<p>প্রত্যাশিত মৃত্যু। তবু আজ সেই মৃত্যুই ব্রেকিং নিউজের মতো ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়েছে ক্রীড়াঙ্গনে- অঘোর মণ্ডল আর নেই। সেকালের পাঠক থেকে একালের টিভি দর্শকের কাছে তিনি বরেণ্য ক্রীড়া সাংবাদিক। আমার কাছে তিনি সেই তিন যুগ আগের খবরের জন্য বুভুক্ষু তেজি ‘ফুট সোলজার’। অমোঘ নিয়তি অঘোর মণ্ডলের সেই যাত্রা থামিয়ে দিয়েছে, রেখে গেছেন ক্রীড়া সাংবাদিকতায় তার পদচিহ্ন।</p> <p>কতকাল ক্রীড়া সাংবাদিকতা করেছেন অঘোর মণ্ডল? এই পেশার বিভিন্ন ফোরামে বিস্তর আলোচনার পরও অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। প্রিন্ট দিয়ে শুরু, মাঝে টিভি, অনলাইন- কোনোটই বাদ যায়নি। তার ছায়ায় ক্যারিয়ার শুরুর স্মৃতি হাতড়ে অনুমান করছি, ঢাকায় অঘোর মণ্ডলের সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু দৈনিক জন্মভূমিতে। এরপর একে একে আজকের কাগজ, লাল সবুজ, দৈনিক বাংলা, বাংলার বাণী, দীপ্ত টিভি, এটিএন নিউজ। তবে তার স্বর্ণসময় কেটেছে দৈনিক ভোরের কাগজে। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগের সেই সময় এতটাই বর্ণাঢ্য যে আজও তার সার্বজনীন পরিচয় ‘ভোরের কাগজের অঘোর মণ্ডল’। সব মিলিয়ে ৫৮-তে থামা অঘোর মণ্ডলের সাংবাদিকতার বয়স প্রায় ৩৫ বছর।</p> <p>শুধু এটা কেন? একই হাউসে কাজ করেও তার পেট থেকে কোনো খবর আগাম বের করতে পারিনি। প্রতিটা বিস্ফোরক খবর তিনি সযতনে গোপন রাখতেন পেস্টিংয়ের আগে পর্যন্ত। তখন পেজ মেকআপ হতো রাত ১২টার দিকে। রিপোর্টার অঘোর মণ্ডল রান ৯টার দিকে অফিসে ঢুকে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘ধুর, দিনটাই মাটি গেল। কোনো খবর নেই!’ কিন্তু ভোরের কাগজের স্পোর্টস রুমের আমরা সবাই জানতাম, খবর অবশ্যই আছে। যেদিন যত হতাশা প্রকাশ করতেন অঘোর মণ্ডল, তত ঝাঁজালো খবর ছাপা হতো পরের দিনের পত্রিকায়। নিজের অফিস থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের প্রেসবক্স- সর্বত্র একই অভিব্যক্তিতে অভ্যস্তরা স্নায়ুচাপে ভুগতেন অঘোর মণ্ডলকে নিয়ে। নিশ্চয়ই এক্সক্লুসিভ কোনো নিউজ আসছে। আসতও, যেগুলোকে পরে আমরা নাম দিয়েছিলাম- আন্ডারআর্ম! ভোরের কাগজের খেলার পাতার নিচে বড় বক্স করে ছাপা নিউজ আমরা চোখ ছানাবড়া করে পড়তাম।</p> <p>অদ্ভুত রুটিন ছিল অঘোর মণ্ডলের। বাসা ভূতের গলি। সকাল ৮টায় অফিসে হাজির হতেন পত্রিকার ফাইল ঘেঁটে দেশের সব জাতীয় দৈনিকে চোখ বোলানোর জন্য। আর বিকেলে আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেন- ওই পত্রিকার অমুক নিউজটা মিস হলো কেন? ভোরের কাগজে যে বিশেষ খবর গেছে, সেসব বিবেচনায় নিতেন কম। সব সময় আর সব নিউজ আউটলেটের সঙ্গে অদৃশ্য একটা লড়াই ছিল তার। খবরের এমন অসীম ক্ষুধা বিরল।</p> <p>সেই লড়াই আমাকেও কম তাড়া করেনি। ‘কাল আপনি মাঠে যাবেন’, অঘোর মণ্ডলর নির্দেশের অপেক্ষা করিনি কখনো। মাঠে যেতাম নিয়মিত। তবু রাতে অফিসে ফিরে বলতেন, ‘আমি তো আপনাকে দেখলাম না।’ তত দিনে আর প্রতিবাদ করতাম না, হেসে বলতাম, ‘দাদা, ওয়ার্মআপের সময় থেকে আমি মাঠে ছিলাম। আপনি কোথায় ছিলেন?’ অঘোর মণ্ডল কৌশলে প্রসঙ্গ বদলে ফেলতেন। আসলে নিশ্চিত হতে চাইতেন, রিপোর্টার মাঠে গিয়েছে কি না।</p> <p>পাঠশালার মতো আবহ তৈরি করে রাখতেন অঘোর মণ্ডল। সেই পাঠশালার ‘পণ্ডিত মশাই’ আজ নেই। তবে পরম্পরা তো থেকে যায়। অঘোর মণ্ডল যেমন গতকাল অমরত্বলাভ করেছেন ক্রীড়া সাংবাদিকতার বড় ক্যানভাসে। কিডনির জটিলতা, ডায়ালাইসিস, ডেঙ্গু, লাইফ সাপোর্ট- এসব তার অমরত্বে যাত্রার ঘটনাক্রম মাত্র!</p>