<p>কোনো কিছুকে অভিন্ন বোঝাতে আমরা ‘মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ’ বাগধারা ব্যবহার করি। কিন্তু একজন মুদ্রা বিশেষজ্ঞ বলবেন এটি ভুল বয়ান। মুদ্রার দুটি পিঠই আলাদাভাবে মূল্যবান। নানা রকম তথ্যসূত্র ছড়িয়ে আছে দুই পিঠেই, যে কারণে ইংরেজি Obverse  ও Reverse শব্দকে যাঁরা যথাক্রমে মুদ্রার মুখ্যপিঠ ও গৌণপিঠ বলেন, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। আসলে গৌণ বা কম মূল্যবান পিঠ কোনোটিই নয়। বিগত সরকারের বাংলাদেশ যদি একটি মুদ্রা হয়ে থাকে, তবে এর সামনের পিঠটি বেশ ঝকঝকে ছিল।</p> <p>দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেখে মনে হতো দেশ অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু উল্টো পিঠটি যেন সত্যি সত্যি গৌণ হয়ে গিয়েছিল। ক্রমে রাহুর অপচ্ছায়া জেঁকে বসেছিল পেছনের পিঠে। দ্রুত গ্রাস করছিল। এই গ্রাস থেকে মুক্ত হতে পারছিল না দেশ নামের মুদ্রাটি। গ্রাস অব্যাহত থাকলে সামনের চকচকে পিঠেরও কিন্তু রেহাই নেই।</p> <p>বিগত শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ শাসনকালে একদিকে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল; অন্যদিকে ধর্ষণ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরছিল সমাজকে। রাজনীতির অক্টোপাস তখন এমনভাবে সমাজ জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছিল যে একমাত্র রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া সেসব অনাচার থেকে সমাজকে রক্ষা করা কঠিন ছিল। হাসিনা সরকারের একটি সময় ধর্ষণ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছিল।</p> <p>গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব পর্যায়ে শিক্ষকের দ্বারা ছাত্রী ধর্ষিত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছিল, দায়িত্বশীল আমলাও ধর্ষকের পরিচয় পাচ্ছিলেন, মাদরাসা শিক্ষক বলাৎকার করতেন কোমলমতি ছাত্রকে, মাদরাসায় শিক্ষকের কক্ষে ধর্ষিত হয়েছিল ছাত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণ করছিল নেশাখোর শহুরে ভবঘুরে, প্রভাবশালীদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন গৃহবধূ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরাও এই তালিকা থেকে বাদ যাননি। গ্রাম থেকে ব্যস্ত রাজধানী—সর্বত্রই ধর্ষকদের যেন অভয়ারণ্য ছিল।</p> <p>শিশু থেকে প্রৌঢ় কেউ রেহাই পাচ্ছিল না ধর্ষকদের হাত থেকে। শুধু ধর্ষণ কেন! খুনের সংখ্যা কি বাড়ছিল না? সম্পত্তির জন্য খুন হচ্ছিল, ডাকাতি করতে গিয়ে খুন করা হয়েছে, রাজনৈতিক কারণে খুন হচ্ছিল অনেকে। সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত খুনের তো ইয়ত্তাই নেই। আদিম শিকারি মানুষ একসময় সফল শিকারের নিশ্চয়তা পাওয়ার জন্য নেতৃত্বের প্রয়োজন অনুভব করে। তারা গড়ে তোলে ক্ল্যান সংগঠন, এভাবেই গড়ে উঠেছিল ট্রাইব, পরিবার, রাষ্ট্র সংগঠন ইত্যাদি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে সুশৃঙ্খল করার জন্য ক্রমে মানুষ নিজেদের নিয়ম ও পদ্ধতির ভেতর আবদ্ধ করেছে। এই যৌক্তিক চিন্তার পথ ধরে মানুষ হাজার হাজার বছর অতিক্রম করেছে। নতুন নতুন রাষ্ট্রচিন্তা ও পদ্ধতি নিয়ে অনেক নিরীক্ষা করেছে মানুষ। সংসদীয় গণতন্ত্রের মতো আধুনিক রাষ্ট্র দর্শনের আদর্শ নিয়ে আমরাও পথচলা অব্যাহত রেখেছি।</p> <p>হাসিনা সরকারের সাফল্য থাকলেও দুর্নীতি আর সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছিল প্রশাসন এবং নানা পক্ষের রাজনীতির ধ্বজাধারীরা। এখন সন্দেহ হচ্ছে, তাঁরা কেউ আসলে দেশবাসীকে অন্যায়ের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন কি না। যদি চাইতেন, তবে অপরাধের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যেত না। আমরা বহুবার বলার চেষ্টা করেছি এবং দেশবাসীরও অজানা নয় যে খুনি, ধর্ষক ও সন্ত্রাসীরা ছিল অনেকটাই চিহ্নিত এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা রাজনীতির পরিচয়ে ‘অভিজাত’ ব্যক্তিবর্গ। এই রেসে বরাবর সরকারপক্ষ এগিয়ে থাকে।</p> <p>এই আলো আমরা হারাতে চাই নাএ কথা তো ঠিক, যে সরকার যত দিন ক্ষমতায় থাকবে, জনগণের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব সে সরকারকেই নিতেই হবে। দুর্ভাগ্য আমাদের, রাজনীতিতে ক্রমে অস্ত্র আর অর্থের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। এ দেশের, বিশেষ করে রাজনৈতিক সরকারগুলোর সন্ত্রাসী আর অস্ত্রবাজ পোষার প্রবণতা ট্র্যাডিশনে পরিণত হয়েছে। বিএনপি বা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে যদি আহ্বান জানিয়ে বলা হতো, ‘আপনারা শপথ নিন—আপনাদের সংগঠন ও অঙ্গসংগঠনে একজনও চাঁদাবাজ, চোরাকারবারি, লুটেরা, সন্ত্রাসী, অস্ত্রবাজ ক্যাডার রাখবেন না, স্থান দেবেন না কোনো ঋণখেলাপিকে।’ তাহলে কি ফ্যাকাসে হয়ে যেত না তাঁদের মুখ! সারা দেশে বিভিন্ন স্তরে চোখ বুলালে সাধারণ মানুষও বুঝবে বাস্তবায়নের প্রত্যয় রেখে অমন শপথ গ্রহণ করলে বড় দলগুলোর ‘ঘন জঙ্গল’ নিমেষে ‘ঊষর মরুভূমি’তে পরিণত হবে।</p> <p>দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজও সামাজিক সংকট তৈরি করে, যা এ দেশে ক্যান্সারে রূপ নিয়েছিল। দুর্নীতি বোধ করি মানবজীবনের সমান বয়সী। এ কারণেই দুটি পরস্পরবিরোধী শক্তির সমান অবস্থানের কথা রয়েছে সব ধর্ম ও দর্শনে। প্রাচীন মিসরের হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে যে ধর্মসংগীত পাওয়া যায়, তাতে পাপী আর পুণ্যবানের শেষ বিচারের বর্ণনা রয়েছে। প্রাচীন পারস্যে ধর্মগ্রন্থ আবেস্তায় আলোর দেবতা আহুরামাজদা আর অন্ধকারের শক্তি আহরিমানের কথা রয়েছে। ধর্মগ্রন্থে রয়েছে ফেরেশতা আর শয়তানের ধারণা। আমাদের যাপিত জীবনেও তেমনি সুনীতির পথে হাঁটা ভালো মানুষের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজের উপস্থিতি দৃষ্টির অগোচরে থাকে না। তবে এর মাত্রাভেদ রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই অন্যায়কারী ছিল বলেই রাষ্ট্রীয়ভাবে বিচারব্যবস্থাও চালু ছিল।</p> <p>প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে প্রাচীন ব্যাবিলনে রাজা হাম্মুরাবির লিখিত আইনের ধারাগুলো পড়লে দেখা যায়, সেই সমাজেও খুনে, সন্ত্রাসী, চোর, ডাকাত, দুর্নীতিবাজ সবই ছিল। তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ছিল কঠোর আইন। তবে পার্থক্য এই, এ যুগেও আগে দুর্নীতিবাজ দুর্নীতি করত নিজেকে আড়াল করে, লুকিয়ে-চুরিয়ে। এখন প্রকাশ্যে বুক ফুলিয়ে। নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন আছে বটে, তবে এর প্রয়োগ খুব অল্প। রাজনীতির আশ্রয় পেয়ে দুর্নীতি নিজেকে ছড়িয়ে দিতে অনেক বেশি সাহসী হয়েছে। এ দেশে দুর্নীতি ও নষ্ট হয়ে যাওয়া রাজনীতি সব সময় গাঁটছড়া বাঁধা। মাঝে মাঝে মনে হয় নষ্ট রাজনীতির ছায়াতলে দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত হয় অথবা দুর্নীতির অক্টোপাসে নষ্ট হতে থাকে রাজনীতি।</p> <p>অবশ্য মানতে হবে, রাজনীতি নষ্ট হয়ে যাওয়ার সূচনা দুর্নীতির সমান বয়সী নয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালের আওয়ামী লীগ দূরদর্শিতা নিয়ে রাজনীতির ময়দানে স্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারেনি। বাংলাদেশে ১৯৭৫ থেকে রাজনীতিতে পচন ধরার আলামত দৃশ্যমান হতে থাকে। রাজনীতির নষ্টামিতে হত্যার রাজনীতি যুক্ত হয়। একাত্তরের দেশি-বিদেশি পরাজিত শক্তি এই ঘোলাটে সময়ে নিজেদের আড়াল করে মত্ত হয় প্রতিশোধের নেশায়। বিষাক্ত করে দিতে থাকে রাজনীতিকে। এই যাবতীয় সংকট সঙ্গে রেখে কোনো সমাজ স্থিতিশীল থাকতে পারে না। সমাজে সৃষ্টি হয় নানা রকম বিভ্রান্তি। এমন বাস্তব ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট যে জটিলতা তৈরি করে, তা আরো সবল হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতি বজায় থাকার কারণে।</p> <p>শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনে দমবন্ধকর অবস্থা তৈরি হয়েছিল। তাই ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান যেন অবধারিতই ছিল। স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটার পর সাধারণ মানুষ মুক্ত শ্বাস নেওয়ার প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু সে পরিবেশ এখনো যেন তৈরি হয়নি। কাঙ্ক্ষিতরূপে নতুন সরকারকে এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ঘুষ-দুর্নীতি আগের মতোই অব্যাহত আছে। ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি স্থানভেদে বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি এসব উৎপাত মানুষের স্বস্তি কেড়ে নিচ্ছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা না থাকলে সংকট ক্রমে ঘনীভূত হবে।</p> <p>রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে। বর্তমান সরকার বেশির ভাগ মানুষের কাছে কাঙ্ক্ষিত ছিল। এই সরকার সফল হোক, সাধারণ মানুষের চাওয়া এমনই। অন্যথায় বড় রকমের দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হবে। বিগত সরকার অন্তরে যে অন্ধকার ছড়িয়েছে, তার থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় ঘটেছিল অভ্যুত্থান। আলোর দ্বীপশিখা কি হাতে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার? এই আলো আমরা হারাতে চাই না।</p> <p><em>লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়</em></p> <p><em>shahnawaz7b@gmail.com</em></p>