<p>রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রাখতে হলে জনগণকে রাজনৈতিক সচেতন হতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিনিয়ত সম্মিলিত প্রতিরোধ জারি রাখতে হবে সব স্তরে। স্বপ্নের বাংলাদেশ পেতে হলে একটি লড়াকু অস্তিত্ব সচেতন মানুষদের নিরন্তরভাবে থাকতে হবে। </p> <p>স্বাধীন বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায়ের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের সার্বিক সংস্কার’ নিয়ে আলোচনা সভায় বক্তারা এই কথা বলেন। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) এই আলোচনা সভার আয়োজন করে। </p> <p>শুক্রবার (১ নভেম্বর) রাজধানীর গ্রিন রোডে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।  </p> <p><strong>বিচার ব্যবস্থা কঠিন এবং জনবিচ্ছিন্ন : নুরুল কবীর </strong></p> <p>আলোচনায় ইংরেজি দৈনিক নিউএজ-সম্পাদক নুরুল কবীর বলেন, ভাষাগত কারণে বিচার বিভাগ জনবিচ্ছিন্ন। তিনি বলেন, ‘দেশের নাম বাংলাদেশ। অধিকাংশ মানুষ বাঙালি। কিন্তু আদালতের ভাষা ইংরেজি। সবকিছু মিলিয়ে একজন কৃষক বা সাধারণ মানুষ আদালতের দ্বারস্ত হলে সে বুঝবেই না, রায় বা আদেশ তার পক্ষে হলো না বিপক্ষে হলো। </p> <p>এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় উল্লেখ করে এই সাংবাদিক বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে তা কখনোই সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না। সব মিলিয়ে বিচার ব্যবস্থা নিজেই এত কঠিন যে, জনবিচ্ছিন্ন।’ </p> <p>সংবিধান নিয়ে নুরুল কবীর বলেন, ‘প্রশ্ন উঠেছে, নতুন করে সংবিধান লেখা হবে না সংস্কার করা হবে। এ নিয়ে বিতর্ক চলছে। সংবিধান হচ্ছে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা। সংবিধানের আইন বদলাতে হলে জনমত লাগবে। জনগণের কাছে যেতে হবে। গণভোট লাগবে। গণভোট চুরি-চুপটি করে করলে হবে না। দীর্ঘদিন সুনির্দিষ্ট প্রচারণা চালিয়ে করতে হবে। কী কারণে বদলানো হবে তা জনগণের কাছে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে। জনগণকে বুঝিয়ে বলতে হবে।’ </p> <p>রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক দলের সংস্কার না হলে কাজ হবে না বলেও মন্তব্য করেন এই সাংবাদিক। </p> <p>বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে নুরুল কবীর বলেন, ২০১২ সালে ১২ বছর আগে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় করার জন্য সরকারকে চিঠি দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি। উত্তর পর্যন্ত দেয়নি। গত ১২ বছরে সুপ্রিম কোর্ট কি আর কোনো চিঠি দেয়নি। যেসব বিচারকদের মধ্যে রাজনৈতিক দাসত্ব আছে তারাও স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা না হওয়ার জন্য দায়ী।</p> <p>তিনি বলেন, আমাদের প্রতিনিয়ত সম্মিলিত প্রতিরোধ দরকার। এই সম্মিলিত প্রতিরোধটা জারি রাখতে হবে সব স্তরে। স্বপ্নের বাংলাদেশ পেতে হলে একটি লড়াকু অস্তিত্ব সচেতন মানুষদের নিরন্তরভাবে থাকতে হবে।</p> <p><strong>পেশাগত স্বাধীনতার জন্যও স্বাধীনতা বিচার বিভাগ জরুরি : সারা হোসেন </strong></p> <p>সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘সবকিছু রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যাবে না। দুই ধাপি এগিয়ে এক ধাপ পিছিয়েই আমাদের সবসময় অনেক সময় এগুতে হয়েছে। অনেকেই বলছেন, একাত্তরকে (মুক্তিযুদ্ধকে) অস্বীকার করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগকে অস্বীকার করা হচ্ছে। তার স্বীকারই করতে চাচ্ছেন না, জুলাইয়ে যা ঘটেছে বাংলাদেশে সেটিকে প্রথমে স্বীকার করতে হবে। বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নিয়ে যখন আমরা কথা বলব তখনো আমাদের ভাবতে হবে আমরা কোথায় ছিলাম।’ </p> <p>শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতের বিচারকদের ভূমিকা তুলে ধরে সারা হোসেন বলেন, ‘বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই স্বাধীনতা শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে হলে হবে না। বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টদের পেশাগত স্বাধীনতাও নিশ্চিত করতে হবে। পেশাগত স্বাধীনতা তৈরি করার জন্য অবশ্যই নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণগুলো সরাতে হবে। যে কারণে বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় খুবই জরুরি।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে। প্রক্রিয়াটা হতে হবে মানদ্লভিত্তিক। মানদ্ল নির্ধারণের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় আছে। এই রায়ের ভিত্তিতে একটি আইন হতে পারে। তবে বিচার বিভাগ সংস্কারের প্রক্রিয়াটাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য পর্যবেক্ষণ-তদারকিতে রাখতে হবে।’ </p> <p>বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুমিন ফারহানা বলেন, ‘স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় মাসদার হোসেন মামলার ১২ দফা নির্দেশনা কোনো রাজনৈতিক সরকার (আওয়ামী লীগ-বিএনপি) মানেনি। কারণ কোনো রাজনৈতিক সরকার কখনো চায় না বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করুক। রাজনৈতিক সরকার কখানো চায় না, বিচার বিভাগ একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘রাজা তুমি অপরাধ করেছ’ এই কথা বলার সাহস করুক। রাজনৈতিক সরকার কখানো চায় না, বিচার বিভাগ প্রশ্ন তুলুক ভীন্ন মতের বা, ভীন্ন দলের লোকদের বিরুদ্ধে কেন মামলাগুলো হচ্ছে। এরকম বিচার বিভাগ আমাদের রাজনৈতিক সরকারগুলো কোনো দিনও চায়নি।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশে যখন যেই দল ক্ষমতায় আসে তারা কিছুতেই কোনো অবস্থাতেই তাদের ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ হোক তা চায় না। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসবে কি আসবে না সে অনিশ্চয়তা তৈরি হোক, তা চায় না। দিন শেষে বিষয়টা মানুষের হাতে থাকুক, এই অনিশ্চয়তা তারা রাজনৈতিক সরকারগুলো নিতে চায় না। তারা মনে করে একবার যখন বসেছি আর কোনোভাবেই নামব না। যে কারণে চতুর্থ সংশোধনী দিয়ে আজীবন রাষ্ট্রপতি থাকার ঘোষণা সংবিধানে দিয়ে ফেলতে পারি। যে কারণে আমরা মেয়াদের পর মেয়াদ কোনো রকম কোনো নির্বাচন ছাড়া বুক ফুলিয়ে সরকারে থাকতে পারি। যে কারণে আমরা বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে (বিএনপিকে ইঙ্গিত করে) তত্ত্বাবধায়ক সরকারটা যেন আমার পক্ষে থাকে। এক্ষেত্রে কোনো সরকারেক খুব বেশি আলাদা করার সুযোগ নেই।’</p> <p>সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ নিয়ে এই আইনজীবী বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগে কোনো সরকাই আইন করেনি। কারণ বিচারক আমার পছন্দের মতো হতে হবে। আমার মতের বিচারক হতে হবে। আমি যা চাইব বিচারক সেইমতো কাজ করবেন, না হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো একটি রাজনৈতিক বিষয় কিভাবে আদালত দ্বারা নির্ধারিত হয়?’</p> <p><strong>বিচার বিভাগে ভয়াবহ বলপ্রয়োগ হয়েছে : জ্যেতির্ময় বড়ুয়া</strong></p> <p>বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যেতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘অধস্তন আদালতের পাশাপাশি উচ্চ আদালতও সবসময় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে ছিল। উচ্চ আদালতে রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে কখনো বিচারক নিয়োগ হয়নি।’</p> <p>বিচার বিভাগ নিয়ে এখন যে নৈরাজ্যটা শুরু হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগ, বিচারপতিদের সম্মান-মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব যেমন আইনজীবীদের, নাগরিকদের, তেমনি বিচারপতিদেরও। শিক্ষার্থীরা বড় রকমের একটা ভূমিকা পালন করেছে সরকারকে উৎখাতের ক্ষেত্রে। জনগণেরও সেখানে সম্মতি ছিল। কিন্তু সবকিছু পরিবর্তনের জন্য যেভাবে বলপ্রয়োগ করার নীতিটা এখন শুরু হয়েছে, এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। এই ধরনের সংস্কৃতি কোনোভাবেই বিচার বিভাগকে সবল করছে না বরং আরো দুর্বল করছে। আমাদের বিচার বিভাগ যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দাঁড়াতে পারছে না, সেটাতে এই বল প্রয়োগ নতুন মাত্রা যোগ করেছে।‘</p> <p>এই আইনজীবী বলেন, ‘বিগত সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগলো ধ্বংস করেছে। এখন আমরা নতুন একটি রূপ দেখতে পাচ্ছি। যেটা আরো ভয়াকহভাবে হাজির হচ্ছে। এটি বিচার বিভাগের জন্য হুমকি। যদি সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকে তাহলে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিচারককে অপসারণের দাবি তুলতে পারেন। কিন্তু পেশিশক্তি দেখিয়ে তা করতে পারেন না। যখন বলা হচ্ছে অমুক বিচারক হচ্ছেন ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর, তখন বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা সম্মানকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এই জায়গায় আমাদের সতর্ক হতে হবে।’</p> <p>বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভের মুখে হাইকোর্টের ১২ জন বিচারপতিকে বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে এই আইনজীবী বলেন, একজন নাগরিক হিসেবে এবং একজন পেশাজীবী হিসেবে সেটির প্রতিবাদ জানিয়ে রাখলাম। হাইকোর্টের যে ১২ জন বিচারপতিকে যে কায়দায় ছুটিতে পাঠানো হয়েছে বা ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের মাঝখানে গিয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেল যেভাবে কথাগুলো বলেছেন কোনোটাই শোভন কোনো চর্চা ছিল না। এটা কোনো সুস্থ পদ্ধতি হতে পারে না।’</p> <p>আলোচনায় আরো অংশ নেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক রিদওয়ানুল হক। </p>