনে দেশটির এক কোটি ৭০ লাখ ভোটারের মধ্যে ৭০ শতাংশ ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। সার্বিকভাবে নির্বাচনটি ছিল সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক পরিস্থিতির এই পর্যায়ে সর্বত্রই রাজাপক্ষে পরিবারের একচ্ছত্র পরিবারতন্ত্র কায়েমকে বড় করে দেখা হলেও সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে সরকারের কিছু উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা সময়ের বিবেচনায় যথার্থ হিসেবে বিবেচিত হয়নি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা জায়গা নিয়ে কলম্বো পোর্ট সিটি, হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর, হাম্বানটোটায় নতুন বিমানবন্দর এবং ৯৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এক্সপ্রেসওয়ে। এর প্রতিটি প্রকল্পেই চীন ছিল অন্যতম ঋণ প্রদানকারী। এ ধরনের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে গত এক দশকে শ্রীলঙ্কা চীনের কাছ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ নিয়েছে, অথচ সেই অর্থে দেশটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ঘটেনি। দেখা যাচ্ছে যে তাদের মোট ঋণের ১০ শতাংশ চীনের কাছ থেকে নেওয়া এবং অন্যান্য উৎস থেকে সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করে তারা ঋণ নিয়েছে এবং বন্ড ইস্যু করে নেওয়া ঋণের পরিমাণ মোট ঋণের ৪৭ শতাংশ। যখন দেখা গেল এই বন্ডের বিনিময়ে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় চলে এসেছে, তখন উপলব্ধি করা হলো যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থের জোগান দেওয়া যাচ্ছে না। বলা হচ্ছে যে সে বছরের মধ্যে তাদের সাত বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হতো, অথচ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গচ্ছিত ছিল এক বিলিয়ন ডলারেরও কম। এহেন অবস্থায় নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করা সময়ের ব্যাপার মাত্র বলে অনুমান করা হয়। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে এ ক্ষেত্রে ভারত এগিয়ে এসেছিল। তারা তাদের ক্রেডিট লাইন থেকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেয় শ্রীলঙ্কাকে, যা দিয়ে তারা খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি এবং কিছু বকেয়া পরিশোধ করে। পরিস্থিতির আরো অবনতি হলে কেবল ভারতের দেওয়া সাহায্যে এই সংকট উত্তরণ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। রাজাপক্ষেদের ক্ষমতা থেকে বিতাড়নের পর তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত মূলত আইএমএফের সহায়তায় এবং রনিল বিক্রমাসিংহের দূরদর্শী নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কা তাদের সংকটের প্রকটতা কাটিয়ে উঠতে পারলেও দেশের জনগণ প্রথাগত রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর আর আস্থা রাখতে পারছে না। তাই এই পরিবর্তন বলে ধারণা করা যায়।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শ্রীলঙ্কা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে, সেখানে একটি বিষয় সবার মনোযোগ আকর্ষণের দাবি রাখে, আর তা হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও দেশটির গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়নি। এর মূল কারণ দেশটিতে নিয়মিতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল এবং তা ছিল সব দলের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণমূলক। নির্বাচনে কারচুপি বা অনিয়ম নিয়ে দলগুলোর পক্ষ থেকে সে রকম আপত্তি দৃষ্টিগোচর হয়নি। আর এ কারণেই রাজাপক্ষে পরিবার ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও নির্দিষ্ট মেয়াদপূর্তির আগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। সংকট উত্তরণে সংবিধানের বাইরে যাওয়ারও প্রয়োজন হয়নি। রাজাপক্ষে পরিবারের ক্ষমতা ত্যাগের পর অন্তর্বর্তী নেতৃত্বকে দেশের মানুষ মেনে নিয়েছে এবং সহযোগিতা করেছে। এরই ফলে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশটির মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিয়েছে। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা সংগত মনে করছি, আর তা হলো এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি ছিল স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে এখানে এবার সর্বোচ্চ ৩৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং অতীতের নির্বাচনগুলোতে ভালো করতে পারেননি এমন একজনকে নির্বাচিত করার মধ্য দিয়ে জনগণ যে ধারণা দিতে চেয়েছে, তা হলো প্রচলিত ধারার রাজনীতির প্রতি তাদের আর আস্থা নেই। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এসব কিছুই আমাদের জন্য শিক্ষা হতে পারে। বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এ ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন সাধন এখন সময়ের দাবি। অতীতের সরকারগুলোর ধারাবাহিকতায় যদি দেশের পরবর্তী সরকার গঠিত হয় এবং কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তাহলে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা হোঁচট খাবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে রাষ্ট্র সংস্কার-পরবর্তী তাদের করণীয় সম্পর্কে জনগণের আস্থা অর্জনে এবং তাদের নিজ নিজ দলের সংস্কার সাধনে কাজ করাও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এর মানে এটি মনে করার কারণ নেই যে যারা অতীতে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে, তাদের বাইরে থেকে অন্য কাউকে সরকার বা রাষ্ট্র পরিচালনা করতেই হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিজ নিজ দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং নতুন নেতৃত্ব গড়ে ওঠার পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া। এখানে আরেকটি বিষয় হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের সংস্কার। আমরা প্রতিটি দেশেই কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেখি এবং নির্বাচনের ফল মেনে নেওয়ার প্রবণতাও দেখি। শ্রীলঙ্কার পরাজিত প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে তাঁর পরাজয় স্বীকার করে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এ ধরনের সংস্কৃতি আমাদের দেশে একটি দিনের জন্যও দেখা যায়নি, যার কারণে গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে। রাজনৈতিক দলের সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কার সাধনের মধ্য দিয়ে প্রকৃত অর্থে জনগণের ভোটের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবি। ২০২২ সালের সংকট থেকে শ্রীলঙ্কা অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে জনগণ তাদের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকেও কঠিন বার্তা দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট তাঁর প্রতিশ্রুত উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবেন বলে প্রত্যাশা করা যায়। সেই সঙ্গে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও শ্রীলঙ্কার এই ঘুরে দাঁড়ানোকে স্বাগত জানিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রেও এখন এমনটি ঘটছে। বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমাদের নতুন করে অর্থ সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আইএমএফ প্রধানের সাক্ষাতে বাংলাদেশে তাঁদের প্রতিশ্রুত সহায়তা বৃদ্ধির আশ্বাস দিয়েছেন। এসব কিছুই ইতিবাচক লক্ষণ। আপাতত শ্রীলঙ্কার নির্বাচন থেকে আমাদের রাজনীতিবিদরা শিক্ষা নিতে পারেন। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">mfulka@yahoo.com  </span></span></span></span></p>