<p>দামেস্কের মুজতাহিদ হাসপাতাল, সেখানে বেসমেন্টের সবচেয়ে দূরের একটি কক্ষের মেঝেতে বসে আছেন দুর্বল এক যুবক। কক্ষটির ভেতরে আসা-যাওয়ার সময় কাঁপা হাতে স্বজনহারা মানুষটি তার মুখ চেপে ধরেছে। মানুষ তার কাছে আসছে তাদের হারিয়ে যাওয়া আত্মীয় মনে করে। কিন্তু আসাদের কারাগারে অত্যাচারে তার আর কিছুই মনে নেই, হারিয়ে ফেলেছেন স্মৃতিশক্তি। ডাকলে শুধু শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। </p> <p>হাসপাতালের অভ্যর্থনা ডেস্কে থাকা একজন তরুণ ডাক্তার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, এই যুবক কাউকে চিনতে পারছেন না। তিনি কেবল তার নামটা মনে রেখেছেন, কিন্তু কখনও কখনও ভুল নামও বলছেন। হতে পারে কারাগারে যাদের সঙ্গে বন্দি ছিলেন, তাদের কারো নাম। </p> <p>হাসপাতাদের কর্মীরা বলছেন, এই যুবক সিরিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদের শাসনের সবচেয়ে নৃশংস এবং কুখ্যাত কারাগার সায়দনায়ায় আটক ছিলেন। সেখানে বন্দিদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হতো। ডাক্তারের মতে, তিনি এমন অনেকের মধ্যে একজন যারা নিজেদের পরিচয় ভুলে যাওয়ার মতো নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। </p> <p>কর্মীরা আরো জানিয়েছেন, কখনও কখনও পরিবারগুলো এসে একজন বন্দিকে নিজেদের পরিবারের সদস্য হিসেবে দাবি করছে। আবার কখনও কখনও ১০ জন ভিন্ন ব্যক্তি একই রোগীকে তাদের আত্মীয় বা তাদের ছেলে হিসেবে দাবি করছেন। অনেকে নিজেদের আত্মীয় বলে ভুল করছেন, কারণ দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার পরে বন্দিদের চেহারার পরিবর্তিত হয়েছে। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।</p> <p>পরিবারগুলো বন্দিদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার পরে আবিষ্কার করছে, তারা যে ব্যক্তিকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে সে তাদের আত্মীয় নয়। আবার হাসপাতালে ফিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন এই আশায় যে, মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিরা তাদের প্রকৃত পরিবার খুঁজে পাবে। তবে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের ওপর এর কেমন প্রভাব পড়ছে তা বলা কঠিন।</p> <p>হাসপাতালের ওই কক্ষে থাকা যুবকটির নড়াচড়া মৃদু এবং ধীর। তিনি হিংসাত্মক বা আক্রমণাত্মক কোনো আচরণ দেখাননি। দর্শনার্থী বা হাসপাতালের কর্মীরা তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও বেশিরভাগ  সময়ই তিনি সাড়া দেন না। মাঝে মাঝে এক কথায় উত্তর দেন। কখনও কখনও তিনি আকাশের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকন যেনো তিনি দিবাস্বপ্ন দেখছেন। বেশিরভাগ সময় তিনি তার দুই হাতের ভাঁজে মাথা গুঁজে রাখেন।</p> <p><strong>‘অত্যাচারে নিহত’</strong></p> <p>বাশার আল-আসাদ যখন গত ৮ ডিসেম্বরের প্রথম দিকে সিরিয়া থেকে মস্কোতে পালিয়ে যান, তখন দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাইরের লাখ লাখ সিরীয়দের কাছ আনন্দ এবং স্বস্তির বর্ষণ হতে শুরু করে। কিন্তু অনেকের কাছেই সেই আনন্দ বেদনায় রূপ নেয়। আসাদ সরকারের অধীনে যারা তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন তাদের সন্ধান পাননি। আল-আসাদ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তাদের হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের সম্পর্কে উত্তর খুঁজতে শুরু করেছে। </p> <p>সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস অনুসারে, আসাদ সরকার ২০১১ সালের মার্চ থেকে অন্তত এক লাখ ৩৬ হাজার মানুষকে আটক বা জোরপূর্বক গুম করেছে। তাদের মধ্যে প্রায় ৩১ হাজার কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন, অর্থাৎ এক লাখ পাঁচ হাজার মানুষ এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। আসাদের পতনের পর দামেস্কের উপকণ্ঠসহ সারা দেশে গণকবরগুলো উন্মোচিত হয়েছে এবং এ নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। কিন্তু  সবচেয়ে নির্মম বিষয় হলো, এই গণকবরে করা আছেন তাদের খুঁজে বের করা।</p> <p>আল-আসাদের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ পরে ১৪ ডিসেম্বর সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস-এর নির্বাহী পরিচালক ফাদেল আবদুলঘানি আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘আমি শতভাগ নিশ্চিত গণকবরে থাকা মানুষগুলোর বেশিরভাগই নির্যাতনের কারণে দুঃখজনকভাবে মারা গিয়েছিলেন।’ </p> <p>বিরোধী বাহিনী আলেপ্পো, হামা, হোমস এবং অবশেষে দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কুখ্যাত কারাগারের দরজাগুলো খুলে দেয় এবং বন্দিদের মুক্ত করে। গত ৯ ডিসেম্বর সায়দনায়ার কারাগারে যোদ্ধাদের বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার দুই দিনেরও কম সময়ের মধ্যে হাজার হাজার সিরিয়ান কারাগারে নিখোঁজ হওয়া প্রিয়জনদের খোঁজে তল্লাশি চালিয়েছে। </p> <p>ফোনের টর্চ দিয়ে কারাগারের লুকানো অংশগুলোতে অনুসন্ধান চালিয়েছে। দেয়াল বা মেঝেতে হাতুড়ি মেরে বা কাঠামোর ফাঁক স্থানে প্রিয়জনের খোঁজ করেছে। সিরিয়ার হোয়াইট হেলমেট, সিভিল ডিফেন্স অনেক বন্দীদের সন্ধান পেয়ে তাদের মুক্ত করে। সিরিয়ার অনেকেই দেশের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গোপন কারাগারের কথা বলেছিলেন, যদিও সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি।</p> <p><strong>‘হৃদয়ে ব্যাথা’</strong></p> <p>এখনও অনেক লোক নিখোঁজ থাকায় সামনের কাজটি বিশাল। অন্যান্য দেশ অতীতে প্রচুর নিখোঁজদের মোকাবিলা করেছে, বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা এবং কলম্বিয়া। তারপরও সিরিয়ায় জোরপূর্বক গুম হওয়ার হার তাদের চেয়ে বেশি বলে জানান আব্দুলঘানি।</p> <p>তিনি বলেন, ‘আমাদের আন্তর্জাতিক এবং জাতিসংঘের সহায়তা প্রয়োজন। তবে নেতৃত্ব অবশ্যই সিরিয়ার হতে হবে, বিশেষ করে সিরিয়ার সমাজে যারা অভিজ্ঞ এবং বিশ্বস্ত।’ ইতিমধ্যে সিরিয়ার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা যা করতে পারে তা করছে।</p> <p>মুজতাহিদ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে কাজ করেন নায়েফ হাসান। তিনি বলেছেন, তাদের কাছে আসা মৃতদেহগুলো হাতে লেখা রেকর্ড রাখেন এবং ফোনে অন্যান্য হাসপাতাল ও কেন্দ্রের সঙ্গে সমন্বয় করেন। তিনি বলেছেন, ‘২০ বছর ধরে ফরেনসিক বিভাগে কাজ করার পরেও তিনি হতবাক। মৃতদেহগুলোর ভয়ংকর অবস্থা, শরীর পোড়া, নির্যাতনের চিহ্ন বা বুলেটের ক্ষত।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘এ দৃশ্য হৃদয়ে চরমভাবে আঘাত করেছে। আমরা এখানে যা দেখেছি তা আপনি বর্ণনা করতে পারবেন না, নির্যাতন এবং মৃত্যুদণ্ডের মধ্যে... আমরা যা দেখেছি... এটি এমন কিছু যা আমরা আগে কখনও দেখিনি।’ </p> <p>হাসপাতালের মর্গের রেফ্রিজারেটরে আলজাজিরা ১৪টি মৃতদেহের কথা জানতে পারে যাদের পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। সাদা কাফনে জড়ানো তাদের উন্মুক্ত মুখগুলো নির্যাতনের কারণে বিকৃত হয়ে গেছে। হাসান বলেন, প্রতিদিন হাজার হাজার পরিবার আসে। তারা মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে দেখছে তাদের নিখোঁজ স্বজন আছে কি না।</p> <p>হাসপাতালের বেসমেন্টে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলা সেই দুর্বল যুবকটি তার ঘরে চুপচাপ বসে কাঁপছে। এর মধ্যেই দুজন নারী এসে চিৎকার শুরু করেন এবং চারপাশে তাকিয়ে একজন নার্সের সন্ধান শুরু করেন। একজন চিৎকার করে বলছেন, ‘আমাকে ওর বুক দেখান, অনুগ্রহ করে আমাকে ওর বুক দেখান। আমার নিখোঁজ ছেলের বুকে একবার অস্ত্রোপচার হয়েছিল, তার বুকে দাগ আছে।’ ওই নারী দাগ দেখে তার নিখোঁজ ছেলেকে খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। </p> <p>এরপর তাদের পেছন দিক থেকে আরেকজন যুবক আসলেন এবং অত্যাচারের শিকার যুবককে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন। সাবধানে তিনি তার শার্টটি তুলে ধরলেন। কিন্তু হতাশ মা বুঝতে পারেন এটা তার ছেলে নয়, এরপর তিনি নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলা ছেলেটির বুকে অস্ত্রোপচারের কোনো দাগ ছিল না।</p> <p>সূত্র : আলজাজিরা।</p>