<p>ইসলামের নামে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীরা কখনোই ইসলামের অনুসরণ ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক ছিল না, বরং তারা বাঙালি মুসলমানদের ওপর নানাভাবে দমন-পীড়ন শুরু করে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমরা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ভূমির স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।</p> <p>১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত নানা আন্দোলন ও সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তৈরি হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। জাতীয় মুক্তির এই দীর্ঘ সংগ্রামে আলেমরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। যেমন—</p> <p>১. ভাষা আন্দোলনে আলেমদের অবদান : মুসলমানদের হাতে উর্দু ভাষার জন্ম এবং তা ইসলামী জ্ঞানচর্চার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হওয়ায় উর্দু ভাষার সঙ্গে আলেমদের ঘনিষ্ঠ সংশ্লিষ্টতা ছিল। তবে তাঁরা মাতৃভাষাকে উর্দুর ওপর প্রাধান্য দিতে কখনো ভুল করেননি। প্রত্যাখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, ‘মুসলিম বাংলার সৌভাগ্য যে উর্দুপ্রীতি যাদের বেশি থাকবার কথা, সেই আলেমসমাজই এই অপচেষ্টার বাধা দিয়েছিলেন। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী উর্দুবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেছিলেন। বাংলার ওপর উর্দু চাপাবার সে চেষ্টা তখনকার মতো ব্যর্থ হয়।’ (একুশের মাওলানারা, পৃষ্ঠা-৬৬)</p> <p>পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হলে তৎকালীন আলেমসমাজের সর্বশ্রদ্ধীয় ব্যক্তিত্ব মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) ভাষা আন্দোলনের প্রতি জোরাল সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘মাতৃভাষা বাংলাকে ভাষার মর্যাদাদান আমাদের ন্যায্য অধিকার। আমাদের এ দাবি মানতেই হবে। ...পাকিস্তানের এক ডানাকে দুর্বল করে ধ্বংস ডেকে আনা হবে আত্মহত্যার শামিল। মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদাদান আমাদের ন্যায্য অধিকার।’ [মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) স্মারকগ্রন্থ, পৃষ্ঠা-১০৮]</p> <p>২. যুক্তফ্রন্টে আলেমদের অংশগ্রহণ : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ফলে বাঙালি মুসলমানের অন্তরে যে স্বদেশপ্রেম জাগ্রত হয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নামে মুসলিম লীগবিরোধী একটি জোট গঠিত হয়। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন জোটের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিল নেজামে ইসলাম পার্টি। নির্বাচনে মাওলানা আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী ও মাওলানা আতহার আলী (রহ.) প্রমুখ জোরাল ভূমিকা রাখেন। ফলে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়।</p> <p>৩. আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ : পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই আন্দোলনে দেশের ইসলামপন্থী ও আলেমসমাজ ছিল অত্যন্ত সক্রিয়। এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এই জোটে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম অংশ নেয়। জোটের পক্ষ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সে সর্বাত্মক হরতাল ঘোষণা করা হয়। হরতাল আহ্বান করে প্রকাশিত ইশতেহারে স্বাক্ষর করে নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি ও পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তের সভাপতি।</p> <p>৪. ছয় দফার পক্ষে আলেমরা : ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করলে সমগ্র পাকিস্তানের রাজনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এই সময় ছয় দফার পক্ষে অবস্থান নেয় আলেমদের রাজনৈতিক সংগঠন নেজামে ইসলাম পার্টি। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও গণমানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার পক্ষে বিবৃতি দেন সংগঠনের নেতা মওলানা মোসলেহ উদ্দিন, মওলানা আশরাফ আলী ও মওলানা আবদুল মতিন (বরিশালী)। এ ছাড়া ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মাওলানা সৈয়দ মনজুর হোসেনসহ বহু আঞ্চলিক ধর্মীয় নেতা ছয় দফার পক্ষে অবস্থান নেন।</p> <p>৫. পাকিস্তানি অপপ্রচারের প্রতিবাদ : পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি আন্দোলন যত জোরাল হচ্ছিল, এ দেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানিদের অপপ্রচার তত জোরাল হচ্ছিল। তারা পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের দেশপ্রেম ও ধর্মীয় অনুরাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাচ্ছিল। এর প্রতিবাদ করেন আলেমরা। পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মুফতি মাহমুদ হাসান বলেন, ‘ধর্মীয় প্রেরণা ও দেশপ্রেমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কোনো অংশে খাটো নয়। যখনই কায়েমি স্বার্থবাদীদের কুমতলব চরিতার্থ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে তখনই পূর্ব পাকিস্তান, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশের অনুন্নত এলাকার মানুষের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করা হয়েছে।’ (মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের ভূমিকা, পৃষ্ঠা-১১৯-১৩৪)</p> <p>আল্লাহ তাআলা দেশ ও জাতির জন্য তাদের আত্মত্যাগকে কবুল করুন এবং এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করুন। আমিন।</p>