<p>‘প্রথম দিন আমাকে ছোট এক অন্ধকার কুঠুরিতে নেওয়া হয়েছিল। দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন সেই কুঠুরিতে ছিল না কোনো আলো-বাতাস। আয়নাঘরে কাটানো সেই সময়ের সব ঘটনা থ্রিলার সিনেমাকেও হার মানায়।’</p> <p>গত পাঁচ বছর পর ‘আয়নাঘর’ বলে পরিচিত বন্দিশালা থেকে মুক্তি পেয়ে বন্দিদশায় কাটানো দুঃসময়ের এমন বর্ণনা দেন বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা। শুধু মাইকেল চাকমা নন, গত ১৫ বছরে তাঁর মতো ৬২৯ জন মানুষ গুমের শিকার হন বলে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) তথ্য দিয়েছে। তাদের পরিসংখ্যান বলছে, ৪১৬ জন এখনো নিখোঁজ। নিখোঁজ হওয়ার পর ৭৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ৭৩ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ৬২ জনকে।</p> <p>২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল রাজধানীর শ্যামলী থেকে গুমের শিকার হন মাইকেল চাকমা। দীর্ঘ পাঁচ বছর তিন মাস ২৭ দিন পর মুক্তি পান তিনি। গত ৬ আগস্ট তাঁকে চট্টগ্রামের একটি সড়কের ধারে চোখ বাঁধা অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়।</p> <p><img alt="5" height="300" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/2024/08/30/1724960021-0b2aa4bc12ca5c1bc43c42409be1face.jpg" width="500" /></p> <p>বন্দিদশার দিনগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে মাইকেল চাকমা বলেন, ‘শুরুর দিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু মারধর করা হয়নি। তবে যেভাবে এবং যে পরিবেশে বন্দি করে রাখা হয়, তা অত্যন্ত অমানবিক এবং ভয়ংকর। সেখানে মানুষের বেঁচে থাকা অনেক কঠিন। অনেকটা গুহার মতো জীবন।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘আমাকে এই পাঁচ বছরে আরো চার থেকে পাঁচটি বন্দিশালায় রাখা হয়। এই বন্দিশালাগুলোতে অনেক মানুষ বন্দি ছিলেন। আমার সঙ্গে দুজন বন্দি ছিলেন। একজন রংপুরের সাইদুল, আরেকজন ঢাকার এরশাদ। সেখানে কাউকে দেখার বা কারো সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ছিল না। তবে গোসল করতে নেওয়ার সময় বাথরুমের ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিয়ে অনেককে দেখতে পেয়েছি। তাঁদের কারো চুল পাকা, কারো দাড়ি পাকা। কারো বয়স কম, কারো বেশি।’</p> <p>মাইকেল চাকমাকে নির্যাতন না করা হলেও বন্দিশালায় অন্য বন্দিদের নির্যাতন করা হতো বলে জানান তিনি। বলেন, “আমাকে যে সেলে রাখা হয়েছিল, তার পাশের সেলে জাকির নামের আরেকজন ছিলেন বলে জানতে পারি। জাকিরকে বলতে শুনেছি, ‘আমাকে আজ অনেক মারধর করেছে। ওহ, আর পারছি না! আমার জ্বর উঠে গেছে।’”</p> <p>আসকের তথ্য মতে, এই ৬২৯ জনের মধ্যে ২০০৯ সালে ২১ জন, ২০১০ সালে ৪৭ জন, ২০১১ সালে ৫৯ জন, ২০১২ সালে ৫৬ জন, ২০১৩ সালে ৭২ জন, ২০১৪ সালে ৮৮ জন, ২০১৫ সালে ৫৫ জন, ২০১৬ সালে ৯৭ জন, ২০১৭ সালে ৬০ জন, ২০১৮ সালে ৩৪ জন, ২০১৯ সালে ১৩ জন, ২০২০ সালে ছয়জন, ২০২১ সালে সাতজন, ২০২২ সালে পাঁচজন ও ২০২৩ সালে ৯ জন গুমের শিকার হন।</p> <p><strong>নিখোঁজদের অপেক্ষায় পরিবার</strong></p> <p>গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ‘আয়নাঘর’ থেকে মাইকেল চাকমা ছাড়াও ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাশেম আরমান এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল আমান আজমিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।</p> <p>পরিবারের সদস্যদের দাবি, নিখোঁজ ব্যক্তিদের তথ্য পরিবারের সদস্যদের জানানো হোক। কারা এসব নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা, কয়টি গোপন বন্দিশালা বাংলাদেশে রয়েছে এবং কোন রাষ্ট্রীয় বাহিনী এসব গুমের সঙ্গে জড়িত, তা জানাতে হবে।</p> <p>২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর গুমের শিকার হন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে তাঁর ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকা স্ত্রী নাইস খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার স্বামী স্বর্ণ ব্যবসায়ী। তাঁকে র‌্যাব সদস্যরা তুলে নিয়ে গুম করেন। যেহেতু শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে, তাই আমি বিশ্বাস করি আমি ন্যায়বিচার পাব। স্বামীকে ফিরে পাব।’</p> <p>গুমের এসব ঘটনায় দেশের বিভিন্ন আদালত ও থানায় মামলা করেছেন স্বজনরা। যশোর সদর উপজেলার কিসমত নওয়াপাড়া গ্রামের বিএনপিকর্মী মাসুদকে গুম করার অভিযোগে তাঁর মামা কুদ্দুস আলী মামলা করেছেন। যশোরে রেজোয়ান নামের এক কলেজছাত্রকে অপহরণ ও গুমের অভিযোগে তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তাঁর ভাই রিপন হোসেন।</p> <p>স্বজনদের পাশাপাশি বন্দিশালা থেকে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিরাও আইনগত পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন। মাইকেল চাকমা বলেন, ‘আমার জীবনের পাঁচ বছর যারা শেষ করে দিয়েছে, তাদের বিচার করতে হবে। আমি মনে করি, রাষ্ট্রীয় বাহিনী এর সঙ্গে জড়িত ছিল। কিছুটা সুস্থ হলেই আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি সরকারের কাছে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দাবি করব।’</p> <p>গুমবিষয়ক তদন্ত কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে এ ব্যাপারে বড় ধরনের সমাধান আসবে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষরের যে ঘোষণা আসছে, এটা খুবই একটা ভালো দিক। এটা গুম নিয়ন্ত্রণে একটা বড় ভূমিকা রাখবে। আর যে গুমের ঘটনাগুলো এরই মধ্যে ঘটে গেছে, এসব বিষয়ে কমিশন তৈরি হয়েছে। কমিশন এই গুমগুলোর কারণ নির্ধারণের পর যে সুপারিশ করবে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে গুম বন্ধ করার জন্য যে সুপারিশ আসবে, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যদি সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়, তবে বড় ধরনের সমাধান করা সম্ভব হবে।’</p> <p><strong>পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন</strong></p> <p>২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের আমলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। গত মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।</p> <p>এই কমিশনের সভাপতি হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। কমিশনে সদস্য হিসেবে রয়েছেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস ও মানবাধিকারকর্মী সাজ্জাদ হোসেন।</p> <p>আইন-শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা তথা বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্ট গার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্যের মাধ্যমে জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের জন্য এই তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে।</p> <p>কমিশন আইন-শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, তাঁদের শনাক্ত এবং কোন পরিস্থিতিতে গুম তা নির্ধারণ করবে।  জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনাগুলোর বিবরণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল এবং এ বিষয়ে সুপারিশ করবে।</p> <p><strong>জাতিসংঘের গুমবিষয়ক সনদে বাংলাদেশের স্বাক্ষর</strong></p> <p>জাতিসংঘের গুমবিষয়ক সনদ ‘আন্তর্জাতিক কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিস-অ্যাপিয়ার‌্যান্স’-এ স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের সাপ্তাহিক বৈঠকে এ সনদে সই করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।</p> <p><strong>আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুসারে আইন প্রণয়নের আশ্বাস তারেক রহমানের</strong></p> <p>গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তিনি জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত গুম প্রতিরোধসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন (আইসিপিপিইডি) অনুসারে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের আশ্বাস দিয়েছেন।</p> <p>বাণীতে তারেক রহমান বলেন, ‘গুম মানবতাবিরোধী অপরাধ, যা মৌলিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বাংলাদেশে নজিরবিহীন গুমের ঘটনায় লাখ লাখ দেশবাসীর মতো আমিও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। শেখ হাসিনার দুঃশাসনে গুমকে ব্যবহার করা হয়েছে জনসমাজে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য।’</p>