<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আধুনিক তুরস্কের বৃহত্তম ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগরী ইস্তাম্বুলের কথা প্রায় সবাই জানি, যা আধুনিক তুরস্কের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। একসময় এই ইস্তাম্বুলের নাম ছিল কনস্টান্টিনোপল, যা ছিল শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের কেন্দ্রস্থল। ১৪৫৩  সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ সেখানে আক্রমণ করে বিজয় লাভ করেন। এতে প্রাণভয়ে ভীত হয়ে সেখানে থাকা শিক্ষক বা পণ্ডিতরা ভেনিস, মিলান, নেপলস, সিসিলি, রোমসহ ইতালির বিভিন্ন শহরে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে গিয়ে তাঁরা ব্যাপকভাবে শিক্ষাদান চালাতে থাকেন। এরই মধ্যে জার্মানিতে জোহানেস গুটেনবার্গ ছাপাযন্ত্র উদ্ভাবন করে ফেলেন। ১৪৭৭ সালে উইলিয়াম ক্যাক্সটন তা ইংল্যান্ডে আনেন এবং সময়ের পরিক্রমায় তা ইতালি, ফ্রান্স, বেলজিয়ামসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তখন এই শিক্ষকরা শিক্ষাদানের সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থ রচনায় ব্রতী হন। এতে শিক্ষাগ্রহণের পথ আরো সুগম হয়ে যায়। ফলে জ্ঞানজগতে উন্মোচিত হয় এক নতুন দিগন্ত, যা ইউরোপীয় রেনেসাঁর সূত্রপাত করে। অর্থাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে প্রত্যাবর্তনের আলোকবর্তিকা ছিল যাঁদের হাতে, তাঁরা শিক্ষক। ইতিহাসের এ ঘটনা থেকেই আঁচ করা যায় যে একটি সমাজ, রাষ্ট্র তথা সমগ্র বিশ্বের উত্কর্ষ সাধনে শিক্ষকের কতটা অবদান রয়েছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আসলে একজন শিক্ষক বদলে দিতে পারেন একজন শিক্ষার্থীর জীবন। আবর্তিত হতে পারেন মহানুভবতার প্রতীক হিসেবে। একজন আদর্শ শিক্ষক কেবল শিক্ষকই নন, একাধারে তিনি একজন মেন্টর, কাউন্সেলর, ইন্সপিরেটর, পথপ্রদর্শক এবং সর্বোপরি একজন অভিভাবক। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটি ছোট্ট ঘটনা বলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস গ্রুপে নির্বাচিত হওয়ার পর রিসার্চ সুপারভাইজার জানতে চাইলেন আমার ল্যাপটপ আছে কি না। আমি উত্তরে নেই বলে এক সপ্তাহের মধ্যে কিনে নেওয়ার কথা জানালাম। এক সপ্তাহ পর আবারও তিন দিন সময় নিলাম। তবু কিনতে না পেরে আর দুই দিন সময় চাইলাম। তিনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">জাহিদ, পৃথিবীতে মা-বাবা তথা পরিবারের পরে সব কথা নিঃসংকোচে শেয়ার করার মতো আস্থার জায়গা যদি আমাকে না মনে করতে পারো, তাহলে আমি সুপারভাইজার বা শিক্ষক হিসেবে ব্যর্থ হয়েছি।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> এই বলে তিনি লকার থেকে একটি ল্যাপটপ বের করে দিয়ে বলেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এটি তোমার জন্য এবং চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত ল্যাপটপ না কিনে এটিই তোমার কাছে রাখবে।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span> </span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><img alt="শিক্ষকের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা থাকতে হবে" height="184" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/11.November/01-11-2024/121/89900.jpg" style="float:left" width="304" />তবে বর্তমান সমাজে শিক্ষকদের নিয়ে যথেষ্ট অভিযোগ রয়েছে। ঠিকমতো শ্রেণিকক্ষে পাঠদান না করে প্রাইভেট বা কোচিংয়ে ডাকা এর মধ্যে অন্যতম অভিযোগ। চাঁদেরও যেমন কলঙ্ক আছে, ভালো-মন্দ মিলিয়েই যেমন মানুষ, ঠিক তেমনি শিক্ষকদের মাঝেও কিছু অর্থলোভী রয়েছেন। তবে সমস্যাটি কেবল এই শিক্ষকগুলোর না, বরং সমস্যাটি আমাদের সিস্টেমের। পৃথিবীর সবচেয়ে মহান পেশা শিক্ষাদান করেও যখন একজন ব্যক্তি অবহেলিত বা নিম্নশ্রেণির কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হন, অপর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধা পান, তখন তাঁর কাছে খুব বেশি কিছু আশা করাটাও খুব জ্ঞানীর কাজ নয়। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই আরামপ্রিয়। শিক্ষকরা যদি পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা পেতেন, তাহলে আমার মনে হয় না যে সারা দিনের ক্লাস শেষে নিজের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে আবার তাঁরা প্রাইভেট চেম্বারে যেতেন। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">একই বিসিএসে ক্যাডার হয়ে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তা গ্রেডের ওপরে সুপার গ্রেড পেয়ে চাকরি শেষ করেন। অথচ শিক্ষা ক্যাডারে সর্বোচ্চ হাতে গোনা কয়েকজন গ্রেড-৩ পর্যন্ত যাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন! এমনকি গ্রেড-৩-এ গিয়েও তাঁর সামাজিক মর্যাদা অন্য কিছু ক্যাডারের গ্রেড-৬-এর চেয়েও কম থাকে! আর এ জন্যই একজন ক্যান্ডিডেটের পছন্দ তালিকার সবচেয়ে নিচের দিকে থাকে শিক্ষা ক্যাডার। অথচ সামগ্রিক জাতীয় কল্যাণে চিত্রটি এর বিপরীত হওয়া উচিত ছিল। তাহলে এত বৈষম্য ও সমস্যার বোঝা যাঁর ঘাড়ে, তাঁর কাছে কিভাবে আমরা সর্বোচ্চ সার্ভিস আশা করব?</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তবে এসব সমস্যার সমাধানের পথ এখনো রুদ্ধ হয়ে যায়নি। সৎ, যোগ্য ও নিবেদিত শিক্ষকদের সমাবেশ ঘটাতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, যা রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা তথা সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">১. শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি স্বতন্ত্র কমিশন গঠন, যার মূল কাজ হবে মেধাবী ও নিবেদিত প্রার্থী বাছাই করা। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তাঁর পঠিত বিষয় বা যে বিষয়ে তিনি পাঠদান করবেন, সেই বিষয়ে জ্ঞানের গভীরতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। পাঠদানের সক্ষমতা যাচাইয়ে প্রদর্শনী ক্লাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে পঠিত বিষয়ে তাঁর লব্ধ গবেষণা ও প্রশিক্ষণকেও গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">২. নিয়োগলাভের পর একজন শিক্ষকের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা থাকতে হবে, যাতে দেশের সেরা শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হয়। কারণ সেরা শিক্ষার্থীগুলো শিক্ষকতায় এলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেরা হবে, যা দেশ ও দশের জন্য কল্যাণকর। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">৩. কর্মদক্ষতার স্পৃহা বাড়াতে পদোন্নতির ধারা মসৃণ করতে হবে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">৪. একাডেমিক উত্কর্ষ সাধনের সব সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে, যেখানে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">৫. স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদানের জন্য পর্যাপ্ত পারিতোষিক বা পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকবে। পর্যাপ্ত বেতন দেওয়ার পর তাঁদের প্রতি প্রাইভেট বা কোচিং করানোর নিষেধাজ্ঞা দিলে তা কার্যকর করা সহজ হবে, এমনকি যৌক্তিকও হবে। উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো নিলে শিক্ষাক্ষেত্রে আশানুরূপ পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়ন টেকসই, যার সুফল ভোগ করবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সিঙ্গাপুর এখন সারা বিশ্বের কাছে অনুকরণীয়। শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, অর্থনীতিসহ সব দিক থেকে বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রগুলোর একটি সিঙ্গাপুর। ১৯৬৫ সালে যখন সিঙ্গাপুরকে মালয়েশিয়া থেকে বের করে দেওয়া হয়, তখন দিশাহারা কিংবদন্তি নেতা লি কুয়ান ইউ যে কিভাবে এই ভঙ্গুর রাষ্ট্রকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তখন তিনি যেদিকটাতে গুরুত্ব দেন তা হলো সামাজিক পুনর্গঠনমূলক কর্মসূচি, যার মধ্যে মূল ছিল শিক্ষাব্যবস্থা। মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাছাই করে বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে তাদের দেশে এনে কর্মে নিয়োগ করা হয় এবং মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করার জন্য শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো দিয়ে তাদের বেতন অন্যান্য পেশার তুলনায় বেশি করা হয়। এর ফলে মাত্র এক দশকের মাঝেই দেশটিতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন বয়ে আসে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আবারও সেই কনস্টান্টিনোপলের ঘটনায় ফিরে আসি। অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদের আক্রমণে কনস্টান্টিনোপলের অনেক অবকাঠামো সেদিন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল, কিন্তু ধ্বংস হয়নি সেখানকার শিক্ষক তথা পণ্ডিতদের মেধা। বরং তাঁরা যেখানে গেছেন, সেখানে গিয়েই জ্ঞান বিতরণ করেছেন অকাতরে। এর ফলে বিশ্বসভ্যতায় এসেছে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন; ইতিহাস পেয়েছে আধুনিক যুগ নামক নতুন একটি অধ্যায়।</span></span></span></span></p> <p> </p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বরিশাল ক্যাডেট কলেজ</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">zahidbd462@gmail.com  </span></span></span></span></p>