<p>সমালোচনার মুখে ভ্যাট আদায়ের কাজ দেওয়া হয়েছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেনেক্স ইনফোসিসকে। কিন্তু শর্ত না মেনে রীতিমতো প্রতারণা করে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি। কথা দিয়ে কথা রাখছে না। এতে ভ্যাট আদায় ব্যাহত হচ্ছে এবং ভ্যাট সেবার গুণগত মান খারাপ হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের ‘ম্যানেজ’ করে কাজ বাগিয়ে নেওয়া প্রতিষ্ঠান জেনেক্স এখন এনবিআরের প্রশ্নের মুখে। এরই মধ্যে শর্ত ভঙ্গের দায়ে কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়া হয়েছে। পরের ধাপে শাস্তির মুখে পড়তে পারে প্রথমবারের মতো বেসরকারি খাতে ভ্যাট আদায়ের কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানটি।</p> <p>সরকারের রাজস্ব আদায় একটি সংবেদনশীল কাজ। এ কাজে সাধারণত বেসরকারি খাতকে যুক্ত করা হয় না। তবে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী সরকারের সময় একটি চক্র বিশেষ সুবিধা পাওয়ার আশায় বেসরকারি খাতের জেনেক্স ইনফোসিসকে ভ্যাট আদায় বাড়াতে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বাস্তবায়নে চুক্তি করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কথা ছিল আইসিনো করপোরেশনের কাছ থেকে ইএফডি/এসডিসি মেশিন আমদানি করা হবে। অথচ প্রতিষ্ঠানটি ভিন্ন উৎস থেকে আমদানি করে তা স্থাপন করেছে। জেনেক্স ১৫ হাজার ৬০০টি ডিভাইস আমদানি করে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বসানো হয়েছে। মেশিনে দুই বছরের তথ্য সংরক্ষণের ক্ষমতা, ডিজিটাল সার্টিফিকেট ফিচার, ফাইভজি নেটওয়ার্ক সিম, এসডিসি স্ট্যাটাস ডিসপ্লে মডেল, করদাতার তথ্যসহ বিভিন্ন ফিচার থাকার কথা থাকলেও তা করা হয়নি।</p> <p>জেনেক্সের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনায় এনবিআর দুটি কমিটি গঠন করে। সিস্টেমের উপাত্ত, সংশ্লিষ্ট কমিশনারেট থেকে প্রদত্ত তথ্য ও জেনেক্সের দেওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দুই কমিটিই মনে করে, এনবিআরের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি ও চুক্তির পরিশিষ্টে বর্ণিত শর্তের লঙ্ঘন হয়েছে।</p> <p>কমিটির প্রতিবেদন আমলে নিয়ে জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠান এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। আগামী ২৮ কার্যদিবসের মধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ও দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জবাব পাওয়া না গেলে বিবেচনা করা হবে প্রতিষ্ঠানের কোনো বক্তব্য নেই এবং রক্ষিত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।</p> <p>চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন হওয়ার বিস্তারিত উল্লেখ করে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। নোটিশে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৩ নভেম্বর চুক্তির এক বছর পূর্তি হওয়ায় ২০ হাজার ইএফডি মেশিন বসানোর কথা ছিল। পরে সমন্বয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একইসংখ্যক মেশিন বসানোর জন্য ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। তবে বাস্তবে তিনটি জোনে জেনেক্স মেশিন বসাতে পেরেছে ১৫ হাজার ৯৯৫টি। এর মধ্যে ১২ হাজার ডিভাইস প্রকৃতভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে স্থাপন করা হয়েছে।</p> <p>ডিভাইসে বিভিন্ন ধরনের উন্নতমানের ফিচার থাকার কথা ছিল। তবে বাস্তবে তার কিছুই পায়নি টেকনিক্যাল কমিটি। মেশিনে দুই বছরের তথ্য সংরক্ষণের সক্ষমতাসম্পন্ন ফিসক্যাল মেমরি, ডিভাইসে ট্রানজেকশন ডাটাসংবলিত ডিজিটাল সার্টিফিকেট ফিচার, ফাইভজি নেটওয়ার্ক সিম, এসডিসি স্ট্যাটাস ডিসপ্লে মডেল এবং করদাতার তথ্যসহ ফিচার থাকার শর্ত ছিল। কিন্তু টেকনিক্যাল কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থাপিত ইএফডি/এসডিসি মেশিনে এই ফিচারগুলো পাওয়া যায়নি।</p> <p>এমন আরো গুরুতর অভিযোগ থাকার পরও চলতি বছরের ১৩ আগস্ট অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে পাঠানো চিঠিতে এনবিআর কর্মকর্তাদের অসহযোগিতা, বিল বুঝে না পাওয়া, মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ব্যাংকের ঋণপত্র (এলসি) খোলায় জটিলতার অজুহাত দেখিয়েছিল জেনেক্স। এ ছাড়া ইএফডি মেশিন আমদানিতে শুল্ক মওকুফ সুবিধা ও প্রযুক্তিগত জটিলতার দোহাই দিয়ে একক এখতিয়ার চাওয়ার পাশাপাশি সরকারি দুই টিম বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।</p> <p>২০২২ সালের নভেম্বরে দরপত্রের মাধ্যমে ইএফডি প্রকল্পের জন্য মনোনীত হয় জেনেক্স। খুচরা পর্যায়ের ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যে আগামী পাঁচ বছরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিন লাখ ইএফডি ও এসডিসি (সেলস ডাটা কন্ট্রোলার) ডিভাইস স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পায় জেনেক্স।</p> <p>ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেও জেনেক্স ইনফোসিসের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে আপত্তি ছিল। তাঁরা জানিয়েছিলেন, শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি না করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করলে এনবিআর উপকৃত হতো। একটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেলে সেখানে কোনো জবাবদিহি থাকে না এবং স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ থাকে। এ ছাড়া চুক্তির প্রক্রিয়া নিয়েও কথা বলেছেন অনেকে।</p> <p>ইএফডি মেশিনের মাধ্যমে ভ্যাট আদায়ের দায়িত্ব পাওয়ার আগে থেকেই ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে জেনেক্স ইনফোসিস। প্রতিষ্ঠানটির ভ্যাট ফাঁকির পাশাপাশি জেনেক্সের চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা দিয়েছেন আয়কর ফাঁকি। শেয়ারবাজারে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করলেও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমাম ও পরিচালকরা আয়কর রিটার্নে সেই তথ্য উল্লেখ করতেন না। এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) এসংক্রান্ত জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে।</p> <p> </p> <p> </p>