<p>একটা সময় দর্শক ড্রয়িংরুমে বসেই পরিবার নিয়ে টিভি নাটক দেখত; কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে এটি এখন ড্রয়িংরুমে সীমাবদ্ধ নেই। ইউটিউবসহ বিভিন্ন অ্যাপে এখন নাটক দেখছেন তারা। বর্তমানে ইউটিউবে নাটকের দর্শকসংখ্যা অনেক। একের পর এক নাটক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে এই প্ল্যাটফরমে। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় থেকে অন্তর্জালে নাটক-গানের ভিউ কমে গেছে। সম্প্রতি প্রকট হওয়া এ ধারণাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলছে একটি সিরিজ নাটক ‘বেক্কল’। আদিবাসী মিজানের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় এই সিরিজের সব নাটক লুফে নিচ্ছে দর্শক। প্রতিটিরই প্রধান চরিত্রে আছেন শামীমা নাজনীন ও মানসী প্রকৃতি। তাঁদের সাফল্যের গল্প জানাচ্ছেন কামরুল ইসলাম।</p> <p><strong>সফল ব্যতিক্রম এক জুটি</strong></p> <p>‘বেক্কল’ সিরিজের সব নাটকে আছেন অভিজ্ঞ অভিনেত্রী শামীমা নাজনীন। আর একটি বাদে বাকিগুলোতে তাঁর সঙ্গী এই প্রজন্মের মানসী প্রকৃতি। কোনো নাটকে তাঁরা আছেন মা-মেয়ের ভূমিকায়, কোথাও শাশুড়ি-পুত্রবধূ। আবার একটি নাটকে শিক্ষক-ছাত্রীরূপেও দেখা গেছে তাঁদের।</p> <p>নাটক-চলচ্চিত্রে সাধারণত নায়ক-নায়িকার জুটি গড়ে ওঠে। ব্যতিক্রম নজির খুব কমই দেখা গেছে। যেমন—একসময় হুমায়ুন ফরীদি ও এ টি এম শামসুজ্জামানের জুটি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরে হুমায়ূন আহমেদের নাটকে ‘তারা তিনজন’ সিরিজে ডা. এজাজ, ফারুক আহমেদ ও স্বাধীন খসরু ত্রয়ীকে দারুণ পছন্দ করেছে দর্শক। এ ছাড়া মোশাররফ করিম ও ফারুক আহমেদও জুটি হয়ে বেশ কিছু দর্শকনন্দিত নাটক উপহার দিয়েছেন। চলচ্চিত্রে নায়ক-নায়িকার বাইরে এ টি এম শামসুজ্জামান-হুমায়ুন ফরীদি জুটিও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তবে নারী চরিত্রে সেভাবে সফল জুটি দেখা যায়নি। যেমনটা হলো শামীমা নাজনীন ও মানসী প্রকৃতির ক্ষেত্রে।</p> <p>এ নিয়ে মানসী প্রকৃতি বলেন, ‘আমাদের অনস্ক্রিন-অফস্ক্রিন কেমিস্ট্রি একই। কখনো মনেই হয় না তিনি আমার সহশিল্পী, মনে হয় তিনি আমার মা। সিরিজটা করতে করতে আমরা এখন মা-মেয়ের মতো হয়ে গেছি। এমনকি এই ভাবনা দর্শকের মধ্যেও ঢুকে গেছে। অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, আমরা সত্যিকারের মা-মেয়ে কি না। শুটিংয়ের বাইরে আমাদের কমই দেখা হয়। তবে সব সময় তিনি অনেক কেয়ারি এবং ভালোবাসার মানুষ। মা-সুলভ আচরণ করেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া, খাইয়ে দেওয়া—তাঁর এমন ভালোবাসা পাই। অভিনয়শিল্পী হিসেবে তিনি খুব সচেতন। সিনিয়র অভিনয়শিল্পী। অনেক আগে থেকেই তাঁর অভিনয়ের ভক্ত আমি। ‘সান্ত্বনা দে’ নাটকে তাঁকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেই জায়গা থেকে এখন তাঁর সঙ্গে জুটি হয়ে অভিনয় করছি, এটা আমার পরম সৌভাগ্য।’</p> <p><strong>শুটিং সেটের গল্প</strong></p> <p>কমেডি গল্পের নাটক। শুটিং সেটেও স্বাভাবিকভাবে বিরাজ করে হাস্যোজ্জ্বল পরিবেশ। সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মানসী প্রকৃতি বলেন, ‘আমাকে দিয়ে কমেডি হবে, এটা কখনো মাথায়ই আসেনি। এর পুরো কৃতিত্ব আদিবাসী মিজান ভাইয়ের। শুটিং সেটে প্রত্যেক শিল্পী ও কলাকুশলী না হেসে পারে না। হাসির কারণে প্রচুর রিটেক দিতে হয়। এ নিয়ে পরিচালকের কত যে বকা খেয়েছি! এই নাটকে আমি যে ভাষায় সংলাপ বলি, সেটা কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ। নাটকে আমার নাম সুফিয়া। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষায় সেটা ‘চুপিয়া’। সেটে সারাক্ষণ আমাকে চুপিয়া বলেই ডাকে সবাই। আবার চুপিয়া যেভাবে কথা বলে, সেটের সবাইও সেভাবেই কথা বলে। এভাবেই আনন্দের মাঝে শুটিং চলে।’</p> <p><strong>নির্মাতার বয়ান</strong></p> <p>আমাদের তারকা শিল্পীদের শিডিউল পাওয়া কঠিন। দেশের শোবিজ এখনো আর্টিস্টনির্ভর; পরিচালকনির্ভর হতে পারেনি। আমি বরাবরই গল্পকে প্রাধান্য দিই। আমি মনে করি, গল্প হলো স্বর্ণ, নির্মাতা হলেন বানিয়া আর অভিনয়শিল্পীরা হলেন স্বর্ণের বার্নিশ। নির্মাতা যদি ভালো না-ও বানাতে পারেন, অভিনয়শিল্পীরা ভালো অভিনয় না-ও করতে পারেন, তবু গল্প যদি ভালো হয়, সেই স্বর্ণের দাম লাখ টাকা। সে জায়গা থেকে তারকা আর্টিস্টের পেছনে সময় নষ্ট না করে একটা ভালো গল্প দাঁড় করাই। মনে হয়েছে, শামীমা নাজনীন আপা ও মানসী প্রকৃতিকে দিয়ে কাজটা করা যায়। পরে দেশের অনেক বড় প্রযোজকের কাছে কাজটির প্রস্তাব নিয়ে যাই। কিন্তু প্রযোজক বললেন, ‘মা-মেয়ের গল্প, কোনো হিরো নেই। এটা তো চলবে না!’ আমি বলেছি, হিরো আছে, কিন্তু দেখতে পারছেন না। হিরোর নামই হলো ‘মা-মেয়ে বেক্কল’। কাজটা করলেন না সেই প্রযোজক। পরে আমার এক বন্ধুর প্রযোজনায় ‘মা-মেয়ে বেক্কল’ করি। প্রচারের পর ভিউ ছাড়িয়ে যায় এক কোটি ২০ লাখ। এক কোটি ভিউ হলে নাটকের ভাষায় সেটা ব্লকবাস্টার হিট। আমার সেই বন্ধুও খুশি। আমি জানতাম, এই গল্প দর্শক দেখবে। দিনশেষে পৃথিবীর সবাই নিজেকে চালাক ভাবতে অনেক পছন্দ করে। যখন দর্শক পর্দায় মা-মেয়ের এমন বোকা বোকা কার্যকলাপ দেখে, তখন দর্শক নিজেকে অনেক চালাক ভাবে। এই সাইকোলজিক্যাল গেমটা খেলেছি গল্পে এবং এতে আমি সফল। দেখুন, জন্মের পর আমরা সবাই সরল ও বোকা। পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক ব্যবস্থা আমাদের চালাক বানিয়ে দেয়, অসৎ বানিয়ে দেয়। যদি জন্মের পর একটা মানুষকে জঙ্গলে রেখে দেওয়া হয়, সে বোকাই থেকে যাবে।</p> <p><strong>‘</strong><strong>বেক্কল</strong><strong>’</strong><strong>নামা</strong></p> <p>জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় থেকে মানুষ তুলনামূলক বেশি রাজনীতিমুখী হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বিনোদন অঙ্গনে। নাটক, গান কিংবা চলচ্চিত্র—সব মাধ্যমই প্রায় ধুঁকছে। বড় বড় তারকার অভিনীত নাটকও আশানুরূপ সাড়া জাগাতে পারছে না। এমন বৈরী সময়ে চমকে দিচ্ছে ‘বেক্কল’ সিরিজ। আদিবাসী মিজানের এই সিরিজ নাটকের ভিউ রমরমা। ট্রেন্ডিংয়ে থাকছে হরহামেশা। আর সাফল্যের জেরে প্রতিনিয়ত ‘বেক্কল’ সিরিজের নতুন নতুন নাটক নিয়ে আসছেন নির্মাতা।</p> <p>গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ইউটিউবে আসে এই সিরিজের প্রথম নাটক ‘মা পুত বেক্কল’। এতে মা-ছেলের ভূমিকায় আছেন শামীমা নাজনীন ও জামিল হোসেন। নাটকটির ভিউ ৬৬ লাখের বেশি। মাস দুয়েক পর মুক্তি পায় নাটকটির দ্বিতীয় কিস্তি ‘মা পুত বেক্কল ২’। এতে শামীমা নাজনীন ও জামিল হোসেনের সঙ্গে যুক্ত হন মানসী প্রকৃতি। এটির ভিউ ৭১ লাখ। সেই থেকে এখন পর্যন্ত বেক্কল সিরিজের সব নাটকে অভিনয় করছেন এই তরুণ অভিনেত্রী।</p> <p>মাস ছয়েক আগে মুক্তি পায় ‘মা মেয়ে বেক্কল’। নাটকটি দর্শক লুফে নেয়। বর্তমানে এর ভিউ এক কোটি ২০ লাখের বেশি। এর এক মাস পরই আসে নাটকটির দ্বিতীয় পর্ব। প্রথমটির মতো না হলেও এটিও মন্দের ভালো সাড়া পায়, ভিউ ৫৬ লাখ। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ‘বেক্কল’ সিরিজের উত্থান ঘটেছে মাস দুয়েক আগে ‘বেক্কল বউ’ দিয়ে। এটি মুক্তির পরই দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে দর্শক। নাটকটির ভিউ ছাড়িয়েছে এক কোটি ১০ লাখ। এরপর এক এক করে অন্তর্জালে এসেছে ‘বেক্কল বউ ২’ [৯৭ লাখ], ‘বেক্কল বউ ৩’ [৭৫ লাখ], ‘বেক্কলের মেলা ১’ [৯০ লাখ], ‘বেক্কলের মেলা ২’ [৩২ লাখ], ‘বেক্কলের মেলা ৩’ [২০ লাখ] ও ‘বেক্কল না সোজা’ [৭২ লাখ] নাটক। শুধু তা-ই নয়, ফেসবুকে সিরিজটির ছোট ছোট ক্লিপস দেখছে লাখো মানুষ।</p> <p>বেক্কল অধ্যায় এখানেই শেষ হচ্ছে না, ধারাবাহিকভাবে আসছে আরো অনেক নাটক। জানা গেছে, বর্তমানে পরিচালক আদিবাসী মিজান ও তাঁর টিম রয়েছে সিলেটে। সেখানে চলছে ‘বেক্কল বউ ৪’-এর শুটিং। এরপর ক্রমে আসবে ‘বেক্কল শালী’, ‘বেক্কল মা’সহ এমন আরো অনেক সিক্যুয়াল। নির্মাতা বলেন, ‘কেউ কেউ নেতিবাচক মন্তব্য করছেন বটে, কিন্তু আমার সোজা কথা, এক কোটি মানুষ যদি নাটক দেখে, তাঁদের জন্য আমি বেক্কল সিরিজ করে যাব। দর্শক যেহেতু আনন্দ পাচ্ছে, এটা করেই যাব।’</p> <p>ভিউ খরার এই মৌসুমে ঠিক কোন জাদুতে ভিউ জোয়ারে ভাসছে ‘বেক্কল’ সিরিজ? এর বিপরীতে বেশ কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। নাটকগুলোর গল্প সরল। আবার আঞ্চলিক ভাষার নাটকের প্রতি দর্শকের ভালো লাগা আগে থেকেই। বোকাসোকা চরিত্র দেখতেও সাধারণ দর্শকের আগ্রহ চিরায়ত। এই সিরিজ নাটকের অভিনেত্রী মানসী প্রকৃতি বলেন, ‘দিনশেষে আমরা হাসতে পছন্দ করি। পারিবারিক কলহ কিংবা দেশের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি যা-ই থাকুক না কেন, হাসতে কে না পছন্দ করে! মানুষ তো সারা দিন নানা কারণে দুশ্চিন্তায়, মানসিক চাপে থাকে। তো, যখনই এমন হাসির কনটেন্ট আসবে, মানুষ সেটা দেখবেই। কমেডির চাহিদা দর্শকমহলে ছিল, আছে, থাকবে।’</p> <p><strong>বিগত দুই মাসের ভিউ</strong></p> <p><strong>নাটক             মুক্তির তারিখ ও ভিউ</strong></p> <p><strong>বেক্কল বউ </strong> [২ সেপ্টেম্বর, ১ কোটি ১৪ লাখ]</p> <p><strong>বেক্কল বউ ২ </strong>  [১৪ অক্টোবর, ৯৮ লাখ ৪৬ হাজার]</p> <p><strong>বেক্কল বউ ৩ </strong>  [২৮ অক্টোবর, ৭৬ লাখ ৮৮ হাজার]</p> <p><strong>বেক্কলের মেলা  </strong>[২১ অক্টোবর, ৯১ লাখ ২১ হাজার]</p> <p><strong>বেক্কলের মেলা ২ </strong>    [২৮ অক্টোবর, ৩২ লাখ ৫৭ হাজার]</p> <p><strong>বেক্কলের মেলা ৩ </strong>    [৪ নভেম্বর, ২১ লাখ ৩০ হাজার]</p> <p><strong>বেক্কল না সোজা </strong>    [৩১ অক্টোবর, ৭৫ লাখ ৬৮ হাজার]</p>