<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">গত ২৭ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদ হার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বা ০.৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে। এর ফলে ওভারনাইট রেপো সুদের হার বৃদ্ধি পেয়ে ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর এই নীতি সুদ হার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি করা হয়েছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসের শাসন মেয়াদে দেশে নীতি সুদ হার দ্বিতীয়বার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক মাত্র এক মাসের ব্যবধানে তাদের নীতি সুদ হার ১০০ বেসিস পয়েন্ট বা ১ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। এই নীতি সুদ হার বৃদ্ধির ফলে দেশে আমানত এবং ঋণ, উভয়ের ওপর সুদের হার বেড়ে যাবে। তবে আমানতের ওপর যে হারে সুদের হার বৃদ্ধি পাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি হারে ঋণের ওপর সুদের হার বাড়বে বলেই আমাদের ধারণা। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা অন্তত সেটিই বলে। কেননা দেশে যখনই নীতি সুদ হারের পরিবর্তন হয়, তখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের আমানতের ওপর প্রদত্ত সুদের হার যেভাবে পরিবর্তন করে, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিবর্তন করে ঋণের ওপর ধার্য সুদ। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><img alt="নীতি সুদ হার বৃদ্ধি কতটা কাজে আসবে" height="272" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/11.November/14-11-2024/1.jpg" style="float:left" width="321" />বাংলাদেশ ব্যাংকের এবারের নীতি সুদ হার পরিবর্তনের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। প্রথমত, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মাত্র এক মাসের মধ্যে তাদের নীতি সুদ হার ১ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে, যা এককথায় নজিরবিহীন বলা যেতে পারে। বিশ্বের আর কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এত বেশি নীতি সুদ হার বৃদ্ধি করেছে কি না আমার জানা নেই। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদ হার বৃদ্ধি করেছে এমন এক সময় যখন দেশ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিরাজ করছে এক ধরনের অস্থিরতা এবং ব্যবসায়ীরা আছেন উদ্বেগের মধ্যে। ব্যাংকিং খাতে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে। বিশেষ করে কয়েকটি ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের চাহিদামাফিক অর্থ ফেরত দিতে পারছে না তারল্য সংকটের কারণে। এহেন পরিস্থিতিতে নীতি সুদ হারের পরিবর্তে সবার আগে প্রয়োজন দেশের ব্যাংকিং খাত এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সময় তাদের নীতি সুদ হার বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যখন সমগ্র বিশ্ব সুদহার হ্রাসের যুগে প্রবেশ করছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো তো বটেই, অনেক উন্নয়নশীল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নীতি সুদ হার হ্রাস করেছে এবং ভবিষ্যতে আরো হ্রাস করবে মর্মে পূর্বাভাস আছে। ফলে বিশ্বব্যাপী সুদহারের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বিপরীত অবস্থানে থাকবে।  </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অতীতের মতোই বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নীতি সুদ হার বৃদ্ধির পেছনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছে। এটিই স্বাভাবিক। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, বিশ্বের সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকই তাদের নীতি সুদ হার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে। বাস্তবে নীতি সুদ হার হ্রাস-বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেই আলোচনা এখন বিশ্বব্যাপী জোরেশোরেই চলছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ উন্নত বিশ্বে, যেখানে খুবই সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা বিদ্যমান এবং সেই সঙ্গে আছে মানসম্পন্ন মূল্য নির্ধারণ (প্রাইসিং) পদ্ধতি, সেসব দেশেও নীতি সুদ হার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতি সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দাবি অনুসারে মূল্যস্ফীতি এখন তাদের লক্ষ্যমাত্রা ২ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু বাজারে গিয়ে জিনিসপত্রের মূল্য কমতে দেখা যায় না। কর্তৃপক্ষও পরোক্ষভাবে বিষয়টি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। আর এ কারণেই এখন মূল্যস্ফীতির একাধিক সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা চলছে; যেমন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মৌলিক মূল্যস্ফীতি, অ-মৌলিক মূল্যস্ফীতি এবং গড় মূল্যস্ফীতি।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদ হার বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে, তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও সাধারণ মানুষের কষ্ট যে আরো বেড়ে যাবে, তা তো আর বুঝতে অসুবিধা হয় না। বিশেষ করে ঋণনির্ভর সমাজব্যবস্থায় নীতি সুদ হার বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের অর্থকষ্ট লাঘবের পরিবর্তে আরো বাড়িয়ে দেয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এখন আমরা ঋণনির্ভর সমাজব্যবস্থায় বসবাস করছি। উন্নত বিশ্বে প্রায় শতভাগ মানুষ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করে থাকে। আমাদের দেশে শতভাগ না হলেও বড় একটি জনগোষ্ঠী ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ধরনের ঋণ নিয়ে তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করে থাকে। আমরা এমন এক বাস্তবতায় এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে ঋণ গ্রহণ  ছাড়া জীবন যাপন করাই প্রায় অসম্ভব। অন্য কোনো ঋণের কথা বাদ দিলেও ক্রেডিট কার্ড, ব্যক্তিগত লাইন অব ক্রেডিট এবং বাড়ি বা ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য বন্ধকি ঋণ এড়িয়ে চলার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি যারা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে সংসার চালায়, তারাও ব্যাংক থেকে কিছু ব্যক্তিগত লাইন অব ক্রেডিট নিয়ে রাখে আপৎস্যলীন সমস্যা কাটিয়ে ওঠার উদ্দেশ্যে। ফলে অন্যান্য অত্যাবশ্যিক খরচের মতো গৃহীত ঋণের ওপর প্রদত্ত সুদও অত্যাবশ্যিক খরচে পরিণত হয়েছে। এ রকম অবস্থায় যখনই নীতি সুদ হার বৃদ্ধি করা হয়, তখনই তাদের মাসিক আর্থিক খরচ বেড়ে যায়। এটি কিভাবে হয়, তা একটি কাল্পনিক উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ধরা যাক, নীতি সুদ হার বৃদ্ধির আগে একজন ব্যক্তির মাসিক সাংসারিক খরচ ৫০ হাজার টাকা এবং গৃহীত ঋণের ওপর সুদ বাবদ মাসিক খরচ ২০ হাজার টাকা। সুতরাং সেই ব্যক্তির মাসিক সাংসারিক খরচ ৭০ হাজার টাকা। পরে যখন নীতি সুদ হার বৃদ্ধি করা হবে, তখন ব্যাংকগুলো প্রদত্ত ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দেবে। এহেন পরিস্থিতিতে সেই ব্যক্তির সুদ বাবদ খরচ মাসে ২০ হাজার থেকে বেড়ে ৩০ হাজার টাকা হয়ে যাবে। আলোচনার সুবিধার্থে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে নীতি সুদ হার বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি কিছুটা হ্রাস পাবে এবং এর প্রভাবে সেই ব্যক্তির মাসিক সাংসারিক খরচ কিছুটা কমে মাসে ৪৫ হাজার টাকা হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে তার সুদ বাবদ আর্থিক খরচ মাসে বৃদ্ধি পেয়ে হবে ৩০ হাজার টাকা। সার্বিকভাবে আলোচ্য ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির মোট সাংসারিক খরচ মাসে ৭০ হাজার থেকে বেড়ে ৭৫ হাজার টাকা হবে শুধু নীতি সুদ হার বৃদ্ধির কারণে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এভাবে দ্রুত নীতি সুদ হার বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি কতটা হ্রাস পাবে, তা হয়তো ভবিষ্যৎ বলতে পারবে। কিন্তু এর ফলে দেশে যে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হবে, তা খুব সহজেই অনুমেয়। একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে যে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির পেছনে যেমন মুদ্রানীতির প্রভাব থাকে, তেমনি থাকে মুদ্রানীতি বহির্ভূত কিছু উপাদান। নীতি সুদ হার পরিবর্তনের মাধ্যমে হয়তো মুদ্রানীতির প্রভাব কিছুটা পড়লেও পড়তে পারে, কিন্তু মুদ্রানীতি বহির্ভূত উপাদানগুলো সেভাবেই থেকে যায় এবং এর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো হাত নেই। আরো একটি বিষয় খুবই প্রণিধানযোগ্য, তা হচ্ছে আমাদের মতো দেশে যেখানে বিশৃঙ্খল বাজারব্যবস্থা এবং মানসম্পন্ন মূল্যমান অনুসরণের বড়ই অভাব, সেখানে নীতি সুদ হার প্রয়োগ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না, তা অতীতে বহুবার প্রমাণিত। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশে একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সেই ব্যবসায়ী কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে আমার কথার বিরোধিতা করে আমাকে জানালেন যে নীতি সুদ হার হ্রাসের কারণে অবশ্যই মূল্যস্ফীতি কমবে। তিনি যুক্তি দেখিয়ে আরো জানালেন যে উচ্চ সুদের হারের কারণে ব্যবসায়ীরা আর সফলভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন না। দেনার দায়ে দেউলিয়া হয়ে যাবেন এবং অনেকে চাকরি হারাবেন। ফলে তাঁদের আর ক্রয়ক্ষমতা থাকবে না। তখন বাজারে চাহিদা কমে যাবে এবং মূল্যস্ফীতি এমনিতেই হ্রাস পাবে। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমি তাঁকে জানালাম যে এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে দেশে যে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হবে এবং যে বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখা দেবে, তার প্রভাবে মারাত্মক সামাজিক কষ্ট বেড়ে যাবে। এ রকম অস্বাভাবিক অবস্থায় মূল্যস্ফীতি তো হ্রাস পাবেই না, উল্টো মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়ে চরম মূল্যস্ফীতিতে (হাইপার ইনফ্লেশন) পরিণত হবে। আমার এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে সেই ব্যবসায়ী ব্যক্তি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আলোচনায় ক্ষান্ত দিলেন। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">নীতি সুদ হার বৃদ্ধি পেলে মূল্যস্ফীতি কতটা হ্রাস পেতে পারে এবং অন্যান্য সমস্যা কেমন হতে পারে, তা আমরা যতটা জানি, তার চেয়ে অনেক বেশি জানেন বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তাঁরা দুজনই এই বিষয়ে যেমন বিজ্ঞ, তেমনি অভিজ্ঞ। তাঁদের ক্যারিয়ারের সারাটা সময় কেটেছে অর্থনীতি এবং মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মধ্যে। ফলে তাঁরা অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে ও ভেবেচিন্তেই এত দ্রুত এবং এত অধিক হারে নীতি সুদ হার বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেই আমাদের ধারণা। আর এই ধারণা সঠিক হলে দেশে মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু তেমনটি না হয়ে বাহ্যিক কোনো বিবেচনা থেকে, বিশেষ করে আইএমএফের সুপারিশে যদি নীতি সুদ হার বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে হয়তো প্রত্যাশিত ফল না-ও পাওয়া যেতে পারে। এখন আমাদের দেখার বিষয় হচ্ছে এভাবে অল্প সময়ের ব্যবধানে পর পর দুই দফা নীতি সুদ হার বৃদ্ধি কতটা কাজে আসে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">nironjankumar_roy@yahoo.com</span></span></span></span></p> <p> </p>