<p>১৪ অক্টোবর। দুই চোখের পাতা এক করতে পারেননি সেলিনা বেগম। রাতভর বিছানায় ছটফট করেছেন। সকাল হতেই অপেক্ষা—কখন ছেলের এইচএসসির ফল জানা যাবে। প্রহর যেন ফুরাচ্ছিলই না। একটু পর পর ছোট ছেলেকে বলছিলেন, ‘আবার একটু ওয়েবসাইটে ঢুকে দ্যাখ না, সোহানের রেজাল্ট দিছে কি না।’</p> <p><img alt="হার না-মানা মা ও ছেলে" height="69" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/10.October/19-10-2024/88999.jpg" style="float:left" width="219" />সকাল ১১টার দিকে ছোট ছেলে চিৎকার করে বলল, ‘মা, ভাইয়া পাস করছে! ৪.৪২ পাইছে।’</p> <p>শোনামাত্র সব শক্তি দিয়ে যেন বিছানা থেকে উঠে গেলেন সোহান! মায়ের বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন, ‘আম্মু, তোমার আশা পূরণ হইছে। আমি পাস করেছি!’</p> <p>খুশিতে মায়ের চোখে জল এসে গেছে। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘অনেক খুশি হইছি রে, বাপ!’</p> <p>সন্তানের সাফল্যে যেকোনো মা খুশি। তবে সেলিনা হোসেনের খুশির আরো কারণ রয়েছে। পাস-ফেল দূরে থাক, ছেলে পরীক্ষায় বসার অনুমতি পাবে কি না, তা নিয়েই তো অনিশ্চয়তায় ছিলেন!</p> <p> </p> <p><strong>কেন এই অনিশ্চয়তা</strong></p> <p>২০০৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবসে পাবনার সুজানগরে সেলিনা-শাহজাহান দম্পতির ঘরেও আনন্দ বয়ে যায়। বিয়ের আট বছর পর সেলিনার কোলে এসেছে শিশু, যিনি আজকের এই সোহানুর রহমান সোহান।</p> <p>নবজাতক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। চিকিৎসক জানালেন, শিশুটি জন্ডিসে ভুগছে। রেডিওথেরাপি দিতে হবে। সাত দিন বয়সী শিশুটিকে সে যাত্রায় পাঁচ দিন থাকতে হয়েছিল হাসপাতালে।</p> <p>একসময় শিশুটিকে নিয়ে বাড়ি এলেন সেলিনা। দেখতে দেখেতে এক বছর পার হয়ে গেল, কিন্তু সোহান অন্য শিশুদের মতো স্বাভাবিক নড়াচড়া করতে পারেন না। এমনকি বসতেও সমস্যা।</p> <p>সোহানকে ঢাকায় নিয়ে এলেন মা-বাবা। চিকিৎসকরা জানালেন, ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছে সোহান। ও যে বেঁচে আছে—এটাই বেশি! ভবিষ্যতে কথা বলতে বা লোকজন চিনতেও সমস্যা হতে পারে। এ সমস্যা দীর্ঘদিন চলতে পারে, হয়তো সারা জীবন। সেলিনা হাল ছাড়ার পাত্রী নন। ওষুধের পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়ামও চালিয়ে গেলেন।</p> <p> </p> <p><strong>হাঁটতে শেখা</strong></p> <p>মায়ের পরিশ্রম বৃথা যায়নি। বছর দুয়েকের মাথায় প্রথম বসতে পারলেন শিশু সোহান। এবার দাঁড় করানোর চেষ্টা। উঠানে গলাসমান গর্ত খুঁড়ে সেখানে ছেলেকে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। তা ছাড়া ঘর থেকে উঠান পর্যন্ত একটা বাঁশ বেঁধে দিলেন সেলিনা। এটা ধরে সোহানকে দাঁড় করানোর ও হাঁটানোর চর্চা করাতে থাকলেন। একসময় শুধু বাঁশটা ধরিয়ে দিলেই হতো। সোহান উঠান পর্যন্ত পৌঁছে যেতেন। সাড়ে চার বছর বয়সে পুরোপুরি হাঁটতে শিখলেন শিশু সোহান।</p> <p>এরপর ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দিলেন একটা মাদরাসায়। সেলিনা ছেলেকে নিয়ে রিকশায় যেতেন। ক্লাসরুমে বসিয়ে বারান্দায় অপেক্ষা করতেন। মাঝেমধ্যে গিয়ে দেখেও আসতেন। ক্লাস শেষে আবার ফিরতেন। ঝড়-বৃষ্টিতেও থামতেন না। সাত মাসের মাথায় শাহজাহান আলী বদলি হলেন ঢাকায়। সেলিনার ঠিকানাও হলো রাজধানী। প্রথমে ব্লু-বার্ড কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করালেন। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে সোহানের ঠিকানা হলো আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ। পিএসসিতে জিপিএ ৫ এলো।</p> <p> </p> <p><strong>হঠাৎ একদিন</strong></p> <p>পারতপক্ষে ছেলেকে চোখের আড়াল করেন না সেলিনা। ২০১৭ সাল। সোহান তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। সেদিন ছিল সেলিনার ছোট ছেলেটার পিএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন। সোহান বললেন, ‘মা, তুমি ওকে দিয়ে আসো। আমি একা একাই থাকতে পারব।’</p> <p>ছোট ছেলেকে নিয়ে পরীক্ষার কেন্দ্রে গেলেন সেলিনা। পরে এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে খবর পেলেন, ‘দরজার সঙ্গে ধাক্কা লেগে সোহান মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।’ তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফিরে দেখলেন, ছেলেটা রীতিমতো কাঁপছে। কথাও জড়িয়ে যাচ্ছে। ঘাড় সোজা করে বসতে কিংবা দাঁড়াতে পারছে না। চিকিৎসক বললেন, ‘অপারেশনে সাফল্যের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ছেলেটা সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত। হাত-পায়ে ওর শক্তি সামান্য। ওকে নিয়ে অনেক ভুগতে হবে আপনাকে!’</p> <p> </p> <p><strong>অদম্য সোহান</strong></p> <p>সেই দুর্ঘটনার পর থেকে আর নিজে নিজে দাঁড়াতে পারলেন না সোহান। সব কিছুতে অন্যের ওপর নির্ভরতা। সেলিনার কষ্ট বাড়ল। বললেন, ‘কারো সাহায্য ছাড়া এক কদমও এগোতে পারে না। ক্লাসে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে আসতাম। ছুটির পর রিকশা-গাড়ি পাওয়া যেত না। ফুটপাতের রেলিং ধরে মা-ছেলে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কী যে কঠিন দিন গেছে আমাদের!’ </p> <p>নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগ বেছে নিলেন সোহান। পড়াশোনায় বরাবরই তুখোড়। বাঁ হাতে লেখেন। অন্যদের তুলনায় গতি কম। সুযোগ থাকা সত্ত্ব্বেও কোনো পরীক্ষায়ই শ্রুতিলেখক নেননি। এভাবে এসএসসিতেও জিপিএ ৫ পেয়েছেন।</p> <p> </p> <p><strong>সেই চ্যালেঞ্জে জিতেছেন</strong></p> <p>ছেলেকে নিয়ে লড়তে গিয়ে অনেকের অযাচিত মন্তব্যের শিকার হয়েছেন সেলিনা। তাঁর যুদ্ধ দেখে অনেকেই বলত, ‘আর পড়ানোর দরকার নেই।’ এমনকি একদিন স্কুলের এক শিক্ষকও সোহানকে বলেছিলেন, ‘এত কষ্ট করে পড়ালেখা করে এই সার্টিফিকেট দিয়ে তুমি কী করবে?’ শুনে খুব মন খারাপ হয়েছিল তাঁর।</p> <p>এসএসসির পর সোহান ভর্তি হয়েছিলেন নির্ঝর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে। টেস্ট পরীক্ষার সময়ও বিপত্তির মুখে পড়েন। বন্ধুদের পাশে বসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। টেস্ট পরীক্ষার সময় একদিন স্যার ওর বেঞ্চে বসা বন্ধুটিকে সরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘ফাইনালে তোমাকে একা পরীক্ষা দিতে হবে। এখন থেকে প্র্যাকটিস করো।’ এই ঘটনায় ভড়কে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন সোহান। </p> <p>কয়েক দিন পর সেলিনাকে ডেকে নিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ বলল, ‘এখান থেকে আপনার ছেলে পরীক্ষা দিতে পারবে না। অন্য কলেজ থেকে ফরম ফিলাপ করান।’ শুনে চোখে অন্ধকার দেখলেন সেলিনা—‘এত কষ্ট করে ছেলেটা এত দূর এলো!’</p> <p>সেলিনা অনেকের দ্বারে ঘুরলেন। শিক্ষা বোর্ডেও গেলেন। অনুনয়-বিনয় করে বললেন, ‘ছেলেটা হয়তো এ প্লাস পাবে না, কিন্তু গ্যারান্টি দিচ্ছি সে ফেল করবে না।’ একেবারে শেষ দিন ফরম পূরণের অনুমতি পেলেন। তারপর সোহান যা দেখালেন, রীতিমতো চমক!</p> <p><strong>সেলিনার একদিন</strong><br /> এসএসসি পাসের আগেই বিয়ে হয়ে যায় সেলিনার। স্বামী শাহজাহান আলী পুলিশের কনস্টেবল। এখন তাঁদের দুই সন্তান-সোহান ও রোহান। রোহান পড়ে একাদশ শ্রেণিতে। ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম ভাঙে সেলিনার। ঘরদোর পরিষ্কার করে সকালের নাশতা রেডি করেন। এরপর সোহানকে ডেকে তোলেন। বাথরুমে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে আসেন। তারপর এনে পড়ার টেবিলে বসান। ৮টা নাগাদ সবাই মিলে নাশতা খেতে বসেন। সোহানকে বিছানায়, নয়তো চেয়ারে বসিয়ে দুপুরের রান্নার আয়োজন করেন। এক ফাঁকে সোহানকে স্নান করান। দুপুরে খাওয়ার পর তাকে আবার বিছানায় দিয়ে আসেন। বিকেলে আবার পড়তে বসে সোহান। পড়াশোনা শেষে রাতে কিছুক্ষণ মোবাইলে ঘাটাঘাটি করে। রাতের খাবার শেষে বিছানায় নিয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আসেন মা।</p> <p><strong>যেন থাকে দুধেভাতে</strong><br /> মায়ের পর সোহান সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ তাঁর মামা ইমদাদুল হক, বন্ধু এবং শিক্ষকদের কাছে। বললেন, ‘মামা সাহস যুগিয়েছেন। স্যারেরা বাসায় এসে পড়িয়েছেন। মাশরাফি, হাসনাতের মতো বন্ধুরা না থাকলে আমার পড়াশোনাটা স্বপ্নই থেকে যেত।’ <br /> মাশরাফি হক নূর তৃতীয় শ্রেণি থেকেই সোহানের সহপাঠী। তিনি বললেন, ‘ক্লাসে নোট নিতে ওর একটু দেরি হয়। আমি পরে খাতায় তুলে দিই। কোনো কিছু না বুঝলে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখি।’ সোহানের কলেজ শিক্ষক সোলায়মান আলম বললেন, ‘অদম্য সোহান আমাদের সবার জন্যই অনুপ্রেরণা। অনেকদূর যাবে সে।’ <br /> এখন সেই ‘অনেকদূর’ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সোহান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান তিনি। বললেন, ‘রসায়ন কিংবা গণিতে পড়ার ইচ্ছা আমার।’ <br /> ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের কবিতার ঈশ্বরী পাটনীর মতো সেলিনার বেগমেরও চাওয়া-‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। বললেন, ‘আমি তো আর চিরকাল থাকব না। সোহান পড়াশোনা করে স্বাবলম্বী হোক-এটাই চাই।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলে কোথায় থাকবে ছেলে, কিভাবে-এটাই এখন মায়ের চিন্তার ব্যাপার। ছেলেকে একলা ছাড়তে চান না তিনি।</p> <p><iframe frameborder="0" height="360" sandbox="allow-scripts allow-same-origin" scrolling="no" src="https://www.youtube.com/embed/djEJRIR4wKU" width="640"></iframe></p> <p> </p> <p> </p>