<p>দুই দিন আগে আমার দুজন প্রাক্তন ছাত্র এসেছিল বিভাগে। একজন সরকারি চাকরি করছে, অন্যজন ব্যবসা করে বেশ ভালো আছে। তারা একসময় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের রাজনীতিতে বেশ প্রভাবশালী ছিল। বলল, বিগত ১৬ বছর ক্যাম্পাসে আসতে পারেনি ছাত্রলীগের ভয়ে। এখন রাহুমুক্তি ঘটায় প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পেরেছে।</p> <p>বিএনপির শাসনামলে আমি প্রায় সাত বছর একটি হলের প্রভোস্ট ছিলাম। আমার হলের আবাসিক ছাত্র ছিল তারা। অকপটে স্বীকার করে বলল, বিএনপি আমলে আপনি আমাদের প্রভোস্ট ছিলেন। আপনি দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত না থেকেও হলের দায়িত্বে আসায় আমরা কিছুটা ক্ষুব্ধ ছিলাম। বিশেষ করে আপনি শক্ত হাতে হল চালানোতে আমাদের একটু অসুবিধা হতো। পরে একসময় আমরা মেনে নিই। কারণ আপনার নিরপেক্ষতা ও সততা আমাদের আকৃষ্ট করেছিল।</p> <p>আমি বললাম, তোমাদের মূল্যায়ন ভালো লাগল। তবে আমার মনে হয় এ সময়ের ছাত্র হলে এভাবে কথা বলতে না। এখন ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষকদের দোষ খুঁজে আনন্দ পায়। এ জন্য অবশ্য শিক্ষকদেরও দায় রয়েছে। সরকারি চাকুরে ছাত্রটি বলল, ‘স্যার, বিপ্লবের পর অনেক ছাত্রের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা যেসব স্ট্যাটাস চোখে পড়ে, এসবের শব্দ চয়ন অনেক সময় খুব অমার্জিত মনে হয়।</p> <p>স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব স্তরের ছাত্রদের মধ্যে শিক্ষকদের অসম্মানিত করার একটি প্রবণতা আমাদের খুব পীড়া দেয়।’<br /> আমি বললাম, আপাতদৃষ্টিতে এই ছেলেমেয়েদের আচরণ দেখে ক্ষুব্ধ হতে পারো—কষ্ট পেতে পারো, কিন্তু তলিয়ে ভাবলে তাদের ক্ষমা করা যায়। কারণ যারা মাঠে বিপ্লব করছে, ছাত্রলীগ আর পুলিশের মার খেয়েছে, গুলিতে সতীর্থদের আহত-নিহত হতে দেখেছে, তখন তাদের মন বিক্ষিপ্ত থাকবেই। এরপর বিবেচনা করতে হবে বয়সের ব্যাপারটি।</p> <p>বিপ্লবোত্তর সময়ে যেসব কিশোর-তরুণ নিজ শিক্ষকদের অপমান করেছে, পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে, মনে করা হয় ওদের পেছনে সেয়ানা কোনো পক্ষের ইন্ধন রয়েছে। কচি বয়সে মাথায় ঢুকে গেছে বা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে আন্দোলন করে একটি সরকার নামিয়ে ফেলতে পারলে তাদের মতো শক্তিশালী আর কে হবে! তাই স্থান-কাল-পাত্র বিচার করে বা যুক্তি দিয়ে বোঝার মতো বিচারবোধ তাদের মধ্যে কাজ করে না। এসবে এক ধরনের হিরোইজমের আনন্দ খুঁজে পায়।</p> <p>আমরা চাই না চারপাশ তমসাচ্ছন্ন হয়ে যাকএক কলেজ শিক্ষক দুঃখ করে বলছিলেন, কলেজের দুজন শিক্ষক আওয়ামী লীগ সমর্থক হওয়ায় একদল ছাত্র তাঁদের ওপর চড়াও হয়েছিল। আমরা নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছিলাম। ছাত্ররা গলা চড়িয়ে বলছিল, আমরা সরকারের পতন ঘটিয়েছি, প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়োগ দিয়েছি। তাই আমাদের কথা শুনতে হবে। এ ধরনের মানসিকতা যে ভীষণ অরাজকতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তা দায়িত্বশীলরা ভাবছেন না। লক্ষণ কিন্তু ভালো নয়। এখন তো দেশে সরকার আছে। নানা দাবি উত্থাপিত হবে সরকারের কাছে। অথচ ছাত্র নামের একটি অংশ জোর করে পদত্যাগ করায় বিচারপতিদের—মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করাতে বঙ্গভবনের দিকে ছুটে যায়। অটো পাসের জন্য শিশু শিক্ষার্থীরা ছুটে যায় সচিবালয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে এসব ব্যাপারে সরকারপক্ষ থেকে জোরালো কোনো মন্তব্য ও নির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে না।</p> <p>২২ অক্টোবর রাত ১০টায় টিভির খবরে বঙ্গভবনের কাছে পুলিশের গাড়িতে একদল আন্দোলনকারীকে চড়াও হতে দেখলাম। ভয়ংকর দৃশ্য। বিনা উসকানিতে যেভাবে কাছে থেকে পুলিশের ওপর ইট ছোড়া হচ্ছিল, তা কোনো সভ্য দেশে হতে পারে না। ইটের আঘাতে রক্তাক্ত একজন পুলিশ সদস্যকেও দেখা গেল। ইট যারা ছুড়ছিল, দেখে অনেককেই ছাত্র বলে মনে হচ্ছিল না। আবার ভালো দিকও ছিল। একদল ছাত্র নিবৃত্ত করারও চেষ্টা করছিল। মানবঢাল হয়ে চেষ্টা করছিল পুলিশদের রক্ষা করতে।</p> <p>দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী যদি আত্মবিশ্বাস হারায়—ভীতির মধ্যে থাকে, তাহলে সামগ্রিক ক্ষতি হয়ে যাবে। এমন অবস্থা সরকারের দিকে বুমেরাং হয়ে ছুটে আসবে। এই অবস্থা পরাজিত শক্তিকে এগিয়ে আসতে শক্তি জোগাবে। সরকারের বয়স প্রায় তিন মাসে পড়ছে। একটি গণ-অভ্যুত্থান বা গণ-আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জন করার পর আন্দোলনের ফসল হিসেবে নতুন সরকার গঠিত হলে পরবর্তী দায়িত্ব সরকারেরই নেওয়া উচিত। এরপর আন্দোলনকারী তরুণদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা নিজ নিজ পেশায় ফিরিয়ে নেওয়া উচিত। সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে তাদের বিশেষ ইস্যুতে সময়ে সময়ে মাঠে নামানো সরকারের দুর্বলতার প্রকাশ হিসেবে প্রতিভাত হবে, যা দেশ ও সরকারের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনবে।</p> <p>বিপ্লবোত্তর কালে শিক্ষার্থীদের সঠিক পথনির্দেশনা না দিতে পারায় একটি বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে তরুণরাও ভাবতে শিখেছে তারাই শক্তিমান। তারা যে দাবি করছে, সরকার তা-ই মেনে নিচ্ছে। তাই জোড়াতালির এইচএসসি পরীক্ষা নিতে হলো কর্তৃপক্ষকে। আবার যারা অকৃতকার্য হলো, তারা পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য হামলে পড়ল শিক্ষা বোর্ডে। চেয়ারম্যান পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে আত্মসম্মান রক্ষা করতে চেষ্টা করলেন।</p> <p>এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় দেখলাম স্কুল শিক্ষার্থীরা দাবি নিয়ে পথে নেমেছে। এক ‘শিশু নেতা’র সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন সাংবাদিক। তাদের দাবি পরীক্ষার হলে কড়াকড়ি করা যাবে না। পরীক্ষার হলে ‘সুবিধা’ দিতে হবে। ছোট করে দিতে হবে সিলেবাস...। দুর্ভাবনা হচ্ছে, এমন ধারা চললে কয়েক দিন পরে না আবার পরীক্ষা না দিয়ে সার্টিফিকেট দেওয়ার দাবি ওঠে! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, যারা নিজেদের বিপ্লবী মনে করে, তাদের অনেকেই যার যার এজেন্ডা নিয়ে একে-ওকে সুবিধামতো ট্যাগ লাগিয়ে যাচ্ছে। এতে দেখা দিচ্ছে এক ধরনের বিভ্রান্তি। আমি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছি দেশের নষ্ট রাজনীতি বেশির ভাগের মগজে রাজনৈতিক বিভক্তির নেশা চেপে দিচ্ছে। দলনিরপেক্ষ মুক্তচিন্তার অবকাশ নেই যেন কোথাও। শুধু জুলাই গণ-আন্দোলন নয়, এর অনেক আগে থেকেই এমন দুরবস্থা বিরাজ করছে।</p> <p>আমি বিএনপি প্রশাসনের আমলে দীর্ঘ প্রায় সাত বছর একটি হলের প্রভোস্ট ছিলাম। শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে কখনো যুক্ত ছিলাম না আমি। দলনিরপেক্ষ অবস্থান আমার বরাবরই। তবু আমার গায়ে অনেকে বিএনপি সমর্থকের ট্যাগ লাগিয়ে দিত। দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে আমি অনেক জাতীয় দৈনিকে কলাম লিখে আসছি। কোনো লেখায় বিএনপি সরকারের সমালোচনা থাকলে আওয়ামী লীগের দালাল বলে টেলিফোনে আর মেসেজে বকাঝকা খেতে হতো। আবার আওয়ামী লীগের বিপক্ষে গেলে লীগওয়ালারা হামলে পড়ত।</p> <p>আমার গবেষণা অঞ্চল মধ্যযুগের বাংলা। তাই প্রসঙ্গক্রমে বাংলায় ইসলাম বিস্তার ও সুফি তৎপরতা নিয়ে লিখলে অনেকে আবার আমাকে জামায়াত সমর্থক বানাত। শুধু কি তাই! বিগত সরকারের আমলে সরকারিভাবে বই কেনা কয়েকটি বড় প্রকল্প ছিল। তেমন একটি প্রকল্পে বঙ্গবন্ধুর জীবনী ও ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে আমার লেখা দুটি বইয়ের বেশ কয়েক হাজার কপি সরকারি ক্রয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। প্রকাশক খুশি হয়ে জানালেন। পরে তালিকা থেকে বিদায় করা হলো। কে নাকি জানিয়েছিল লেখক আওয়ামী লীগের সমর্থক নন। এই জায়গায় অবলীলায় ঢুকে পড়ল দুই আমলার বই।</p> <p>আমার কন্যার ইংল্যান্ডের ডিগ্রি থাকার পরও আওয়ামী লীগের দলীয় উপাচার্য শিক্ষক নিয়োগে ইন্টারভিউ কার্ডই ইস্যু করেননি। অপরাধটি আমার। আমার নির্দলীয় অবস্থান। প্রস্তাব এসেছিল আমি যদি উপাচার্যপন্থী প্রশাসনকে সমর্থন করি, তবে একটি নিষ্পত্তি হতে পারে। কন্যার শিক্ষক হওয়ার বিনিময়ে আমি আমার আদর্শ বিসর্জন দিতে পারিনি। আমার কন্যাও আমাকে সমর্থন করেছে।</p> <p>বিপ্লবোত্তর সময়ে আবার দেখা গেল মুক্তচিন্তার যৌক্তিক লেখার পরও কারো কারো চোখে আমি আওয়ামী লীগ সমর্থক হয়ে গেলাম। অতএব আমি পরিত্যাজ্য। এসব দেখে মনে হচ্ছে, আমরা ইতিহাস ও জ্ঞান বিচ্ছিন্ন জাতিতে পরিণত হচ্ছি। ঈর্ষাপরায়ণতায় ছেয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান ও যুক্তির পক্ষে না হাঁটায় প্রতিদিন যেন অন্ধকার ছড়িয়ে দিচ্ছি। এমন অবস্থায় একটি রক্তঝরা বিপ্লব যে আশার দরজা খুলে দিয়েছিল, তা তমসাচ্ছন্ন করে ফেলছি প্রতিদিন।</p> <p><em>লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়</em></p> <p><em>shahnawaz7b@gmail.com</em></p>