<p>‘ঘরে থাকা ছবিটি মাঝে-মধ্যে বের করে দেখি। প্রতিদিন অন্তত একবার কবরস্থানে যাই। প্রতি মুহূর্তে ওর কথা মনে পড়ে। ইয়াসিন ছিল সবার আদরের। বড় হয়ে ওর মায়ের দুঃখ ঘোচাবে, এমনটি আশা ছিল সবার। জন্মের এক বছরের মাথায় ওর প্রতিবন্ধী বাবা মারা যায়। আমার মেঝমেয়ের একমাত্র পুত্র ইয়াসিন। স্বামীহারা হয়ে ঢাকায় গিয়ে টুকরো কাগজ সংগ্রহ করে বিক্রি করেই সংসার চালায় ইয়াসিনের মা মঞ্জিলা। কিন্তু দুঃখ তার পিছু ছাড়ল না। সন্তান হারিয়ে সেও আজ পাগলপ্রায়।’ কোটা আন্দোলনে নিহত খুলনার রূপসা উপজেলার রহিম নগরের ইয়াসিন শেখের নানি মোমেনা খাতুন এসব কথা বলেন। </p> <p>পাশে থাকা তার বড়মেয়ে রূপবান বেগম বললেন, ‘ইয়াসিনের কথা ভোলার নয়। ওকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছি। গত কোরবানীর ঈদে বেড়াতে এসেছিল। এরপর ফিরল লাশ হয়ে। চোখের সামনে যেন প্রতি মুহূর্তেই ইয়াসিনের স্মৃতি ভাসে।’</p> <p>কোটা সংস্কার আন্দোলনে ২১ জুলাই পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ জুলাই রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে নিহত ইয়াসিন শেখের স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছেন তার নানী ও খালা। যাদের হাতেই বেড়ে ওঠা ইয়াসিন শেখের। একেবারে জীর্ণ কুটিরেই তাদের বসবাস। </p> <p>ইয়াসিনের মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ১৭ বছর। কয়েক বছর হলো ইয়াসিনও তার মায়ের কাছে থাকতেন ঢাকায়। কিছুদিন একটি এলপি গ্যাসের দোকানে চাকরি করতেন। এরপর কখনও অটো চালিয়ে আবার কখনও রিক্সা চালিয়ে কিছু পয়সা আয় করে মায়ের সহযোগী হয়ে সংসারের হাল ধরা শুরু করেন। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় চলতি পথেই গুলিবিদ্ধ হয়ে চারদিনের মাথায় মৃত্যু হয় তার।</p> <p>ইয়াসিনের বেড়ে ওঠা সেই রহিম নগরে গিয়ে দেখা যায়, তার নানী মোমেনা খাতুন ও বড়খালা রূপবান বেগমের। তাদের মধ্যে এখন শুধুই ইয়াসিনের স্মৃতি।</p> <p>ইয়াসিনের মা মঞ্জিলা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘বড় আশা ছিল ইয়াসিন আমার অভাবের সংসারে হাল ধরবে। কিন্তু তা হলো না। ওর মৃত্যুর পর আজ পর্যন্ত ঠিকমতো কাজ করতে পারছি না। জীবনে কী যে হবে তাবুঝতে পারছি না।’</p> <p>তিনি আরো বলেন, ‘আমার ছেলের কোনো দোষ ছিল না। সে পথচারী ছিল। সে কোনো দল করতো না। আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করার পাশাপাশি টুকরো কাগজ বাছাই করে বিক্রি করি। ইয়াসিনের আয় দিয়েই বাসা ভাড়াসহ সংসার চলতো। আমাকে কাজ করে খাওয়ানোর মতো আর কেউ নেই। সম্প্রতি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম দুই লাখ টাকা দিয়েছে। টাকায় কি আর সন্তানের অভাব পূরণ হয়?’</p> <p>স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, প্রায়ই রহিম নগর কলোনী কবরস্থানের সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ইয়াসিন শেখের নানী ও বড় খালাকে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছেই চলে যান তারা। ওই পরিবারটির দুঃখ যেন সহ্য করার মতো নয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ বাহিনীর হাতে নিহত ইয়াসিন শেখের পরিবারের কান্না যেন থামছেই না।</p>