<p>১৯৪০ সাল। রুশ বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো তখন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। রালফ আলফার নামে এক মেধাবী ছাত্র গ্যামোর অধীনে তখন পিএইচডি করছেন। মার্কিন জ্যোতির্বিদ এইউইন হাকল বলেছিলেন মহাবিশে^র প্রসারণের কথা। বলেছিলেন মহাবিশ্বের প্রতিটা বস্তু পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। হাবলের তত্ত্ব থেকেই তাদের গ্যামো আলফারের মাথায় আসে, যদি সব গ্যালাক্সি পরস্পর থেকে দূরে সরে যেতে থাকে তবে নিশ্চয়ই এরা একসময় একত্রে ছিল। অর্থাৎ এরা এক বিন্দুতে আবদ্ধ ছিল! তার পর সেই বিন্দু থেকেই বিরাট বিস্ফোরণ ঘটে। তারপর বিন্দুটি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মহাশূন্যে। তাঁদের সঙ্গে  সহমত প্রকাশ করলেন বেলজিয়ান বিজ্ঞানী জর্জেস হেনরি লেমিত্রি।</p> <p>বিরোধিতা করার লোকেরও অভাব হয়নি। বিরোধি কাতারে সবচেয়ে সোচ্চার বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ফেডেরিক হয়েল। তাঁর বিরোধিতার সঙ্গত কারণও আছে। তিনি মহাবিশে^র জন্য তিনি একটা তত্ত্ব দাঁড় করেছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকরের সঙ্গে। তাঁদের সেই তত্ত্বটির নাম স্টেডিস্টেড থিওরি। সেই থিওরি মানলে মহাবিশ্বের সংকোচন-প্রসারণের কোনো বালাই থাকে না। কিন্তু গ্যামোর তত্ত্ব মানলে মহাবিশ^ আর স্থির থাকতে পারে না। ভেঙে পড়ে হয়েল-নারলিকরের স্টেডিস্টেড থিওরি। তীব্র আক্রমণের শিকার হয় সেটি। গ্যামো-আলফারের যুক্তিকে খণ্ডন করতে গিয়ে তাচ্ছিল্যভরে তিনি উচ্চারণ করলেন, ‘হাঃ, সেই উত্তপ্ত বিগ ব্যাং! এই বিস্ফোরণের ধারণা যদি ঠিক হয় তবে তার ছাইভস্ম কিছু অবশিষ্ট থাকার কথা। আমাকে সেই ফসিল এনে দেখাও।’ </p> <p>পিএইচডির শেষদিকে এসে আলফার ও গ্যামো যৌথভাবে একটা প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। সেই প্রবন্ধে গ্যামো বলেছিলেন, ভয়ংকর মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে যদি মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে তার নমুনা আজও কিছু অবশিষ্ট থাকার কথা কথা। গ্যামো হিসাব কষে দেখান, বিস্ফোরণের সময় যেসব তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বা বর্ণালি সৃষ্টি হয়েছিল, প্রতিনিয়ত প্রসারণের ফলে মহাবিশ্বের সেইসব বর্ণালি তাপমাত্রা হ্রাস পেতে থাকে। বর্তমানে তার তাপমাত্রা হওয়া উচিত পরম শূন্য তাপমাত্রা (মাইনাস  ২৭৩ ডিগ্রি কেলভিন) থেকে ৫ কেলভিনেরও কম। মহাকাশে খুঁজলেই হয়তো এর দেখা মিলতে পারে। বিজ্ঞানীরা সেই বিকিরণের নাম দিয়েছিলেন কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা সিএমবিআর।</p> <p>তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট ডিক। সঙ্গে তাঁর ছাত্র জেমস পিবলস। দুজন মিলে সেই অতি শীতল প্রাচীন বর্ণালির সন্ধানে নেমে পড়েন। মহাবিশ্বে বিকিরণের উৎস কম নয়। অজস্র মাইক্রোওয়েভের ভিড়ে সিএমবিআরকে খুঁজে বের করা, খড়ের গাদায় হারানো সূচ খুঁজে বের করার চেয়ে লক্ষ-কোটিগুণ কঠিন ব্যাপার। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মস্তিষ্ক তো দুর্ধর্ষ গোয়েন্দাদের চেয়ে ক্ষুরধার। তাঁরা নানা সম্ভাবনার সঙ্গে কার্যকারণ মিলিয়ে বের করে ফেলেন কাঙ্খিত বস্তুকে খুঁজে পাওয়ার পথ। সিএমবিআর খুঁজে পাওয়ার একটা সম্ভবনা তো বাতলেই দিয়েছেন গ্যামো। সেই বিকিরণের তাপমাত্রা দেখে বের করা যাবে সিএমবিআরের হদিশ। তরঙ্গ দৈর্ঘ্য পর্যবেক্ষণ করে বিকিরণের তাপমাত্রার নির্ণয়ের একটা পদ্ধতি আগেই ছিল। সেটাই সিএমবিআর খুঁজতে ব্যবহার করতে চাইলেন ডিক আর পিবলস। সফলতার খুব কাছে চলে গিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।  </p> <p>১৯৬৫ সাল। দুই মার্কিন বিজ্ঞানী আর্নো পেনজিয়াস আর রবার্ট উইলসন তখন গবেষণা করছেন নিউজার্সির বেল টেলিফোন ল্যাবে। আসলে তাঁরা গবেষণা করছিলেন মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ নিয়ে। তাঁদের কাছে ছিল ২০ ফুট ব্যাসের একটা টেলিস্কোপ। মহাকাশের দূর অঞ্চল থেকে যেসব মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ আসে সেগুলো শনাক্তের জন্য ফাঁদ পেতেছিলেন তাঁরা। তবে সিএমবিআর আবিষ্কারের লক্ষ্য তাদের মোটেও ছিল না।</p> <p>পেনজিয়াস-উইলসনের কাছে বিশাল এক ডিটেকটর ছিল তাদের। একদিন সেই ডিটেকটের অচেনা এক গোলমাল (নয়েজ) ধরা পড়ে। কোথা থেকে আসছে এই গুঞ্জন—দুই বিজ্ঞানী ভেবে পেলেন না। তারা ভেবেছিলেন ডিটেকটরে নিশ্চয়ই ঝামেলা বেঁধেছে। খুঁজেপেতে ডিটেকটরের এক কোনায় পেলেন পাখির মল। বিজ্ঞানীদ্বয় ভাবলেন, পাখির মলই যত নষ্টের গোড়া। এর কারণেই বোধহয় ডিটেকটরে নয়েজ আসছে। মল পরিষ্কার হলো। বিজ্ঞানীরা ভাবলেন এবার নিশ্চয়ই নয়েজ আর থাকবে না। কিন্তু কোথায় কি, নয়েজ ক্রমাগত আসতেই থাকল। বিজ্ঞানীরা ভাবলেন তাহলে যন্ত্রে কোনো ত্রুটি-টুটি আছে বোধহয়। নানাভাবে পরীক্ষা করেও কোনো ত্রুটি পাওয়া গেল না।</p> <p>পেনজিয়াস আর উইলসন পড়লেন মহা সমস্যায়। মাথার চুল ছেঁড়ার যোগাড়। তখন ভাবলেন, মহাকাশের কোনো নির্দিষ্ট এলাকা থেকেই নয়েজটা আসছে বোধহয়। তো অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন ডিটেকটরের মুখ। কিন্ত না, কোনো লাভই হলো না। ফল সেই একই। ক্রমাগত আসছে গুঞ্জনটা। তাঁদের মাথায় তখন অন্যচিন্তা এলো। তাঁরা জানতেন, যদি কোনো শব্দ বা বিকিরণ পৃথিবীর আবহম-লের ভেতর থেকে আসে ডিটেকটরের মুখ সোজা ওপর দিকে ধরলে শব্দের তীব্রতা অনেক বেশি পাওয়া যায়। তুলনায় দিগন্তের দিকে মুখ রাখলে নয়েজের তীব্রতা অনেক কম হবে। কিন্তু পেনজিয়াস-উইলসন দেখলেন ডিটেকটরের মুখ যেদিকেই রাখা হোক, নয়েজের তীব্রতা একই থাকছে। তাঁরা নিশ্চিত হলেন এ নয়েজ আসছে দূর মহাকাশ থেকে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেটা আসছে মহাবিশ্বের সব দিক থেকে এবং সমানভাবে। আরও পরে আবিষ্কার করেন, এই নয়েজ ছায়াপথ গ্যালাক্সির বাইরে থেকে আসছে। </p> <p>কিন্তু এই নয়েজের উৎস কী? কোনোভাবেই সেটা মাথায় আসছিল না। তখন তাঁরা ডিক আর পিবলসের কাজের দিকে নজর দেন। এবং সেগুলো বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হন, তাঁরা যে নয়েজ আবিষ্কার করেছেন এগুলো সেই সিএমবিআর। নিজেদের অজান্তেই পেনজিয়াস আর উইলসন সেটা আবিষ্কার করে ফেলছিলেন। কিন্তু প্রমাণ করলেন ডিক আর পিবলসের পথ ধরেই। পেনজিয়াস সেই তরঙ্গের উৎসের তাপমাত্রা বের করে ফেললেন। মাত্র ৩ কেলভিন! আশ্চর্য ব্যাপার! তাহলে এই বিকিরণ কি সেই গ্যামোর বলা আদীম বিকিরণ? গ্যামো বলেছিলেন, আদিম বিকিরণের তাপমাত্রা এখন দাঁড়াবে ৫ কেলভিনেরও কম। </p> <p>অন্যদিকে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী বব ডিক এবং জেমস পিবলস আসালে জর্জ গ্যামোতে মজেছিলেন। ফ্রেড হয়েল যেমন তাচ্ছিল্য বলেছিলেন বিগব্যাংয়ের ফসিল থাকার কথা। তেমনটাই বলেছিলেন জর্জ গ্যামো। মহাবিস্ফোরণের পর উৎতপ্ত শিশু মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছিল, তার থেকে যে আলোকরশ্মি বিকিরিত হয়েছিল তা এখনো থাকার কথা। অন্তত ডিক আর পিবলস সেটা বিশ্বাস করতেন।  তাঁরা হিসাব কষে দেখেছিলেন, সেই আদীম বিকিরণ কালের বিবর্তনে মাইক্রো ওয়েভ বিকিরণে পরিণত হয়েছে। তাঁরা সেই বিকিরণই খুঁজছিলেন ডিটেকটরে। </p> <p>ওদিকে পেনজিয়াস আর উইলসন এই সম্ভবনাটার কথাই ভাবলেন। ভাবলেন তাঁরা হয়তো ডিক আর পিবলসের আদী তরঙ্গই খুঁজে পেয়েছেন। হিসাব-নিকাষ কষে সে কথাই প্রমাণিত হলো। মহা এক আবিষ্কার। এটা ছিল ফ্রিডম্যানের প্রথম অনুমানের প্রমাণ। আসলে নয়েজটা ছিল মহাবিশ্বের প্রসারণের কারণে বিকিরত তরঙ্গ। এটা ছিল মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব প্রমাণের দিকে একধাপ এগিয়ে যাওয়া। এর স্বীকৃতিও পেলেন পেনজিয়াস-উইলসন জুটি। ১৯৭৮ সালে তাঁদের হাতে উঠল পদার্থবিদ্যার নোবেল। এটা তাঁদের প্রাপ্যই ছিল। কিন্ত ডিক আর পিবলস কেন নয়। তাঁরা একটা পথ দেখিয়েছেন, সেই পথে হেঁটে নোবেল পেয়েছেন পেনজিয়াস আর উইলসন, তাহলে ডিক আর পিবলস কেন নয়? </p> <p>পেনজিয়াস আর উইলসনের সৌভাগ্য, তাঁরা না চেয়েও পেয়ে গেছেন। অন্যদিকে ডিক-পিবলসের দুভার্গ্য—তাঁরা চেয়েও পেলেন না। ডিক-পিবলস নোবেল বঞ্চিত হলেন। বঞ্চিত হয়েছিলেন জর্জ গ্যামোও। কারণ তিনি নোবেল পুরস্কার নেওয়ার জন্য ততদিন বেঁচে ছিলেন না।</p> <p>রবার্ট ডিকও মারা গেছেন বহুদিন হলো। তবে এখনো বেঁচে আছেন জেমস পিবলস। আর বেঁচে আছেন বলেই ২০১৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেলটা আরও দুই বিজ্ঞানীর সঙ্গে তাঁর হাতে উঠল। অবশ্য অন্য দুজনের গবেষণা ছিল এক্সোপ্ল্যানেট নিয়ে। অন্যদিকে পিবলসের গবেষণটা ছিল কসমোলজি নিয়ে। তিনি কসমোলজির জন্য একটা ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন। সেই ফ্রেমওয়ার্কের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করা সম্ভব হয়েছে মহাবিশ্বের ইহিতাস। আবার সিএমবিআর নিয়ে তাঁর যে গবেষণা সেই, সেখানে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি নিয়ে যত গবেষণা আছে, সেটারও ভিত্তি হিসে গড়ে উঠেছে।</p> <p>অনেক দেরিতে হলেও পিবলসের হাতে যে নোবেল পুরস্কারটা উঠেছে, এটা সারা বিশ্বের বিজ্ঞানপ্রেমীদের জন্য স্বস্তির। কারণ স্টিফেন হকিংয়ের মতো পিবলসকে নোবেল বঞ্চিতদের চিরস্থায়ী তালিকায় থাকতে হলো না। শেষ বয়সে এসে তাঁর নামটা কাটা পড়ল সেই তালিকা থেকে।<br /> সূত্র : স্পেস ডট কম</p>