<p>প্রেম, ভালোবাসা এবং বিশ্বাস—এগুলো জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ও সংবেদনশীল বিষয়। কিন্তু যখন এসবের মধ্যে ফাটল ধরে, তখন তা কেবল দুটি মানুষের নয়, গোটা একটি পরিবারের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। আজকের সমাজে প্রবাসীদের জীবনে ঘটে যাওয়া পরকীয়ার ঘটনা আমাদের গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো-</p> <p><strong>এক. </strong>মাদারীপুরের চরনাচনা গ্রামের এক ইতালি প্রবাসী পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিয়ে করেন। বিয়ের কিছুদিন পরই তিনি ইতালি ফিরে যান এবং নিয়মিত স্ত্রীর নামে ব্যাংকে টাকা পাঠাতেন। তার বিশ্বাস ছিল, স্ত্রী সংসার সামলাচ্ছেন সঠিকভাবে। কিন্তু মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নোয়াখালীর এক তরুণের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন তার স্ত্রী। এর জেরে প্রবাসী স্বামীর পাঠানো স্বর্ণালঙ্কার এবং ২০ লাখ টাকা নিয়ে তিনি পালিয়ে যান।</p> <p><strong>দুই.</strong> বগুড়ার সান্তাহারে আরেক প্রবাসীর স্ত্রী ১০ লাখ টাকা এবং চার ভরি স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে পালিয়ে যান। চার বছরের প্রবাসজীবনে উপার্জিত সব অর্থ স্ত্রীর নামে পাঠাতেন ওই ব্যক্তি। কিন্তু তার স্ত্রী গ্রামের এক ব্যক্তির সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর তিনি সংসারের টাকা, গয়না এবং আসবাবপত্র নিয়ে পালিয়ে যান।</p> <p><strong>তিন.</strong> ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সোনাবালুয়া গ্রামের এক বৃদ্ধ বলেন, মেয়ের এমন কাজের জন্য লোকের মুখে কথা শুনতে হয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে বিষপান করি। কিন্তু নাবালক নাতিদের কথা ভেবে পারি না। তার মেয়ে, দুই সন্তানের জননী, সৌদি প্রবাসী স্বামীর প্রায় তিন কোটি টাকা ও ৩২ ভরি স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে বাড়ির নির্মাণশ্রমিকের সঙ্গে পালিয়ে যান।</p> <p><strong>বাস্তবতা</strong></p> <p>এমন ঘটনা শুধু মাদারীপুর, বগুড়া বা ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায়ই ঘটছে। পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিয়ে কিংবা প্রেমের মাধ্যমে হওয়া দাম্পত্য সম্পর্কগুলোয় স্ত্রীরা পরকীয়ায় জড়িয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু পালানো নয়, প্রবাসী স্বামীর পাঠানো অর্থ ও সম্পদ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু সম্পর্কের ভাঙন নয়, এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতা ও ভালোবাসার অপমান। প্রশ্ন জাগে, কেন এমন হচ্ছে? কেন সম্পর্ক, বিশ্বাস ও ভালোবাসার মধ্যে ফাটল ধরছে?</p> <p><strong>প্রবাস জীবনের একাকিত্ব</strong></p> <p>একটি সম্পর্ক টিকে থাকে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সময় দেওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু একজন প্রবাসী যখন পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জনে দূরদেশে যান, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই সম্পর্ক একপাক্ষিক হয়ে পড়ে। স্বামী তার দায়িত্ব পালন করেন অর্থ পাঠিয়ে, কিন্তু স্ত্রী সেই শূন্যতা কীভাবে পূরণ করবেন? দিনের পর দিন একা থাকতে থাকতে একঘেয়েমি ও একাকীত্ব যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তখনই দুর্বলতা এসে ভর করে। অনেক সময় এই শূন্যতা পূরণের জন্যই নারীরা ভুল সিদ্ধান্ত নেন, যা বিশ্বাসঘাতকতায় রূপ নেয়।</p> <p><strong>বিশ্বাস ভাঙনের পেছনে কারণ</strong></p> <p>প্রবাসী স্বামীদের সঙ্গে স্ত্রীর মানসিক সংযোগ কমে গেলে, সম্পর্কের গভীরতা নষ্ট হতে শুরু করে। দীর্ঘদিন দূরে থাকার কারণে সম্পর্কের উষ্ণতা হ্রাস পায়। পারিবারিক সিদ্ধান্তে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যা তৈরি করে। যেখানে সম্পর্কের ভিত্তি ভালোবাসা নয়, সেখানে বিশ্বাস ও দায়িত্বের জায়গায় ফাটল ধরতে বেশি সময় লাগে না। প্রবাসী স্বামীর পাঠানো অর্থ বা সম্পদ ব্যবহারে স্ত্রীর স্বাধীনতা কখনো কখনো লোভে পরিণত হয়। স্বামীর থেকে দূরে থাকায় কেউ কেউ এই অর্থ অন্যত্র বিনিয়োগ করেন, যা পরে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করে। প্রবাসীদের স্ত্রীরা সমাজের নানা নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হন। এসবের প্রভাবে তাদের মানসিক চাপ বাড়ে, এবং তারা কখনো ভুল পথে পা বাড়ান।</p> <p><strong>সমাধানের উপায়</strong></p> <p>প্রবাসে থাকলেও স্বামী-স্ত্রীর নিয়মিত যোগাযোগ থাকা জরুরি। প্রযুক্তির এই যুগে ভিডিও কল, মেসেজিং অ্যাপ কিংবা ফোনের মাধ্যমে সম্পর্কের উষ্ণতা ধরে রাখা সম্ভব। যেকোনো বিয়ের আগে স্বামী-স্ত্রীর মানসিক প্রস্তুতি ও বোঝাপড়া নিশ্চিত করা উচিত। পারিবারিকভাবে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেও তাদের একসঙ্গে কিছু সময় কাটানোর সুযোগ দেওয়া উচিত। সম্পদ ও অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা রাখা উচিত। স্ত্রীর কাছে পাঠানো অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে তাকে যথাযথ দায়িত্বশীলতার জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। সমাজের নেতিবাচক মন্তব্য ও কুসংস্কার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পরিবারগুলোর সচেতন হওয়া প্রয়োজন। প্রবাসী পরিবারগুলোকে মানসিক সমর্থন দেওয়া এবং তাদের সমস্যাগুলো উপলব্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ।</p> <p><strong>বিশেষজ্ঞরা কী বলেন</strong></p> <p>প্রবাসী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দীর্ঘদিনের দূরত্ব, মানসিক সংযোগের অভাব এবং একাকিত্ব সম্পর্কের ফাটলের প্রধান কারণ। অনেক সময় তাড়াহুড়ো করে বা পারিবারিক চাপে বিয়ে হলে সম্পর্কের ভিত্তি দুর্বল হয়, যা ভালোবাসা ও বিশ্বাসের অভাব তৈরি করে। প্রবাসে উপার্জিত অর্থ ও সম্পদের স্বাধীন ব্যবহারে কখনো লোভ জন্মায়, যা ভুল সিদ্ধান্তে প্ররোচিত করে। পাশাপাশি সমাজের নেতিবাচক মন্তব্য ও কুসংস্কার মানসিক চাপ বাড়ায়। বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত যোগাযোগ, বোঝাপড়া বৃদ্ধি, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এবং পরিবার ও সমাজের সহযোগিতামূলক মনোভাবকে এ সমস্যার সমাধানে কার্যকর বলে মনে করেন।</p> <p><strong>ধর্মীয় মূল্যবোধের নির্দেশনা</strong></p> <p>দাম্পত্য জীবনে পরকীয়া গুরুতর পাপ এবং অপরাধ। ইসলাম ধর্মে এটি স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ, যেখানে কুরআনে বলা হয়েছে, ব্যভিচারের ধারে-কাছেও যেয়ো না; এটি অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট পথ। (সূরা আল-ইসরা, আয়াত ৩২)। খ্রিস্টধর্মে বিবাহকে ঈশ্বরপ্রদত্ত পবিত্র বন্ধন হিসেবে বিবেচনা করে, যেখানে পরকীয়া বিশ্বাসঘাতকতা বলে গণ্য। হিন্দুধর্মেও দাম্পত্য জীবনে সততা এবং পারস্পরিক দায়িত্বশীলতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সকল ধর্মেই দাম্পত্য জীবনে সততা, পারস্পরিক বিশ্বাস এবং দায়িত্বশীলতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। পরকীয়া শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ককেই নষ্ট করে না বরং সমাজে অশান্তি এবং অবিশ্বাস ছড়ায়। ধর্মীয় মূল্যবোধের নির্দেশনা হলো, সম্পর্কের যে কোনো সমস্যায় ধৈর্য ধরে কথা বলা এবং পারস্পরিক সমাধানের পথ খুঁজে নেওয়া, যেন বিশ্বাস অটুট থাকে এবং পাপ থেকে বিরত থাকা যায়।</p> <p><strong>শেষ কথা</strong></p> <p>বিশ্বাস আর ভালোবাসা একটি সম্পর্কের মূল ভিত্তি। কিন্তু যখন দূরত্ব ও একাকিত্ব এই ভিত্তি নষ্ট করে দেয়, তখন সম্পর্ক ভেঙে যায়। প্রবাসী স্বামীরা তাদের জীবনের সবকিছু ছেড়ে প্রিয়জনের জন্য প্রবাসে যান, অথচ তাদের এমন করুণ পরিণতি মেনে নেওয়া সত্যিই বেদনাদায়ক। সম্পর্ক রক্ষা করতে হলে বিশ্বাসের দেয়াল আরো মজবুত করতে হবে। পরিবার, সমাজ এবং ব্যক্তি—সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তবেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।</p>