<p>ব্যাটে বল লাগুক আর নাই লাগুক ‘সাবাস সাবাস’ বলেই যাচ্ছেন মুন্না। ব্যাটে-বলে মিলে গেলে তালিটা ব্যাটসম্যানের জন্য। আর ব্যাটসম্যান ব্যর্থ হলে বোলারের জন্য তালি। উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে এভাবেই উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিলেন মুন্না।</p> <p>গত রবিবার (১ ডিসেম্বর) দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা স্কুল মাঠে (বোর্ডিং মাঠ) ক্রিকেট দলকে অনুশীলন করানো নিয়ে মগ্ন ছিলেন মুন্না। আগামী বছরের জুলাইয়ে দেশের বাইরে খেলতে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকেই দলকে নিয়ে এই অনুশীলন।</p> <p><img alt="বসুন্ধরা" height="381" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/Nahid/Untitled-2a.jpg" style="float:left" width="635" />হেদায়েতুল আজিজ মুন্না শারীরিক প্রতিবন্ধী। হুইলচেয়ার তার চলার সঙ্গী। তবে মনের জোরে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে চলছেন তিনি। প্রতিবন্ধীদের যেন প্রাণ মুন্না। প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু একটা করার সুযোগ থাকলে সেখানেই তার পদচারণ। মুন্না স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান।</p> <p>মুন্না যে ক্রিকেট দলটি করেছেন, সেটিও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে, যারা হুইলচেয়ারে করেই চলাচল করেন। ‘ড্রিম ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশন’-এর হুইলচেয়ার ক্রিকেট টিম এটি। দলটি এর আগে মুন্নার নেতৃত্বে দুইবার ভারত সফর করে এসেছে। একবার ভারত ও নেপালকে নিয়ে হওয়া ত্রিদেশীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়নও হয় মুন্নার দল।</p> <p>বিডি অ্যানিমেল হেলথ প্রাণি-ওষুধ উৎপাদনকারী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি প্রতিষ্ঠান। সেখানে কর্মরত আছেন ২০ জনের বেশি শারীরিক ও বাকপ্রতিবন্ধী। অভাবের সংসারে মুরাদ, সৌরভ কিংবা সোহাগরা যখন বোঝা, ঠিক তখনই মেলে তাদের চাকরি। আর এর সুযোগ হয় মুন্নার কারণেই। প্রতিষ্ঠানটির মালিক রাসেল আহমেদ বাবু বন্ধু হওয়ার সুবাদে মুন্না প্রতিবন্ধীদের সুযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ করেন।</p> <p>আজ মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। এ দিবসটি সামনে রেখে কথা হয় রাসেল আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মুন্নার চিন্তা-চেতনাজুড়ে শুধুই প্রতিবন্ধীরা। একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও মুন্না যেভাবে পরিশ্রম করেন, সেটা আমাদের পক্ষেও অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মুন্নার সহযোগিতায় অন্য শারীরিক প্রতিবন্ধীরাও অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখাতে পারবে।’</p> <p>অন্যদের মতোই স্বাভাবিক জীবন ছিল মুন্নার। জীবন চলার তাগিদে ২০০৩ সালে ছুটে যান সৌদি আরবে। নিজেই একটি ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ২০০৮ সালে সেখানেই একটি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিরতরে হুইলচেয়ারকে সঙ্গী করে নিতে হয়।</p> <p><img alt="শুভসংঘ" height="348" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/Nahid/Untitled-2b.jpg" style="float:left" width="580" />ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা মুন্না জানান, দুর্ঘটনায় প্রাণে রক্ষা পেলেও স্পাইনাল কর্ড ইনজুরির কারণে শারীরিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। সৌদি আরবে দীর্ঘ কোমায় থাকার পর দেশে এনে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। এরপর অবস্থার উন্নতির আশায় সাভারে অবস্থিত পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপিতে চিকিৎসকদের নিবিড় পরিচর্যায় থাকেন বহুদিন। সিআরপি-তে মেধাবী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নানাবিধ খেলাধুলায় অংশগ্রহণ দেখে মুন্না অনুপ্রাণিত হন।</p> <p>এরই মধ্যে মুন্না হুইলচেয়ারে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। বাড়ি ফিরে এসে ঘুরে দাঁড়াতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নিজে প্রতিবন্ধী হয়েও প্রতিবন্ধীদের জন্য চ্যালেঞ্জ নিলেন। এ জন্য কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মা ও শিশুর প্রতিবন্ধিতা এবং প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে শর্ট গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর হোমিওপ্যাথি বিষয়েও ডিএইচএমএস ডিগ্রি লাভ করেন। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ড্রিম ফর ডিসঅ্যাবিলিটি ফাউন্ডেশন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে পুরোদমে কাজ শুরু করেন মুন্না ও তার দল। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী মেধাবী তরুণদের স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে একটি একীভূত প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করে প্রতিবন্ধীদের কম্পিউটারসহ নানাবিধ কারিগরি প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। চলতি বছর বন্যায় প্রতিবন্ধীদের জন্য ত্রাণ নিয়ে কসবায় ছুটে যান তিনি। সম্প্রতি প্রতিবন্ধীদের হাতে মৌসুমি ফল তুলে দেওয়ার তার একটি আয়োজন জেলাতে বেশ সাড়া ফেলে। বসুন্ধরা শুভসংঘ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সভাপতির পদে আছেন হেদায়েতুল আজিজ মুন্না।</p> <p>মুন্না বলেন, ‘প্রতিবন্ধীরা সমাজ কিংবা পরিবারের বোঝা নয়। আমি প্রমাণ করে দিতে চাই, সুযোগ পেলে প্রতিবন্ধীরাও পারে এগিয়ে যেতে। শুধু দরকার তাদেরকে সুযোগ করে দেওয়া। সেই লক্ষ্যেই আমি কাজ করে যাচ্ছি। আমি প্রতিবন্ধীদের স্বনির্ভর হিসেবে দেখতে চাই। যেখানেই যাই, প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিয়ে কথা বলি।’ <br /> তিনি আরো বলেন, ‘আমার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ক্রিকেট দলটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এটার মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় বেশি। যে কারণে দলটিকে নিয়ে আমার অনেক আশা। ইতিমধ্যেই হুইলচেয়ার ক্রিকেট টিম নিয়ে ভারতে গিয়েছি। এখন এশিয়ার বাইরেও যাওয়ার চেষ্টা করছি।’</p> <p>মুন্না জানান, এটা তার দ্বিতীয় জীবন। দুর্ঘটনার প্রায় দেড় মাস পর পুরো জ্ঞান ফিরে পান। বুঝতে পারেন চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। দেশে এসে অবস্থার উন্নতির আশায় সাভারের সিআরপিতে বহুদিন ফিজিওথেরাপিসহ বিভিন্ন চিকিৎসা নেন।</p> <p>মুন্না ব্যক্তিগত জীবনে এক সন্তানের জনক। সাভারে ফিজিওথেরাপি করানোর সময় থেরাপিস্ট লাকী আক্তারের সঙ্গে পরিচয়। এরপর প্রেম ও শুভ পরিণয়। এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে স্ত্রী লাকী আক্তারের অনেক অবদান রয়েছে বলে জানিয়েছেন মুন্না।</p> <p>মুন্নার ক্রিকেট দলের সঙ্গে যুক্ত মো. মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘নিজে অক্ষম হলেও মুন্না যেভাবে কাজ করেন, সেটা দেখে অবাক হতে হয়। তার পুরো ধ্যানজ্ঞান জুড়ে আছে প্রতিবন্ধীরা। যখনই সুযোগ হয়, প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু একটা করার চেষ্টা করেন।’</p>