<p>প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ৩৬তম আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে (আইওআই) স্বর্ণপদক জিতেছে সিলেটের জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র দেবজ্যোতি দাশ সৌম্য। তাঁর অর্জনের গল্প শুনছেনে ইয়াহইয়া ফজল।</p> <p>‘ইন্টারভিউ’ করতে চাই শুনে ফোনের ওপাশে সৌম্যর মিইয়ে যাওয়াটা যেন দিব্যচক্ষুতে দেখা যাচ্ছিল। যেন ফোন রেখে দিতে পারলেই হাফ ছেড়ে বাঁচেন। ফলে বাসার ঠিকানাটাও ভালোভাবে জানা গেল না। বাসা খুঁজতে তাই রীতিমতো ‘গণিতের জটিল ধাঁধা’র সমাধান করতে হলো। বাসার দরজা খুলে যেতেই দেখা মিলল হালকা-পাতলা গড়নের লাজুক সৌম্যর। একরাশ অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণকে দেখে কে বলবে—কঠিন এক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে স্বর্ণপদক জিতে ইতিহাস গড়েছেন।</p> <p>পুরো নাম তাঁর দেবজ্যোতি দাশ সৌম্য। স্বর্ণপদক জয় এবার প্রথম হলেও এই মঞ্চে পদক জেতার অভিজ্ঞতা তাঁর মোটেও নতুন নয়। এর আগেও আইওআইয়ে দুইবার অংশ নিয়ে যথাক্রমে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক জিতেছেন তিনি। সিলেট নগরের কাষ্টঘর এলাকায় সৌম্যদের বসবাস। বাবা এপেক্সিয়ান চন্দন দাশ সিলেট সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা। মা শিখা রাণী দাশ গৃহিণী। দুই ভাইয়ের মধ্যে সৌম্য বড়। সিলেটের স্বনামধন্য জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী।</p> <p><strong>অগ্রজকে দেখেই গণিতে আগ্রহ</strong></p> <p>এমন কঠিন বিষয়ে সৌম্যর আগ্রহ জন্মায় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর কাজিন দীপ্তকে দেখে। ২০১৯ সালে নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নের সময় বিআইওসিতে অংশ নিলেও সফলতা পাননি দীপ্তকে। তবে তাঁকে প্রাণীত সৌম্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের জন্য গৌরব বয়ে এনেছেন। সৌম্য ২০২০ ও ২০২১ সালে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নেন। তবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সাফল্য আসে ২০২২ সালে ৩৪তম আন্তর্জাতিক ইনফরম্যাটিকস অলিম্পিয়াডে। ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় জেতেন ব্রোঞ্জ পদক। পরের বছর ২০২৩ সালে হাঙ্গেরিতে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পান রৌপ্য পদক। তখনই দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘পরেরবার কিন্তু ঠিক স্বর্ণপদক জিতব।’ তা সেটা যে কথার কথা ছিল না সেটি এবার প্রমাণও করলেন স্বর্ণপদক জিতে।</p> <p><strong>যেভাবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ</strong></p> <p>অলিম্পিয়াডগুলোর মধ্যে আইওআইকে সবচেয়ে কঠিন বলে মনে করা হয়। কারণ এই প্রতিযোগিতায় একজন প্রতিযোগীর যেমন বিশ্লেষণ ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ দেখাতে হয়, চিন্তা করে যেমন সমস্যার সমাধান বের করতে হয়, তেমনি সেই সমাধান দক্ষতার সঙ্গে প্রগ্রামিং করতে হয় অল্প সময়ের মধ্যে। সারা দেশের অন্য প্রতিযোগীদের মতো সৌম্যও এ বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশে ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডের (বিআইওসি) প্রথম রাউন্ডে অংশ নেন। সিলেট পর্ব সাধারণত মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে হলেও এবার তা অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিজয়ী হয়ে সৌম্যসহ সারা দেশের ৬০ জন প্রতিযোগী ঢাকার ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। সেখানে দুটি সমস্যার সমাধান করতে হয় প্রত্যেককে। এর ফলাফল থেকে ১০ জনকে নেওয়া হয় ক্যাম্পে। সৌম্য সেই ক্যাম্পে অংশ নেন। ক্যাম্পে সপ্তাহব্যাপী চারটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হয়। সেই চারটি প্রতিযোগিতার ফলাফল ও জাতীয় পর্যায়ের দুটি প্রতিযোগিতার ফলাফল মিলিয়ে শীর্ষ চারজন নির্ধারণ করা হয়। সেই ফলাফলে এবার প্রথম হন সৌম্য। এ ছাড়া দ্বিতীয় হন দেশ আচার্য, তৃতীয় জারিফ রহমান, চতুর্থ আকিব আজমাইন। তাঁরা চারজন সুযোগ পান আন্তর্জাতিক ইনফরম্যাটিকস অলিম্পিয়াডে।</p> <p>১ সেপ্টেম্বর তাঁরা তুরস্ক হয়ে মিসর যান। দেশটির আলেকজান্দ্রিয়ার আরব একাডেমি ফর সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড মেরিটাইম ট্রান্সপোর্টে অনুষ্ঠিত হয় এবারের আসর। ৩ ও ৫ সেপ্টেম্বর প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় দুই দশকের চেষ্টায় এলো প্রথম স্বর্ণপদক আইওআইয়ের প্রতিযোগিতায় দুই দিন পাঁচ ঘণ্টা করে সময় পান প্রতিযোগীরা। এ সময়ের মধ্যে প্রদত্ত তিনটি সমস্যার সমাধান করে তা প্রগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ দিয়ে কোড করতে হয়। ১০০ নম্বরের প্রতিযোগিতায় পাঁচ ঘণ্টা সময় থাকে। এ সময় প্রতিযোগীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে এবং কোনো বইয়ের সহায়তা নিতে পারেন না। সমস্যার সমাধান করতে হয় প্রগ্রামিং ভাষা সি অথবা সি++ এ।</p> <p>আইওআই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী, দুই দিনে পাঁচ ঘণ্টা করে অনুষ্ঠিত সেশনে বিশ্বের মোট ৩০ জন প্রতিযোগী স্বর্ণপদক জেতেন। এর মধ্যে আমাদের সৌম্য ৬২.৫৭ শতাংশ সঠিক সমাধান দিয়ে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে স্বর্ণপদক জয় করেন।</p> <p><strong>দেশের জন্য অর্জনের অনুভূতি অন্য রকম</strong></p> <p>দেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক জয়ের অনুভূতি জানাতে গিয়ে কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না যেন সৌম্য। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে লাজুক হেসে বললেন, ‘এবার প্রত্যাশা ছিল স্বর্ণ জিতব। তাই হয়েছে। দেশের হয়ে কোনো কিছু অর্জনের অনুভূতি অন্য রকম, অসাধারণ। এর সঙ্গে আর কিছুরই তুলনা হয় না।’</p> <p><strong>দেশের সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার সৌম্য</strong></p> <p>বাংলাদেশকে স্বর্ণপদক এনে দেওয়া দেবজ্যোতি দাশ সৌম্য কোডফোর্সেসের একজন রেড কোডার। কোডফোর্সেসের নিয়ম অনুযায়ী এক হাজারের কম রেটিং যাঁদের তাঁদের নিউরি, এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ রেটিংধারীদের পিউপল এবং কারো রেটিং দুই হাজার ৪০০ হলে তার প্রফাইলের রং লাল হয়। এই লাল থেকেই ‘রেডকোডার’। ২০২৩ সালের ১১ জুলাই এক প্রতিযোগিতা শেষে সৌম্যর রেটিং দুই হাজার ৩৭২ থেকে দুই হাজার ৪৬৭-তে পৌঁছায়, যা গ্র্যান্ডমাস্টার স্তরের।</p> <p><strong>নিজেই কিছু করতে চান</strong></p> <p>ভবিষ্যতে কী হতে চান—এমন প্রশ্নে সৌম্য প্রথমে বলেন, ‘লক্ষ্য ঠিক করিনি, এক্সপ্লোর করছি।’ পরে বলেন, ‘বিশেষ করে ডেভেলপমেন্ট সাইটে এক্সপ্লোরের চেষ্টা করছি। তবে এ লাইনেই থাকতে চাই।’</p> <p>অনেকের লক্ষ্য থাকে বিশ্বের টেক জায়ান্ট কম্পানিতে ক্যারিয়ার গড়ার। এমন কোনো পরিকল্পনা আছে কি না এমন প্রশ্নে জানালেন, ‘কোনো টেক জায়ান্টে চাকরি করার আগ্রহ নেই। বরং নিজে কিছু একটা করতে চাই।’ এসবের বাইরে ক্রিকেট আর ঘোরাঘুরিতে আগ্রহ সৌম্যর। সময় পেলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে ও ঘুরতে বের হন তিনি।</p> <p><strong>নতুনদের জন্য পরামর্শ</strong></p> <p>কোনো একটা প্রোগ্রাম ল্যাংগুয়েজ শিখতে হবে প্রথমে। তারপর অনলাইন জাজগুলোতে অনুশীলন শুরু করতে হবে। সি++ শিখলে ভালো হয়। ‘toph’, ‘codeforces’-এর মতো অনেক জাজ আছে অনলাইনে। এসব নিয়মিত অনুশীলন চালিয়ে যেতে হবে—সেটাই শেষ কথা।</p> <p><strong>দীর্ঘ চেষ্টার পর এলো স্বর্ণপদক</strong></p> <p>বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে (আইওআই)  অংশগ্রহণ করে ২০০৪ সালে। তবে এ প্রতিযোগিতায় চাইলে প্রথমেই অংশ নেওয়া যায় না। প্রথমে অংশ নিতে হয় পর্যবেক্ষক হিসেবে। সেবার পর্যবেক্ষক হিসেবে অংশ নেন বুয়েটের অধ্যাপক কায়কোবাদ। অনেক ক্ষেত্রে বেশ কয়েক বছর লেগে গেলেও বাংলাদেশকে পরের বছরই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে ২০০৫ সালে পোলিশ ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায় প্রথমবার বাংলাদেশ অংশ নিতে পরেনি। এর পরের বছর থেকে নিয়মিত দল পাঠাতে শুরু করে। তবে সব সময় চারজনের পূর্ণ দল পাঠানো সম্ভব হয়নি। ২০০৯ সালে একমাত্র প্রতিযোগী হিসেবে অংশ নিয়ে আবির অসাধারণ সাফল্য দেখান। বাংলাদেশ এ প্রতিযোগিতায় প্রথম পদক হিসেবে সরাসরি রৌপ্য পদক জেতে। তাতে আইওআইয়ের সার্বিক পদক তালিকায় বাংলাদেশ ব্রোঞ্জ নয়, রৌপ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে।</p> <p>২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ নিয়মিত চারজনের দল পাঠাতে শুরু করে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সাফল্য বলতে ছয়টি পদক ছিল। এর মধ্যে আবিরের অর্জন একমাত্র রৌপ্য ছাড়া বাকি পাঁচটি পদকই ব্রোঞ্জ। ২০১৬-১৭ থেকে বাংলাদেশে ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডের কার্যক্রম অধ্যাপক কায়কোবাদের নেতৃত্বে আরো কার্যকর করা হয়। এরপর ২০১৮ সালের একটি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জ পদকের কথা বাদ দিলে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর বাংলাদেশ কমপক্ষে তিনটি পদক জিতে আসছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্জিত পদকের সংখ্যা ৩২টি। এর মধ্যে রৌপ্যপদক ছয়টি, ব্রোঞ্জ ২৪টি এবং অনারেবল মেনশন একটি।</p>