<p>২০১২ সালে জাতিসংঘের সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক অন্যতম সংস্থা (ইউনেসকো) ১৮ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। আরবি কালজয়ী ভাষা। এ ভাষা স্থিতিশীল ও গতিশীল। মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রচার-প্রসার এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আরবি ভাষার আছে বিশেষ ভূমিকা। নিম্নে সংক্ষেপে এই ভাষার কতিপয় বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো—</p> <p>১. আদি ভাষা : প্রথম মানব আদম (আ.) পৃথিবীতে যখন আগমন করেন সে সময় তাঁর ভাষা ছিল আরবি। ভাষাবিজ্ঞানীদের ভাষ্য মতে, পৃথিবীতে এ ভাষার চেয়ে সর্বাধিক প্রাচীন আর কোনো ভাষার সন্ধান পাওয়া যায় না। [আল মাযহার/আল্লামা সুয়ুতি (রহ.) খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২৮]</p> <p>২. জান্নাতের ভাষা : কোরআন ও হাদিসের ভাষা আরবি। এমনকি ইসলামের বেশির ভাগ কিতাব দখল করে আছে এই ভাষা। আর জান্নাতের ভাষাও হবে আরবি। সে জন্য এ ভাষাকে জান্নাতের ভাষা বলা হয়। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (রা.) বলেন, ‘তিন কারণে তোমরা আরবিকে ভালোবাসো; যেহেতু আমি আরবি, কোরআন আরবি এবং জান্নাতের ভাষাও হবে আরবি।’ (মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস : ৭১৯৪, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৯৭)</p> <p>৩. আন্তর্জাতিক ভাষা : ইসলামের চেরাগ যেমন পৃথিবীর সর্বত্র পরিব্যাপ্ত, তদ্রূপ এ ভাষাও সমগ্র বিশ্বে বিস্তৃত। সে জন্যই আজ এ ভাষা বিশ্বমহলে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। বর্তমানে ষষ্ঠ দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে পরিগণিত। (ইলমুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-২০)</p> <p>৪. ধর্মীয় ভাষা : আল্লাহ তাআলা এ ভাষাকে ইসলাম ধর্মের ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে নির্বাচন করেছেন। এ কারণে এই ভাষার ব্যবহার বিভিন্ন রাষ্ট্রী বা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে পরিলক্ষিত হয়। (মুজাযু দায়িরাতিল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া, খণ্ড-২৩, পৃষ্ঠা-৭২৫১)</p> <p>৫. ইখতিসার বা সংক্ষেপণ : পৃথিবীতে এমন কোনো ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার শব্দ-বাক্য খুবই মুখতাসার বা সংক্ষিপ্ত। একমাত্র এই ভাষার শব্দ-বাক্য ব্যবহৃত হয় খুবই সংক্ষেপে। বরং এ ভাষায় শব্দ-বাক্য যত সংক্ষিপ্ত হবে তা সর্বোচ্চ সাহিত্যপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। প্রায় আরবি সাহিত্যের বই-পত্র ও অলংকারশাস্ত্রে এমন সংক্ষেপণের দৃষ্টান্ত মেলে। কোরআন ও হাদিস হলো তার জাজ্বল্যমান উদাহরণ। [আল মাজহার/আল্লামা সুয়ুতি (রহ.) খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২৫৬]</p> <p>৬. মুফরাদাত বা একক শব্দভাণ্ডারের আধিক্য : এ ভাষা অনেক বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ। একটি অর্থের জন্য কয়েকটি শব্দ ব্যবহৃত হয়। ইমাম শাফি (রহ.) বলেন, রাসুল (সা.) ছাড়া এমন কেউ নেই, যিনি সমগ্র আরবি সম্পর্কে সম্যক অবগত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উর্দুতে সিংহের জন্য ‘শের’ শব্দই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ন্যূনতম আরবি সম্পর্কে অবগত ব্যক্তি সিংহের জন্য তিনটি শব্দ অনায়াসে বলতে সক্ষম। যেমন—লাইছ, আসাদ, গাদনফার। তবে আরববিদরা বলেন, সিংহের জন্য ১৫০ শব্দ ব্যবহৃত হয়। আরেক বর্ণনানুসারে ৫০০ শব্দ ব্যবহৃত হয়। এমন শত-সহস্র শব্দে আরবিসমৃদ্ধ হয়ে আছে। সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডারের বদৌলতে আরবি শব্দে অল্প কথায় প্রচুর তথ্য-তত্ত্ব স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা যায়। (প্রাগুক্ত খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩২৫)</p> <p>৭. হরকত বা স্বরচিহ্ন : এ ভাষার প্রতি লফজ (শব্দ)-এর শেষাক্ষরে হরকত (জবর, যের, পেশ) যুক্ত হয়ে সে শব্দের অবস্থা বর্ণনা করে। এই স্বরচিহ্নের দ্বারা বাক্যের অর্থ বোঝা সহজলভ্য হয়। যেমন—শব্দটি কর্তা (ফাইল) হবে, নাকি কর্ম (মাফউল)। যদি কর্তা হয় তাহলে পেশ গ্রহণ করবে আর মাফউল হলে জবর ইত্যাদি। (প্রাগুক্ত খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩২৫)</p> <p>৮. অর্থালংকার : এ ভাষার উসূল (মূলনীতি) ও কাওয়ায়েদ (ব্যাকরণ) উত্কর্ষ ও উত্কৃষ্টের চূড়ান্ত সমন্বয়ে বিন্যস্ত ও গঠন করা হয়েছে, যা অন্য ভাষাতত্ত্ববিদদের বিস্মিত-বিহ্বল করে। এ ভাষার প্রতিটি বাক্যের নিজস্ব শব্দমূল ও উৎস রয়েছে। যাকে পরিভাষায় হুরুফে আছলিয়্যাহ  (Root Word)  বা শব্দমূল বলে। এর সাহায্যে বহু শব্দ সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে গঠন করা হয়। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, শব্দমূলকে এত চমৎকারভাবে বিন্যস্ত করা হয় যে মূল অর্থ প্রতি শব্দে বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়—জিন, জান্নাত, মাজনুন, জানিন ইত্যাদি। উল্লিখিত শব্দগুলোর মূল অক্ষর হলো জিম, নুন, নুন। প্রতিটি শব্দে লুকায়িত বা অদৃশ্য অর্থ রয়েছে। যেমন—‘জিন’ আমাদের চক্ষুর অন্তরালে অদৃশ্য থাকে। ‘জান্নাত’ দুনিয়ায় আমরা দেখতে পাই না, এটিও অদৃশ্য। ‘মাজনুন’ যার বিবেক-বুদ্ধি তার অদৃশ্যে। ‘জানিন’ গর্ভস্থ সন্তান, সেও আমাদের চক্ষুর অন্তরালে অদৃশ্য। সুবহানাল্লাহ! (প্রাগুক্ত খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২৭৪ ও তাফসিরে নাসফি, পৃষ্ঠা-৩৮)</p> <p>৯. মাখরাজ বা উচ্চারণস্থল : প্রত্যেক ভাষাভাষী স্বীয় ভাষার বর্ণমালা  (Alphabets)  উচ্চারণের ক্ষেত্রে ছয়টি অঙ্গের সহায়তা নিয়ে থাকে। যথা—হালক (কণ্ঠনালি), হানাক (মুখের তালু), লিসান (জিহ্বা), লিছাহ (দাঁতের মাড়ি), সিন্ (দাঁত), শাফাহ (ঠোঁট)। উচ্চারণের ক্ষেত্রে আরবি ভাষা উপরিউক্ত ছয়টি অঙ্গের যে পরিমাণ সহায়তা নিয়েছে অন্য ভাষায় তা দেখা যায় না। অন্যান্য ভাষায় বর্ণমালা উচ্চারণের জন্য আট অথবা ৯ কিংবা সর্বোচ্চ ১০টি মাখরাজ নির্দিষ্ট রয়েছে। কিন্তু আরবি ভাষায় আরবি বর্ণমালা মোট ২৯টি হওয়া সত্ত্বেও তা উচ্চারণের জন্য ১৭টি মাখরাজ রয়েছে। তবে ভাষাতত্ত্ববিদদের বর্ণনামতে ১৯টি আবার ২৯টি মাখরাজের কথাও উল্লেখ আছে। (আল-মুবিন, পৃষ্ঠা-৬০-৬১)</p> <p>১০. অর্থ-প্রাচুর্য বা সমার্থবোধক শব্দ : প্রত্যেক ভাষাভাষীর কাছে এ কথা স্বীকার্য যে একটি শব্দের কয়েকটি অর্থ আছে। আর এ ক্ষেত্রেও আরবি ভাষা প্রথম স্থানে। কেননা অর্থের প্রাচুর্যে এ ভাষা অতি সমৃদ্ধ ও উন্নত। বর্ণনা ও প্রকাশভঙ্গি অতি সূক্ষ্ম ও সুন্দর। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘আইন’। এই একটি আরবি শব্দের বহু অর্থ অভিধানে রয়েছে। আভিধানিকরা বলেন, এ শব্দের অর্থ ২৫০ থেকে ৫০০টি। আবার কেউ কেউ বলেন, ৮০০-এর অধিক। নিম্নে কয়েকটি প্রসিদ্ধ অর্থ উল্লেখ করা হলো : চোখ, ঝরনা, দৃষ্টি, গুপ্তচর, প্রহরী, সূর্য, বৃষ্টি, স্বর্ণ, ছিদ্র ইত্যাদি। এমন শত শত শব্দ আছে যার অর্থ একাধিক। [আল মাযহার/আল্লামা সুয়ুতি (রহ.) খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৭২]</p>