<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সম্প্রতি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী মার্চ মাসের মধ্যে সব ধরনের ঋণের শ্রেণীকরণ নীতিমালা আরো কঠোর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঋণ শ্রেণীকরণের নতুন নীতিমালায় কী ধরনের কঠোর শর্ত অনুসরণ করা হয়েছে, তা বিস্তারিতভাবে সংবাদমাধ্যমে আসেনি। তবে যতটুকু জানা গেছে তাতে নতুন নীতিমালা অনুযায়ী এখন থেকে যেকোনো ধরনের ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত তারিখের পর থেকে পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে না পারলে ব্যাংক যেকোনো ধরনের ঋণখেলাপি হিসেবে গণ্য করবে। বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী এই সময় ছয় মাস। নতুন নীতিমালা কার্যকর হলে দেশে মোট খেলাপি ঋণ দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। খুবই স্বাভাবিক। কেননা ঋণ পরিশোধের ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ডের মধ্যে যেখানে ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না, সেখানে তিন মাসের মধ্যে সেই ঋণ কিভাবে পরিশোধ করবে?</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><img alt="খেলাপি ঋণ কঠোর করার সময় এখন নয়" height="290" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/12 December/04-12-2024/0.jpg" style="float:left" width="322" />খেলাপি ঋণ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি বড় সমস্যা। এমনকি অনেকের মতে এটিই বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের প্রধান এবং একমাত্র সমস্যা। খেলাপি ঋণ একটি মারাত্মক সমস্যা, কিন্তু অবশ্যই প্রধান বা একমাত্র সমস্যা নয়। বরং ব্যাংকিং খাতে বিরাজমান আরো অনেক বড় বড় সমস্যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণের বৈশিষ্ট্যই এমন। এটিকে সঠিকভাবে ম্যানেজ করতে না পারলে এই সমস্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। আবার এই সমস্যা জোড়াতালি দিয়ে বা ধামাচাপা দিয়ে রাখারও কোনো সুযোগ নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশে হয় জোড়াতালি বা ধামাচাপা দিয়ে এই সমস্যা আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৭ শতাংশ। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) শর্ত অনুযায়ী এই খেলাপি ঋণ নির্ধারণের নীতিমালা কঠোর করা হচ্ছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। কেন আইএমএফ এ ধরনের খেলাপি ঋণ নির্ণয়ের শর্তারোপ করছে, তা বোধগম্য নয়। কেননা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের ব্যাংকগুলো যেভাবে খেলাপি ঋণ ম্যানেজ করে, সে সুপারিশ আইএমএফ করছে বলে মনে হয় না। উন্নত বিশ্বে ঋণ পরিশোধের জন্য নির্ধারিত তারিখ অতিবাহিত হওয়ার পর তিন বা ছয় মাসের কোনো গ্রেস পিরিয়ডের সুযোগ নেই। যে মুহূর্তে একটি ঋণ খারাপের দিকে যাওয়ার উপক্রম হয়, ঠিক সেই মুহূর্তে ঋণটিকে তিন মাসের জন্য বিশেষ তত্ত্বাবধানে নিয়ে নেওয়া হয়। এটি ঋণের মেয়াদ শেষে বা মেয়াদকালে যেকোনো মুহূর্তে হতে পারে। এই তিন মাস বিশেষ তত্ত্বাবধানে রেখে যদি ঋণটি ভালোর দিকে নেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে সেটি ভালো ঋণ হিসেবে চলতে থাকে। আর যদি সেই ঋণ ভালো হওয়ার সুযোগ না থাকে, তাহলে সেটিকে সম্পূর্ণরূপে অবলোপন করা হয়। আইএমএফ নিশ্চয়ই বাংলাদেশের জন্য এ রকম খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনার সুপারিশ করেনি। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">উন্নত দেশের ব্যাংকিং খাতের এমন মানসম্পন্ন খেলাপি ঋণ নীতির প্রয়োগ যে সব সময় সমানভাবে হয় তেমন নয়। যখন অবস্থা বেশি খারাপ হয়, তখন অনেক ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তই নিতে দেখা যায়। সাম্প্রতিক কালের একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করলে অনেকে বিষয়টা সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন। বিগত কয়েক বছর উন্নত বিশ্বের দেশগুলো সুদের হার মাত্রাতিরিক্ত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই উচ্চ সুদের হারের কারণে ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের কিস্তির পরিমাণ এমনভাবে বেড়ে গিয়েছিল, যা পরিশোধের ক্ষমতা অধিকাংশ ঋণগ্রহীতার ছিল না। তখন যদি ঋণগ্রহীতাদের নতুন কিস্তি অনুযায়ী ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ দেওয়া হতো, তাহলে তারা সেই কিস্তি পরিশোধ করতে পারত না। ফলে গণহারে সবাই ঋণখেলাপি হতো এবং সমগ্র ব্যাংক, তথা আর্থিক খাত মহাসংকটে পড়ে যেত। পক্ষান্তরে আগের কিস্তি অনুযায়ী ঋণ পরিশোধ করার সুযোগ অব্যাহত রাখলে ঋণগ্রহীতার আসল ঋণ তো দূরের কথা, বর্ধিত সুদের পরিমাণও শোধ হয় না, যা মানসম্পন্ন ঋণ পরিশোধ বা ডেট সার্ভিসিং পন্থার পরিপন্থী। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সাধারণত ঋণের কিস্তির একটি অংশ থাকে আসল পরিশোধের জন্য এবং বাকিটা ঋণের ওপর অর্জিত সুদ পরিশোধের জন্য। এ রকম অবস্থায় নিয়মবহির্ভূত হওয়া সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের আগের কিস্তি অনুযায়ী ঋণ পরিশোধের সুযোগ অব্যাহত রাখে এক শর্তে যে কিস্তির পরিমাণ দিয়ে যদি ঋণের ওপর অর্জিত সুদ পুরোটা পরিশোধ না হয়, তখন অবশিষ্ট সুদ আসলের সঙ্গে যোগ করা হবে ভবিষ্যতে পরিশোধের জন্য। অর্থাৎ প্রত্যেক কিস্তি পরিশোধের সঙ্গে সঙ্গে ঋণের পরিমাণ কমার পরিবর্তে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। অথচ মানসম্পন্ন ঋণ পরিশোধের নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক কিস্তি পরিশোধের সঙ্গে সঙ্গে কিছু পরিমাণ হলেও ঋণের পরিমাণ কমতে থাকে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বিষয়টি অনেকের কাছেই জটিল মনে হতে পারে বিধায় একটি কাল্পনিক উদাহরণের মাধ্যমে পরিষ্কার করা যেতে পারে। ধরা যাক, সুদের হার যখন ২.৫০ শতাংশ ছিল, তখন কানাডার একজন ঋণগ্রহীতা ব্যাংক থেকে তিন লাখ ডলার ঋণ নিয়েছেন, যার মাসিক কিস্তি এক হাজার ৬০০ ডলার। এই কিস্তির মধ্যে আসলের পরিমাণ ৫০০ ডলার আর সুদের পরিমাণ এক হাজার ১০০ ডলার। এভাবে পাঁচ বছর ঋণের কিস্তি পরিশোধের পর সেই ঋণগ্রহীতার ঋণের পরিমাণ তিন লাখ থেকে নেমে দুই লাখ ৭৫ হাজার ডলার হবে। এখন সুদের হার বৃদ্ধি পেয়ে ৭ শতাংশ হয়ে যাওয়ায় সেই ঋণের ওপর মাসিক সুদের পরিমাণ দাঁড়াবে দুই হাজার ২০০ ডলার। সেই ঋণগ্রহীতা যদি তার আগের কিস্তির পরিমাণ এক হাজার ৬০০ ডলার করে পরিশোধ অব্যাহত রাখে, তাহলে প্রতি মাসে অপরিশোধিত সুদের পরিমাণ হবে ৬০০ ডলার, যা আসল ঋণের সঙ্গে প্রতি মাসে যোগ হওয়ার কারণে ঋণগ্রহীতার ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এভাবে চার বছর পর সেই ঋণগ্রহীতার মোট ব্যাংকঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে তিন লাখ তিন হাজার ৮০০ ডলার, যা একসময় পরিশোধের মাধ্যমে হ্রাস পেয়ে দুই লাখ ৭৫ হাজার ডলারে নেমে এসেছিল।  </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আইএমএফ কি আমেরিকা, কানাডার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ রকম অব্যবস্থার ব্যাপারে কিছু বলেছে। আমার জানা মতে, না। এই বিষয়টি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, অনেক ব্যাংকারও সেভাবে জানে না। এমনকি যারা আমাদের দেশে খেলাপি ঋণ নিয়ে কাজ করেন, তারাও বিষয়টি সেভাবে জানেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আইএমএফ সুপারিশ করলেও সেটি সব সময় সঠিক নাও হতে পারে। আইএমএফ, এডিবি (এশিয়ান ডেভেলপমেণ্ট ব্যাংক), বিশ্বব্যাংক বা অন্যান্য দাতাসংস্থার পরামর্শ নিলেই যে খেলাপি ঋণ সমস্যার সমাধান হবে, তেমন ভাবার কোনো কারণ নেই। আর এটা যে হয় না, তার দৃষ্টান্ত তো আমাদের কাছেই আছে। গত শতাব্দীর আশির দশকে ফিন্যানশিয়াল সেক্টর রিফর্ম কর্মসূচির অধীনে সিএল (ক্লাসিফিকেশন অব লোনস) গৃহীত হয়েছিল। ফল কী হয়েছে তা আজ সবারই জানা। আজকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে যে মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ এবং অধিকাংশ ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতি, তার অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে এই সিএল। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এখন ব্যবসায়ীদের ব্যাবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে নিতে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। এই মুহূর্তে ব্যবসা এবং বিনিয়োগে গতি আনার কোনো বিকল্প নেই। প্রথমেই অতি পুরনো সব খেলাপি ঋণ, যা আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেসব ঋণ এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় অবৈধভাবে গৃহীত ঋণ, আপাতত অন্যত্র সরিয়ে রেখে এসব ঋণ আদায়ে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। পক্ষান্তরে যেসব ব্যবসায়ী এখনো ব্যবসায়ে আছেন, কিন্তু নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না, তাদের সঙ্গে ব্যাংক আলোচনা করে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী প্রয়োজনে উপযুক্ত সময় দিয়ে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। একজন ঋণগ্রহীতার যদি ব্যাংকে ঋণের পরিমাণ হয় পাঁচ কোটি টাকা এবং সেই ঋণগ্রহীতাকে যদি ছয় মাস বা এক বছর সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে বলা হয়, তাহলে সেই ব্যবসায়ী যে এই ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন, তেমন সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। পক্ষান্তরে এই ঋণের ওপর অর্জিত সুদসহ যদি সামান্য কিছু আসল প্রতি মাসে পরিশোধ করার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে অনেকেই সেই ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন বলেই আমার বিশ্বাস। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">খেলাপি ঋণ নিয়ে এসব বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে আমি খেলাপি ঋণের পক্ষে সাফাই গাইছি। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে খেলাপি ঋণ আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে একটি বড় সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সেটি করতে হবে আমাদের দেশের অর্থনীতি, ব্যাংকিং এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। ভিন্ন দেশের পরামর্শে নয়। সবচেয়ে বড় কথা এই সমস্যা সমাধানের জন্য একটা উপযুক্ত সময় বেছে নিতে হবে। দেশ যখন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যায়, দেশের ব্যাংকিং খাত যখন সংকটে থাকে এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায় যখন উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার মধ্যে থাকে তখন খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য কঠোর হলে অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে। খেলাপি ঋণ নীতিমালা যত কঠিন হবে, তত বেশি খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকবে। পরিণতিতে ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না। এমনকি নতুন বিনিয়োগের সুযোগও থাকবে না, যার প্রভাব পড়বে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর এবং সার্বিকভাবে অর্থনীতির উপর। মূল কথা হচ্ছে খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর হতেই হবে, কিন্তু সেই কঠোর হওয়ার উপযুক্ত সময় এখন নয়। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">nironjankumar_roy@yahoo.com</span></span></span></span></p>