<p>কবিতা লিখতাম। কৃষিবিষয়ক লেখা লিখতাম। এক সময় ফেসবুকে লেখালেখি শুরু করি। লেখালেখির কারণেই আমাকে গুম করা হয়। আমাকে তারকাঁটাযুক্ত জুতা পরতে দেওয়া হতো। সেই জুতা পায়ে দেওয়ার পর তারকাঁটা ঢুকে রক্তাক্ত হতো পা। একটি কক্ষে নিয়ে আমার দুই হাতের ওপর বুটসহ লাফাতে শুরু করে র‌্যাব সদস্যরা। হাত থেঁতলে যায়। ওই হাত দিয়ে খেতে পারতাম না—কাঁদতে কাঁদতে এমন বর্ণনাই দিচ্ছিলেন র‌্যাবের হাতে গুমের শিকার কৃষিবিদ ফসিউল আলম। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের মাওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ হলে ‘ক্রসফায়ারের কারিগর র‌্যাবের কসাই খ্যাত মহিউদ্দিন ফারুকীর ফাঁসি চাই’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে গুমের শিকার ফসিউল আলম এমন বর্ণনা দেন। ‘ফারুকীর হাতে গুম পরিষদ’-এর ব্যানারে এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।</p> <p>ফসিউলের নির্যাতনের বর্ণনা দেওয়ার সময় পুরো হলরুম নিস্তব্ধ হয়ে যায়। অনেককে চোখের পানি মুছতে দেখা যায়। অনেকের চোখ ছলছল করছিল। শুধু তিনিই নন, গুম হওয়ার পর ফিরে আসা অন্তত সাতজন তাদের নির্যাতনের কাহিনি তুলে ধরেন। হুমায়ূন কবীর নামের একজন জানান, চা খাওয়ার কথা বলে ফ্লাইং কিক দেওয়া হয় তার মুখে। চেয়ার থেকে উল্টে পড়ে তার দাঁত ভেঙে যায়। প্রত্যেকেই অভিযোগ করেন গ্রেপ্তার হওয়া এসপি মহিউদ্দিন ফারুকীর বিরুদ্ধে। তিনি র‌্যাব-১০ এবং র‌্যাব-২-এর সাবেক কম্পানি কমান্ডার থাকাকালে এ গুমের ঘটনা ঘটান বলে তারা দাবি করেন। তারা মহিউদ্দিন ফারুকীর বিচার চান।</p> <p>সরকারবিরোধী লেখালেখির কারণে ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন কৃষিবিদ ফসিউল আলম। তিনি বলেন, উত্তরায় আমার অফিস থেকে বের হলে আমাকে মহিউদ্দিন ফারুকী আটক করে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। রাত ১০-১১টার দিকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুই কেন সরকারের বিরুদ্ধে লিখিস?’ ছোট একটি কক্ষে আমাকে বন্দি করে রাখা হয়। তিনি বলেন, ‘ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়। শক দেওয়ায় আমার ব্রেনের সামনের অংশ শুকিয়ে গেছে।’ ২০১৮ সালের ২৯ আগস্ট গুমের শিকার হন ওয়াসিম ইফতেখারুল হক। তিনি জানান, খালেদা জিয়াকে নিয়ে বই লেখার কারণে তাকে গুমের শিকার হতে হয়। গ্রেপ্তার দেখানোর পর তার নামে আরো তিনটি মামলা দেওয়া হয়।</p> <p>ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হুমায়ূন কবির ২০১৮ সালের ২৭ অক্টোবর একটি মামলার হাজিরা দিতে যাওয়ার পথে লঞ্চ থেকে তাকে ধরে নিয়ে গুম করা হয়। তিনি বলেন, ‘তারা একটা গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে একটি রুমে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। সেখানে একজন আমাকে চা অফার করে। আমি সেটা খেতে চাইনি। পরে তারাও অনুরোধ করে বলে, আপনি চা খেলে আমরাও চা খেতে পারব। চা খেতে রাজি হওয়ার পর একজন বলে, এই ওরে লাল চা দে। এটি বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখের চাপা বরাবর লাথি মারে। এতে আমি চোখ বাঁধা অবস্থায় চেয়ারসহ পড়ে যাই। চাপার একটি দাঁত ভাঙে। কানে কারেন্টের শক দেওয়া হয়। আমি এক কানে এখনো শুনতে পাই না। ৬ নভেম্বর একটি অচেনা জায়গায় আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছেড়ে দেওয়ার পর পরই একটি গাড়িতে আমি মহিউদ্দিন ফারুকীকে দেখি। ওই গাড়িতে র‌্যাব-১০ লেখা ছিল। তখন বুঝতে পারি আমাকে র‌্যাব গুম করে রেখেছিল। তখন অনেকে আমাকে ফলো করছিল। একটু জোরে হাঁটার চেষ্টা করি। তারা কাছে এসে বলে এত দিন যা হয়েছে, সব ভুলে যান। আপনাকে আজ গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আমাকে আবারও রিমান্ডে নেওয়া হয়। ২০৮ বার মামলায় হাজিরা দিয়েছি। তিনি আরো জানান, গোপনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শকের কারণে রক্ত বের হতো।</p> <p>তিনি বলেন, ‘মহিউদ্দিন ফারুকী আমার কাছে থেকে তখন চার লাখ টাকা নিয়েছেন, ল্যাপটপ ও মোবাইল নিয়েছেন। বাসা থেকে আরো টাকা নিয়েছেন।’</p> <p>খালেদা জিয়াকে নিয়ে বই প্রকাশ করায় দুই দফায় ২০১৮ সালের ২ আগস্ট ও ২৭ অক্টোবর গুমের শিকার হওয়া শিক্ষানবিশ আইনজীবী রাজন ব্যাপারী বলেন, আমাকে কনডেম সেলে আটকে রাখা হতো। ফজরের আজানে ‘আসসালাতু খাইররুম মিনান নাউম’ শুনলে বুঝতাম আমার আরেকটা দিন পার হলো। কবে আমাদের মেরে ফেলা হবে, কোথায় লাশ পাওয়া যাবে কেউ চিনবে কি না জানি না। এই কারণে আমরা আমাদের পরনের গেঞ্জি-ট্রাউজারের নিচে বাসার কারো ফোন নম্বর আর আমার নাম লিখে রাখতাম। যাতে আমাদের লাশ শনাক্ত করতে পারে। বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সমিতির চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসার সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরো বক্তব্য দেন গুমের শিকার রেজওয়ানুল হক শোভন, ড. এনামুল হক মনি, আ. আ. জাবীদ (বাবু) প্রমুখ।</p>