<p>গত কয়েক দিনে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও হানাহানির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিস্ময় কণ্ঠে তিনি বলেন, চিন্তা করা যায়, ধর্মকে কেন্দ্র করে কী উন্মাদনা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে! ৫ আগস্টের বিপ্লবের তিন মাস না যেতেই আসল চেহারা বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। </p> <p>নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল বুধবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) আয়োজিত এক আলোচনাসভায় তিনি এ কথা বলেন। </p> <p>বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এই কটা দিনে আমরা খুব চিন্তিত, উদ্বিগ্ন, ভয়াবহভাবে উদ্বিগ্ন। আপনি চিন্তা করতে পারেন, ধর্মকে কেন্দ্র করে কী উন্মাদনা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে! আপনি চিন্তা করতে পারেন, যে মুক্ত স্বাধীন মিডিয়ার জন্য আমরা এত দিন লড়াই করলাম, তার অফিস পুড়িয়ে দিচ্ছে! এই বাংলাদেশ তো আমরা দেখতে চাই না, আমি অন্তত চাই না।’</p> <p>বিএনপির মহাসচিব আরো বলেন, ‘আপনাদের সোশ্যাল মিডিয়া আমি দেখি না সহজে। কিন্তু যখন দেখি, আতঙ্কিত হই। পুড়িয়ে দাও জ্বালিয়ে দাও—এ ধরনের কথাবার্তা। চিন্তা করতে পারেন, কোন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে। আমরা কি বুঝি আমাদের ভয়টা কোথায়, আতঙ্কটা কোথায়? আমরা কি বুঝি আততায়ী কোথায় ছুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের পেছনে। বুঝি না, বুঝলে এ ধরনের দায়িত্বহীন কথাবার্তা আমাদের মুখ দিয়ে বের হতো না।’</p> <p>এ সময় তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ‘তিনটা মাস হয়নি এখনো, এর মধ্যে আমাদের আসল চেহারা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এই চেহারা নিয়ে কোনো দিনই সাফল্য অর্জন করা যায় না। যতই বড় বড় কথা বলি, যতই লম্বা লম্বা বক্তৃতা করি। নিজের ঘরেই যদি বিভেদ থেকে যায়, আমরা সেটা কখনোই ঠিক করতে পারব না।’</p> <p>গত ১৫ বছরের আন্দোলন, নির্যাতন ও কারাবরণের কথা উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য দীর্ঘ ১৫ বছর লড়াই করেছে, প্রাণ দিয়েছে, কারাগারে গেছে, নির্যাতিত হয়েছে। সেই মানুষগুলো ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আরেকটি বিজয় অর্জন করেছে। সেই বিজয় অর্জন হয়েছে রাজপথে অনেক রক্তের মধ্য দিয়ে, অনেক প্রাণের ভেতর দিয়ে। কিন্তু তার ফল কি এই বাংলাদেশ? তিন মাস হয়নি, এখনই রাস্তায় রাস্তায় লড়াই শুরু হয়েছে। একজন আরেকজনের বুকের রক্ত ঝরাচ্ছি। এখন পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, আক্রমণ করছে।’</p> <p>মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দুর্ভাগ্য আমাদের, কিছুসংখ্যক মানুষ আছেন যারা নিজেদের অত্যন্ত জনপ্রিয় সবচেয়ে দেশপ্রেমিক মনে করেন, আর গোটা জাতিকে আজকে তারা বিভাজনের দিকে উসকে দিয়ে একটা অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।’ কারো নাম উল্লেখ না করে বিএনপি মহাসচিব উপস্থিত চিকিত্সকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা গভীরভাবে চিন্তা করবেন, আমি কারো নাম বলব না। কারো নাম বলতে চাই না। আপনারা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করবেন, যারা আজ দেশকে বিভাজনের দিকে ঠেলছে, অনৈক্যের দিকে ঠেলছে, তারা আমাদের আসলে শত্রু না মিত্র। এই জিনিসগুলো বুঝতে হবে। আমি কথাগুলো ইচ্ছা করেই আজ তুলে ধরলাম।’</p> <p>দুই গণমাধ্যম ঘিরে সাম্প্রতিক ঘটনা উল্লেখ করে বিএনপি নেতা বলেন, ‘আমি তীব্রভাবে নিন্দা জানাচ্ছি প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ অন্যান্য সব পত্রিকার ওপর যে আক্রমণ শুরু হয়েছে। আমি তীব্র নিন্দা জানাই তার। কারণ আমি সারা জীবন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছি। এটা আমার বিশ্বাস, আস্থা।’</p> <p>বিএনপি মহাসচিব পত্রিকা দুটির কার্যালয়ের ফটক ঘিরে বিক্ষোভ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আপনি এক ফ্যাসিস্টকে উত্খাত করেছেন। কারণ সে আপনার গলা টিপে ধরেছিল, সে আমাদের মেরে ফেলছিল, কথা বলতে দিত না, ভোট দিতে দিত না, হত্যা করেছে, নির্যাতন করেছে। আবার এখন আরেকটা...একে বলতে দেওয়া যাবে না, একে নিশ্চিহ্ন করো, হাউ ডু ইউ জাস্টিফায়েড। আপনারা বলেন, এভাবে একটা সমাজ এগোতে পারে?’</p> <p>তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র মানে কী, যে আপনি আপনার কথা বলবেন। আপনার সঙ্গে আমি একমত হতে না-ও পারি। কিন্তু আপনার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে আমি আমার জীবন দিয়ে রক্ষা করব—এটাই গণতন্ত্র।’</p> <p>বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমি ১৪-১৫ বছর ধরে লড়াই করেছি, বহুবার জেলে গেছি, যেকোনো সময় আবারও জেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। কিন্তু আমি এই বাংলাদেশ দেখতে চাই না। আমি যা বিশ্বাস করি, আমার দল যা বিশ্বাস করে, সেই কথা আমার প্রাণ গেলেও আমি বলব। আমি বিশ্বাস করি, উদারপন্থী গণতন্ত্রে, বিশ্বাস করি বাকস্বাধীনতায়, ভোটের স্বাধীনতায়। আমি জানি, অনেকে অনেক কিছু বলেন, কিন্তু আমি এতটুকুও চিন্তা করি না। কারণ, আমরা রাস্তায় থেকে লড়ে লড়ে এই জায়গায় এসেছি। সময়-সুবিধা মতো পালিয়ে যাই না আমরা, সামনেই দাঁড়াই।’</p> <p>দেশ রক্ষার ‘বিভাজন’ ছেড়ে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা জীবনের শেষ অংশে চলে এসেছি। আমরা একেবারে জীবন সায়াহ্নে। সায়াহ্নে এসে আপনাদের বলতে চাই, যদি আপনারা দেশকে রক্ষা করতে চান, আপনারা স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে চান, আপনাদের অধিকারকে রক্ষা করতে চান, তাহলে আপনারা সবাই ঐক্যবদ্ধ হোন। বিভাজনের কাছে আপনারা কখনো মাথা নোয়াবেন না, অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াবেন না, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবেন না।’</p> <p>অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এই সরকার কিন্তু কারো দয়ার দান নয়। দয়া করে করেনি এটাকে। দেশের ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর দিয়ে এই সরকার তৈরি করা হয়েছে। সুতরাং এই সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সেটাকে স্বীকার করে নিয়ে পুরোপুরিভাবে দেশের জনগণের যে মূল লক্ষ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সেই লক্ষ্যে যাওয়াটাই তাদের জন্য সর্বোত্তম বলে আমরা মনে করি।’</p> <p>তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে সংস্কার করে নির্বাচনের পথে যেতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। একই সঙ্গে যারা সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের এমন কোনো কথা না বলার অনুরোধ করে বলেন, তাদের এমন কথা বলা উচিত নয়, যাতে জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। </p> <p>ড্যাবের সভাপতি ডা. হারুন আল রশিদের সভাপতিত্ব ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মেহেদী হাসানের পরিচালনায় সভায় আরো বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমানউল্লাহ আমান ও ফরহাদ হালিম ডোনার, ড্যাবের মহাসচিব ডা. মো. আবদুস সালাম, বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. মো. রফিকুল ইসলাম, ড্যাবের সাবেক সভাপতি এ কে এম আজিজুল হক প্রমুখ।</p>