<p>ছয় মাসের মাথায় দ্বিতীয়বারের মতো ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ইরানের হামলার পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘ইরানকে মূল্য দিতে হবে।’ অন্যদিকে ইসরায়েল যদি জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে আবারও পাল্টা হামলা চালানো হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরান। হামাস, হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতা ও ইরানের কমান্ডারদের হত্যার জবাব হিসেবেই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে বলে জানায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড।</p> <p>বিবিসির আন্তর্জাতিক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন তার বিশ্লেষণে বলছেন, ইরান ‘সিরিয়াস ড্যামেজ’ (গুরুতর ক্ষতি) ঘটানোর চেষ্টা করেছিল বলেই দেখা যাচ্ছে। ফলে ইসরায়েলের জবাব কী হয়, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। বিবদমান দুই দেশ ও তাদের মিত্রদের তৎপরতায় মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে? এ ব্যাপারে বোয়েন ও বিবিসির নিরাপত্তাবিষয়ক সংবাদদাতা ফ্র্যাংক গার্ডনারের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি লেখা হয়েছে।</p> <p>গত এপ্রিলে ইরান যখন ইসরায়েলে আক্রমণ করে, তখন দৃশ্যমান কিছু একটা কিছু করে দেখানোর প্রচেষ্টাটা লক্ষণীয় ছিল। কিন্তু সেটা একটা প্রচেষ্টা হিসেবেই থেকে যায়। কারণ সেবার তাদের প্রায় সব ক্ষেপণাস্ত্রই ইসরায়েলি ও মার্কিন প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কারণে ভূপাতিত হয়।</p> <p>এবারের ব্যাপারটা ভিন্ন। ইরান গুরুতর ক্ষতি করার চেষ্টাতেই জোরদার আঘাত হেনেছে বলে মনে হচ্ছে। এবার অনেক বেশি আগ্রাসী তাদের প্রচেষ্টা।</p> <p><strong>ইসরায়েলিদের মনোভাব</strong><br /> এপ্রিলে নেতানিয়াহুকে বড় ধরনের পাল্টা হামলা চালাতে বারণ করেছিলেন জো বাইডেন। তাতে ইসরায়েলেরই জয় হবে বলে অভিমত ছিল তার। ইসরায়েলও সেবার জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তবে গতবার ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক সহযোগীরা দেশটিকে যেভাবে ধৈর্যধারণের আহ্বান জানিয়েছিল, এবার তেমনটি হওয়ার সম্ভাবনা কম।</p> <p>এদিকে এখন ইসরায়েলে ভিন্ন হাওয়া বইছে। গত রাতে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের করা টুইটের দিকে তাকালে এর একটা আভাস পাওয়া যায়। বেশ কড়া ভাষা ব্যবহার করেছেন বেনেট। তিনি লিখেছেন, ‘৫০ বছরের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় সুযোগ মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা পাল্টে দেওয়ার।’</p> <p>ইরানের ‘সন্ত্রাসী সরকারকে মারাত্মকভাবে পঙ্গু করে দিতে’ তাদের পরমাণু অবকাঠামোর দিকে নজর দেওয়া উচিত ইসরায়েলের—এমনটা মনে করছেন বেনেট।</p> <p>বেনেট যদিও এখন প্রধানমন্ত্রী নন। তবে ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে ধারণা করা হয়, নিজেকে কঠোর হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা হয়তো সে জন্যই। কিন্তু তার বক্তব্য নিশ্চিতভাবেই দেশটির নাগরিকদের অন্তত একাংশের মনোভাবের প্রতিফলন।</p> <p>এই মুহূর্তে ইরানের অর্থনীতির ক্ষতির কারণ হতে পারে—এমন যেকোনো কিছুতে ইসরায়েলের হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে মনে করেন জেরেমি বোয়েন। হতে পারে সেটি পরমাণু প্রকল্প কিংবা পেট্রোকেমিক্যাল স্থাপনা।</p> <p><strong>ইসরায়েলের ‘সব অবকাঠামোতে’ হামলার হুঁশিয়ারি</strong><br /> তেহরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েল যদি কোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেয়, তবে ইসরায়েলের সব অবকাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু করে হামলা চালাবে ইরান। ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর যুগ্ম প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি এই ঘোষণা দিয়েছেন।</p> <p>বাঘেরি বলেন, ‘যদি (ইসরায়েল)...এই ধরনের অপরাধ অব্যাহত রাখে বা আমাদের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে কিছু করতে চায়, তাহলে আজকের রাতের অভিযান আরো কয়েক গুণ শক্তিশালী হবে এবং তাদের সব অবকাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু করা হবে।’</p> <p>তিনি আরো বলেন, ইরানের বিশেষায়িত সামরিক শাখা রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করার জন্য প্রস্তুত।</p> <p><strong>ইরানের ঢাল হিজবুল্লাহ</strong><br /> লেবাননের হিজবুল্লাহ ইরানের একটি প্রতিরক্ষা ঢাল হিসেবে কাজ করে আসছিল। ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো আক্রান্ত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে, হিজবুল্লাহর ভাণ্ডারে থাকা অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলো প্রতিরোধের কাজে লাগানো যেত। কিন্তু মার্কিন ও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী, গত দুই সপ্তাহে সশস্ত্র সংগঠনটির অর্ধেক অস্ত্র ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের শীর্ষ নেতৃত্ব শেখ হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হয়েছেন, লেবাননে প্রবেশ করেছে ইসরায়েলি সেনারা। ফলে হিজবুল্লাহর কারণে ইরানের যে প্রতিরোধটুকু ছিল, সেটি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।</p> <p>জেরেমি বোয়েনের বিশ্লেষণ, এর ফলে ইসরায়েল আরো অবাধে তৎপরতা চালাতে পারছে। আর ফ্র্যাংক গার্ডনার বলছেন, ইসরায়েলের এখনকার কৌশল হিসেবে দেখা যাচ্ছে একসঙ্গে দুইভাবে এগোনোর চেষ্টা। গুপ্ত হামলায় শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করা, বিমান হামলা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা, যার মাধ্যমে ইরান ও ছায়াশক্তিগুলোকে বুঝিয়ে দেওয়া যে ইসরায়েলে আঘাত করলে আরো বেশি শক্তির মুখোমুখি হতে হবে।</p> <p>তবে লেবাননে সম্মুখ যুদ্ধে ইসরায়েলি সেনাদের প্রতিহত করার দাবি করেছে হিজবুল্লাহ। বুধবার দুইবার মুখোমুখি লড়াই হয়েছে বলে জানায় তারা। সংগঠনটির বক্তব্য, এগুলো যুদ্ধের প্রথম পর্যায়। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত দক্ষিণ লেবাননে নিজেদের অন্তত আটজন সেনা নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী।</p> <p><strong>যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা</strong><br /> ইরানে হামলার জন্য দীর্ঘদিনের একটি পরিকল্পনা ইসরায়েলের হাতে থেকে থাকবে। অবশ্যম্ভাবী সামরিক লক্ষ্যবস্তু হবে স্থলভাগে, যেখান থেকে মঙ্গলবারের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে। ফায়ারিংয়ের জন্য ক্ষেপণাস্ত্র যেখানে রাখা হয়েছে সেই জায়গা নয়, বরং কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার, এমনকি রিফুয়েলিং সেন্টারগুলোও এর আওতায় থাকার কথা।</p> <p>অন্যদিকে জো বাইডেন ভূমধ্যসাগরে আরো সেনা পাঠিয়ে ইরানকে ইঙ্গিত করছেন, যদি ইসরায়েলের ওপর আঘাত আসে, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আঘাত বলেই বিবেচিত হবে।</p> <p>এসব কারণে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা নিয়ে কথা উঠছে। চলমান ঘটনাপ্রবাহে তৈরি অস্থিতিশীলতা ও অশান্তির পরিপ্রেক্ষিতে কূটনৈতিক সমাধানের সুযোগ একেবারেই ক্ষীণ হয়ে এসেছে।</p>