<p>১ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ইরানের হামলা মধ্যপ্রাচ্যের সংকটকে ঘনীভূত করেছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে করা যেতে পারে, ইসরায়েল যেন এমন একটি সুযোগ খুঁজছিল, যার মধ্য দিয়ে তারা এই যুদ্ধকে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে। এমন ধারণা যদি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে এটিও মন্তব্য করা অত্যুক্তি হবে না যে এই গোটা বিষয়টি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের ছক, যার মধ্য দিয়ে তারা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের দীর্ঘদিনের পথের কাঁটা ইরানকে শায়েস্তা করতে পারে। ইসরায়েল যত জলদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি সহানুভূতি অর্জন করতে পেরেছে, বলার অপেক্ষা রাখে না এমনটা যদি গাজায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও ঘটত, তাহলে এত দিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যে এমন বিভীষিকাময় পরিস্থিতি আমাদের দেখতে হতো না।</p> <p>ইসরায়েলের ভূমিতে গত ১ অক্টোবর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোর ত্বরিত তৎপরতা এত দিন ধরে গাজায় চলে আসা গণহত্যাকে বৈধতা দেওয়ার প্রয়াস ভিন্ন আর কিছুই নয়। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে নতুন করে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার পক্ষে ওকালতি করে তাদের রক্ষায় সর্বাত্মক সহায়তার জন্য নতুন করে সেনা মোতায়েনসহ সব ধরনের সহযোগিতার কথা জানিয়েছে।</p> <p>ইসরায়েলের পক্ষ থেকে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘ইরান এর মধ্য দিয়ে এক বড় ভুল করেছে, এর জন্য তাদের কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে।’ তিনি স্পষ্ট বার্তা দিয়ে জানিয়েছেন, ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অপরাপর ইসরায়েলবিরোধীদের প্রতিহত করতে তারা ব্যাপক আক্রমণ শুরু করতে যাচ্ছে। যে পশ্চিমা সম্প্রদায় ইসরায়েলের দখলদার বাহিনী কর্তৃক হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি হত্যাকাণ্ড এবং পুরো গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ সাধনের বিরুদ্ধে তাদের পাশে এসে দাঁড়ানো দূরে থাক, একটি যুদ্ধবিরতি পর্যন্ত কার্যকর করতে পারল না, সেখানে ইসরায়েলের ভূমিতে ইরানের হামলার বিরুদ্ধে তারা ভীষণভাবে সোচ্চার হয়েছে।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কানাডা, ফ্রান্স—প্রতিটি দেশই এই অবস্থায় ইসরায়েলের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। গত মার্চ মাসে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি সর্বসম্মত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাসের পরও যখন ইসরায়েল এটিকে অমান্য করে গাজায় হামলা চালিয়ে যায়, পরবর্তী সময়ে এটিকে আরো বিস্তৃত করে লেবাননে হামলার ঘোষণা দেয়, হামাসের শীর্ষ নেতা ইসমাইল হানিয়াকে ইরানের ভেতর আক্রমণ করে হত্যা করে, লেবাননে পূর্বঘোষণা বাস্তবায়ন করতে হামলা শুরু করে এবং এই হামলার শুরুতেই হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করে—এর কোনোটিতেই পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে কোনো রকম উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়নি, বরং কাতারের রাজধানী দোহায় লোক-দেখানো যুদ্ধবিরতি আলোচনাকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। একটিবারের জন্যও এ কথা বলা হয়নি যে যুদ্ধবিরতি আলোচনাকালে নতুন লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলের আক্রমণের পরিকল্পনা এটিকে আরো দুরূহ করে তুলবে।</p> <p>মাঝের কিছুটা সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ব্যক্তিগতভাবে গাজায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার জন্য ইসরায়েলকে চাপে রাখলেও এবং একটি পর্যায়ে এসে ইসরায়েলের জন্য নতুন অস্ত্রের চালান বন্ধ করলেও কিছুদিনের ব্যবধানে তাঁরা ইসরায়েলে তাঁদের সমর্থন অব্যাহত রাখা শুরু করেন। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট অনুমান করা যায় যে এখানে গাজায় হামাস, লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে নয়, ইসরায়েল স্পষ্টভাবেই এই যুদ্ধটি পরিচালনা করে আসছে ইরানের বিপক্ষে, তাদের সমর্থিত বাহিনীগুলোকে ধ্বংস করার জন্য। আর এ ক্ষেত্রে যেকোনো ছুতায় যদি ইরানে কার্যকর হামলা পরিচালনার মতো একটি ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে হামাস, হিজবুল্লাহ বা হুতিদের নিয়ে নতুন করে আর শঙ্কার পরিবেশ তৈরি হবে না। সে বিবেচনায় এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাঝের সময়টিতে যুদ্ধবিরতি কার্যকর নিয়ে যে প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছিল, সেটি স্রেফ লোক-দেখানো বৈ কিছু নয়। বিগত বছরগুলোতে ইরানের মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্যকে খর্ব করতে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একত্রে কাজ করছে।</p> <p>কয়েক বছর আগে ইরানের রিপাবলিকান গার্ড কোরের প্রধান কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা যেমন মার্কিন পরিকল্পনার অংশ ছিল, একইভাবে বছরের পর বছর ধরে ইরানের মাটিতে ইসরায়েলের গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইসলামী নেতা, বিজ্ঞানী এবং সর্বশেষ ইসমাইল হানিয়া ও হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করা—এসব কিছু নিরাপত্তা পরিষদের যুদ্ধবিরতির তোয়াক্কা না করেও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে মার্কিন স্বার্থের পক্ষে কাজের প্রমাণ দেয়, যার সর্বশেষ বিষয়টি হচ্ছে ইরানকে বাধ্য করা, যার মধ্য দিয়ে তারা মধ্যপ্রাচ্যে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের সূচনা করতে পারে। অথচ অবাক করার বিষয় হলো লেবাননে নিজ থেকে হামলা শুরু, এর পরপরই সিরিয়া ও ইয়েমেনে যুগপত্ভাবে হুতিদের বিপক্ষে হামলা এবং এর মধ্য দিয়ে নতুন করে বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা—এসব কোনো কিছুর বিপক্ষেই আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি! অবাক তো হতেই হয়!</p> <p>জাতিসংঘকেও একহাত নিয়েছেন ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে ইসরায়েলে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর অপরাধ, তিনি গত বছর ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণ এবং ইরানের পক্ষ থেকে ইসরায়েলে হামলার বিষয়ে নিন্দা জানাননি, যদিও বিষয়টি সঠিক নয়। মহাসচিব গুতেরেস বরাবরই মধ্যপ্রাচ্যের সংকট নিরসনে কার্যকর আলোচনা ও যুদ্ধবিরতিকে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন এবং ইসরায়েল ও গাজায় বেসামরিক মানুষকে হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন। গুতেরেস ইসরায়েলের কাছে আরো অপরাধী। কারণ তিনি ইরানের পক্ষ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যে বিস্তৃত পরিসরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়াকে প্রতিহত করতে যুদ্ধবিরতির আহবান জানিয়েছেন।</p> <p>গাজায় চলমান যুদ্ধের মধ্যে লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে আক্রমণকে তিনি উসকানির পর উসকানি বলে মন্তব্য করেছেন। এসব কিছুই ইসরায়েল এবং পশ্চিমা কারো পছন্দ হওয়ার কথা নয়। কারণ তারা জাতিসংঘের কাছ থেকে একপেশে আচরণ পেতে আগ্রহী। গুতেরেস স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন, ‘এটি স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ যে হামাসের হামলা হঠাৎ করে হয়নি। ৫৬ বছর ধরে ফিলিস্তিনের মানুষ দম বন্ধ হওয়ার মতো একটি দখলদারিতে রয়েছে।’ সব কিছু মিলিয়ে জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবেরও যেখানে মান্যতা দেখা গেল না, সেখানে ইরানের ওপর নতুন করে তাদের নিন্দা প্রস্তাব পাসের মধ্য দিয়ে ইসরায়েলকে এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার এক ধরনের আইনি ভিত্তি তৈরি করে দিল।</p> <p>নতুন এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল তাদের বর্তমান যুদ্ধকে আরো বিস্তৃত করে ইরান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার এক সুযোগ রচনা করল বলে ধারণা করা যায়। এর মধ্য দিয়ে তারা পরিকল্পিতভাবে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে হামলা চালাতে চেষ্টা করবে। ইরানের পক্ষ থেকে গত এপ্রিল মাসে দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে হামলার জবাবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল প্রতীকী জবাব দিলেও এবারের জবাবটি তারা দিতে চাইছে আঘাতের বিপক্ষে আরো কঠোর পাল্টা আঘাত করে। সে জন্য তারা এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সমর্থন পেয়ে গেছে।</p> <p>ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট বলেছেন, ‘এ অঞ্চলের চেহারা বদলে দেওয়ার এটি গত ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সুযোগ। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করতে আমাদের এখনই নেমে পড়া উচিত, সেই সঙ্গে তাদের শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রগুলোও।’ তাঁর এ কথার সঙ্গে বেনয়ামিন নেতানিয়াহুর কথার মিল পাওয়া যায়। ইসরায়েল মনে করছে, হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়া ও হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তারা প্রথমে হামাস এবং পরে হিজবুল্লাহকে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পেরেছে। তাই এখন কালক্ষেপণ না করে তারা নতুন করে পাল্টা আঘাত হানার চেষ্টা করবে।</p> <p>এই সংঘাতে চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা কী হবে তার ওপর এর পরিণতি নির্ভর করছে অনেকটা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের মতো দেশের সমর্থন এখন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেই। সেই সঙ্গে ইরানের সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার দীর্ঘ সময়ের সখ্য রয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে হামাস ও হিজবুল্লাহর যুদ্ধ যদি এখন ইরানের সঙ্গে বিস্তৃত হয় এবং এতে যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকে, সে ক্ষেত্রে রাশিয়া ও চীনের মৌনতা ভঙ্গ হতে পারে, যার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে তাদের কৌশলগত স্বার্থের প্রয়োজনে তারা নিশ্চুপ থাকবে না।</p> <p>ইরানের অস্ত্রভাণ্ডার, মিসাইল গাইডেড সিস্টেম এবং ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা চীন ও রাশিয়া দ্বারা সমর্থিত। গত এপ্রিল মাসে ইসরায়েলে ড্রোন হামলায় তারা এর ব্যবহার করেছিল। তা ছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা নির্ধারণে এ মাসেই রাশিয়ায় অনুষ্ঠেয় ব্রিকসের বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। সুতরাং এ কথা ভাবার কারণ নেই যে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সেনা মোতায়েন এবং ইসরায়েলের তরফ থেকে প্রতিশোধের নামে ইরানে আক্রমণের মধ্য দিয়ে বিষয়টি চটজলদি একতরফা সমাধানের দিকে যাবে; বরং এটি আরো প্রলম্বিত এবং বিস্তৃত যুদ্ধে পরিণত হতে যাচ্ছে।</p> <p><em>লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়</em></p> <p><em>mfulka@yahoo.com </em></p>