<p style="text-align:justify">সাধারণ মানুষ জীবনভর কষ্ট করে অসাধ্য সাধন করে সাফল্য পেলেও ব্যতিক্রম সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। মন্ত্রী হওয়ার পরই এলাকার মানুষের কাছে তিনি রীতিমতো দানব হয়ে ওঠেন। স্থানীয় জনগণের সেবক না হয়ে তাদের শত শত পুকুর-জলাশয় দখল করে বীরদর্পে রাজত্ব করেছেন নিজ নির্বাচনী এলাকায়। বাপের দেওয়া ক্ষুদ্র চালের ব্যবসাকে ক্ষমতার বলয়ে নিয়ে তৈরি করেছেন চালের বড় সিন্ডিকেট, এলাকার সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আর চাকরিপ্রার্থীদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে নিয়ন্ত্রণ করেছেন কমিশন বাণিজ্য।</p> <div class="d-flex justify-content-center"> <div class="col-12 col-md-10 position-relative"><strong>আরো পড়ুন</strong> <div class="card"> <div class="row"> <div class="col-4 col-md-3"><img alt="৪৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশে প্রশিক্ষণ, কাজে লাগেনি কিছুই!" height="66" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/2024/09/27/1727405142-5ac0ae7eb672fec879ef902ee426f679.jpg" width="100" /></div> <div class="col-8 col-md-9"> <p>৪৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশে প্রশিক্ষণ, কাজে লাগেনি কিছুই!</p> </div> </div> </div> <a class="stretched-link" href="https://www.kalerkantho.com/online/national/2024/09/27/1429393" target="_blank"> </a></div> </div> <p style="text-align:justify">নওগাঁয় তাঁর নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষ লাপাত্তা সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারকে এভাবেই চেনে। এখনো তারা তাঁর নাম শুনলেই আতঙ্কে আঁতকে ওঠে। জেলার নিয়ামতপুর-পোরশা-সাপাহারের বিভিন্ন জনপদে ঘুরে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।</p> <p style="text-align:justify"><img alt="পুকুর দখল, চাল সিন্ডিকেট ও কমিশনকাণ্ডের দানব" height="302" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/09.September/27-09-2024/12312/90------.jpg" style="float:left" width="341" />মূলত আওয়ামী লীগের প্রয়াত প্রবীণ নেতা ও দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের হাত ধরে রাজনীতিতে উঠে আসেন সাধন চন্দ্র মজুমদার।</p> <p style="text-align:justify">টানা চারবার তিনি হয়েছেন এমপি। আর এ সময়ে তিনি ক্ষমতাকে ‘সব কিছু তুচ্ছ’ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে হয়ে ওঠেন রাঘব বোয়াল। ভাতিজা রাজেশ মজুমদার, ছোট ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনা, ছোট মেয়ে তৃণা মজুমদার এবং দুই জামাতা আবু নাসের বেগ ও নাসিম আহম্মেদকে নিয়ে গড়ে তোলেন ফ্যামিলি সিন্ডিকেট। নানা অপকর্মের নজিরবিহীন ওই সিন্ডিকেটে নজরানা না দিয়ে কেউ কোনো সেবাই পেত না।</p> <p style="text-align:justify">ফ্যামিলি সিন্ডিকেটের সদস্য মন্ত্রীর একান্ত সচিব সাধন চন্দ্রের বড় জামাতা আবু নাসের বেগ (মাগুরার সাবেক ডিসি) এবং মন্ত্রীর এপিএসের দায়িত্বে থাকা ছোট মেয়ে তৃণা মজুমদার। সাড়ে পাঁচ বছরে তাঁরা  টাকার বিনিময়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন দপ্তরের যেকোনো প্রমোশন, পদায়ন, বদলি, বরাদ্দসহ যাবতীয় কার্য সাধন করতেন।</p> <p style="text-align:justify">বিভিন্ন সূত্র জানায়, আর্থিক অপকর্মগুলো হতো বেইলি রোডের মন্ত্রীর সরকারি বাসভবন থেকে। মন্ত্রী এলাকায় গেলে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে আসতেন খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কর্মচারীরাও। তখন গাড়ির লাইন পড়ত মন্ত্রীর বাসা থেকে সড়ক পর্যন্ত।</p> <p style="text-align:justify">অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতি প্রমোশন পদায়নের জন্য ৩০ লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত নেওয়া হতো। লোভনীয় পদের মধ্যে ছিল আরসি ফুড (রিজিয়নাল কন্ট্রোলার অব ফুড), ডিসি ফুড (ডিস্ট্রিক্ট কন্ট্রোলার) ও ওসিএলএসডি। এ ছাড়া যেসব জেলায় ধান-চাল বেশি উৎপন্ন হয়, সরকারি ক্রয় বরাদ্দ বেশি থাকত সেসব জেলায় পদায়নের জন্য পৃথক অঙ্কের টাকা নেওয়া হতো। সাবেক এই মন্ত্রীকে নিয়ে এমন অভিযোগ সবার মুখে মুখে। স্থানীয় লোকজন জানায়, স্কুল ম্যানেজিং কমিটি, ধর্মীয় উপাসনালয়, জমি দখল, সরকারি নির্মাণকাজ, রাস্তাঘাট উন্নয়ন ছাড়াও নিয়োগ, বিচার সালিস, নেতৃত্ব গঠনসহ সবখানেই তাঁর অনুমতি ও কৃপা ছাড়া কিছু হতো না।</p> <p style="text-align:justify"><strong>শত শত বিল-পুকুর দখলে সাধন :</strong></p> <p style="text-align:justify">সাধন চন্দ্রের নির্বাচনী এলাকায় নিয়ামতপুর-পোরশা-সাপাহারে শত শত পুকুর, বড় বড় জলাশয়, বিল দখলে নিয়ে মাছ চাষ ছিল সিন্ডিকেটের আয়ের বড় উৎস। এলাকার সহস্রাধিক জলাশয়ই ছিল মন্ত্রীর ফ্যামিলি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। পোরশা ঘাটনগর বাজারের মিজানুর রহমান বলেন, ‘নোসনাহার পুকুর, ছয়ঘাটি পুকুর, পাহাড়িয়া পুকুরসহ অনেক পুকুর মন্ত্রীর ভাই মনা মজুমদার জোরপূর্বক দখল করে সরকারকে রাজস্ব না দিয়ে নিজে মালিক সেজে অন্যকে লিজ দিয়ে অর্থ গ্রহণ করতেন। বর্তমানে মনা মজুমদারের লিজ দেওয়া লোকই পুকুরগুলোয় মাছ চায় করছেন।’</p> <div class="d-flex justify-content-center"> <div class="col-12 col-md-10 position-relative"><strong>আরো পড়ুন</strong> <div class="card"> <div class="row"> <div class="col-4 col-md-3"><img alt="বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর ঠাঁই বাংলাদেশে হবে না : ভারতকে ফখরুল" height="66" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/2024/09/27/1727405802-edc022702d6c43891d7ab264ce6882e9.jpg" width="100" /></div> <div class="col-8 col-md-9"> <p>বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর ঠাঁই বাংলাদেশে হবে না : ভারতকে ফখরুল</p> </div> </div> </div> <a class="stretched-link" href="https://www.kalerkantho.com/online/Politics/2024/09/27/1429394" target="_blank"> </a></div> </div> <p style="text-align:justify">নওগাঁর পোরশা উপজেলার সদর নিতপুরের বাসিন্দা আব্দুল কাদের, ধাওয়াপাড়ার তফসের আলী, সোহাতী গ্রামের কুদ্দুস, সরাইগাছি গ্রামের শাহজাহান মিয়া, কালাইবাড়ীর মোদাচ্ছের আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ক্ষমতায় থাকাকালীন সাধন চন্দ্র পোরশা-সাপাহার ও নিয়ামতপুর এলাকায় সব সরকারি খাস পুকুর তাঁর ভাই মনা মজুমদারকে দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে টেন্ডারের নামে দলীয় লোকজনদের দিয়ে দখল করে রাখতেন। সরকারিভাবে টেন্ডার বা লিজ নিলেও ১৫ বছরে সরকারি কোষাগরে একটি টাকাও জমা দেননি।</p> <p style="text-align:justify">এ ব্যাপারে স্থানীয় ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, যে নামেই সরকারি পুকুর লিজ থাক না কেন সেগুলো খাদ্যমন্ত্রীর ফ্যামিলি সিন্ডিকেটের কাছে ছেড়ে দিতে হতো। ওই তিন উপজেলায় সরকারি এমন অনেক জলাশয় আছে, মন্ত্রীর সিন্ডিকেটের ভয়ে যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে দরপত্র আহ্বান করা হয়নি।</p> <p style="text-align:justify">সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এবং তাঁর ভাই মনোরঞ্জন মজুমদারের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী নিয়ামতপুর উপজেলার হাজিনগর ইউনিয়নের কুশমইল গ্রামের আব্দুল খালেক বলেন, ‘আমি একজন মৎস্য চাষি ও ব্যবসায়ী। আমি আড়তের মাধ্যমে মাছ বিক্রি করে আসছিলাম। এ ছাড়া পুকুরে মাছ চাষও আমার ব্যবসা। কিন্তু সাধন চন্দ্র মজুমদার মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে আমাকেসহ অন্য অনেক ব্যবসায়ীকে হাট থেকে উচ্ছেদ করে দিয়েছে। আমাদের কোনো ব্যবসা করতে দেয়নি। মজুমদার এবং তাঁর ভাই উপজেলার প্রায় সব পুকুর ও দীঘি জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছিল।’</p> <p style="text-align:justify"><strong>চাল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রীর ফ্যামিলি সিন্ডিকেট :</strong></p> <p style="text-align:justify">সরকারি ও বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান এবং নওগাঁর রাজনীতি—সব কিছুই ছিল সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ছোট ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার এবং জামাতা পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহম্মেদের নিয়ন্ত্রণে। দেশের খাদ্যভাণ্ডার বলে পরিচিত নওগাঁয় ধান ও চালের দামের সামান্য হেরফের হলেই প্রভাব পড়ত দেশের চালের বাজারে। নওগাঁ জেলায় তাঁদের নিয়ন্ত্রণে অবৈধভাবে ধান-চাল মজুদ কারবার চলত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মিল মালিক বলেন, ‘ক্ষমতায় থাকাকালে বড় বড় মিল মালিক গোডাউনে হাজার হাজার টন ধান-চাল মজুদ করে রাখতেন। সাধন সিন্ডিকেটসহ তাঁর সান্নিধ্যে অনেক মিল মালিক গত সাড়ে পাঁচ বছরে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এই সিন্ডিকেট চাল বাণিজ্যের কারণে নওগাঁর প্রকৃত চালকল মালিক মন্ত্রীর ওপর ক্ষুব্ধ হলেও প্রকাশ করার সাহস পেতেন না।</p> <p style="text-align:justify">মন্ত্রীর ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনার চালের মিল আছে নিয়ামতপুরে। তবে তা শুধু নামেই মিল। ওই প্রভাব খাটিয়ে নিজেকে চাল ব্যবসায়ী পরিচয় দিতেন তিনি। মিলটি এখনো বন্ধ। তাঁর প্রভাবের কারণে অনেক মিলে চাল মজুদ থাকলেও মজুদবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেনি খাদ্য বিভাগ ও জেলা প্রশাসন। বরং কেউ মজুদের সন্ধান দিলে তার ওপর আসত নানা ধরনের হুমকি-ধমকি। পদায়ন নেওয়া কর্মকর্তারা সরকারি গুদামে মজুদ করা চাল অভিনব উপায়ে জালিয়াতি করে পদায়ন বিনিয়োগ তুলে নিতেন। বিভিন্ন প্রকল্পের নামে ছাড় করা পুরনো চাল ফের গুদামে ঢুকিয়ে বেশি দামে ক্রয় দেখানো হতো।</p> <p style="text-align:justify"><strong>সাধনের রমরমা কমিশন বাণিজ্য :</strong></p> <p style="text-align:justify">উন্নয়নকাজের ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমিশন আগেই গুনতে হতো ঠিকাদারকে। সরকারি রাস্তা উন্নয়ন, পাকাকরণ, সংস্কারসহ সব কাজেই সাধন সিন্ডিকেটকে কমিশন দিতে বাধ্য থাকত ঠিকাদাররা। সর্বশেষ সড়ক ও জনপথ বিভাগ নওগাঁ সদর থেকে আত্রাই, বদলগাছী ও মহাদেবপুর এবং মান্দা থেকে নিয়ামতপুর উপজেলার ছয়টি সড়কে এক হাজার ১২০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ হয়। আঞ্চলিক মহাসড়ক উন্নয়নের এই প্রকল্প থেকে আগাম ২০ শতাংশ টাকা নিয়েছে সাধন ফ্যামিলি সিন্ডিকেট। ভূমি অফিস নির্মাণ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন স্থাপন, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস নির্মাণসহ আরো ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজে কমিশন কামিয়েছে তাঁর সিন্ডিকেট।</p> <p style="text-align:justify">সাপাহার উপজেলার পাতাড়ী গ্রামের আব্দুল মতিন, কলমুডাঙ্গা গ্রামের তরিকুল ইসলাম, গোয়ালার মোজাফফর রহমান, বাহাপুর গ্রামের আয়নাল হক এবং সাপাহার সদরের লুত্ফর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, সাবেক ওই খাদ্যমন্ত্রী দুই উপজেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতেন নিজ দলের লোকজনকে; তা-ও আবার মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। এই অর্থ বাণিজ্য বা লেনদেন করা হতো তৎকালীন মন্ত্রীর কন্যা তৃণা মজুমদারের মাধ্যমে। এলাকার সব টেন্ডার বাণিজ্যে তাঁর ভাগ আদায় করার জন্য তাঁর নির্বাচনী আসনে দলীয় কিছু পছন্দের লোককে নিয়োগ দিয়েছিলেন।</p> <p style="text-align:justify">একাধিক ঠিকাদার জানান, মন্ত্রীর ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনা কমিশনের টাকা নগদ নিতেন। অথবা তাঁর পাঠানো প্রতিনিধি টাকা নিতে আসতেন। ওই তিন উপজেলার সব হাটবাজার নামমাত্র মূল্যে ডেকে নিতেন সাধনের লোকজন। কম দামে জমি কিনে বেশি দামে সরকারের কাছে বিক্রির গভীর কারসাজির কৌশল এঁটেছিলেন তাঁরা।</p>