<p>পতিত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে মুন্সীগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ ছিল মূলত স্থানীয় সাবেক এমপি হাজী মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লবের ‘সন্ত্রাসী বাহিনী’ হিসেবে পরিচিত। তার ছত্রচ্ছায়ায় এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা ছাত্রলীগ করেনি। এর মাধ্যমে জেলা ছাত্রলীগের নেতারা হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক।</p> <p>স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে টানা তিনবারের পৌর মেয়র ছিলেন ফয়সাল বিপ্লব। শুরু করে ৪ আগস্ট পর্যন্ত জেলা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের অবস্থান ছিল মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার নিচতলায়। মুন্সীগঞ্জ পৌরসভাটি বিগত ১৬ বছর ছিল স্থানীয় এমপি, পৌর মেয়র এবং আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনীর আস্তানা। এই পৌরসভায় অবস্থান নিয়েই ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে ডেকে নিয়ে অত্যাচার করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।</p> <p>এলাকায় ভীতি প্রদর্শনে ছাত্রলীগের অস্ত্র মহড়া ছিল বড় হাতিয়ার। এরপর আওয়ামী লীগ নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় জমি দখল, ফ্ল্যাট দখল, ঘর ও বিল্ডিং নির্মাণে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করতেন তারা। এ ছাড়া মাদক ব্যবসায় ছিল ছাত্রলীগের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।</p> <p>অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. ফয়সাল মৃধা, সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ পাভেল, শহর ছাত্রলীগের সভাপতি নছিবুল ইসলাম নোবেল, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসাইন সাগর, সরকারি হরগঙ্গা কলেজ শাখার সভাপতি নছিবুল নিবির আহম্মেদ, সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন বেপারী, সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. সুরুজ মিয়া, সাধারণ সম্পাদক লাকুম রাঢ়িসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা গত ১৫ বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।</p> <p>স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. ফয়সাল মৃধা বিগত ১৫ বছরে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছেন। পদ বাণিজ্য, সরকারি খাল ও নিরীহ কৃষকদের জমিতে বছরের পর বছর মাছ চাষ, ঐতিহ্যবাহী মুন্সীরহাট বাজারে ২০টিও অধিক দোকান দখল করে ভাড়া আদায় করেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে আছে অবৈধ ড্রেজিং বাণিজ্য, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা আদায়ের আভিযোগ। এ ছাড়া গ্রামের সাধারণ মানুষকে মামলা দিয়ে বাড়িছাড়া করাতেন ফয়সাল। এরপর মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে আবারও মীমাংসার নামে তাতে বাড়ি ফেরানোর কাজ করতেন তিনি। সরকারি বিভিন্ন কাজের ভাগ পেতেন ফয়সাল।</p> <p>অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৬ বছর আগে ভাঙা টিনের গড়ে পরিবার নিয়ে থাকতেন ফয়সাল। ছাত্রলীগের সভাপতি পদ পাওয়ার পর আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে তার। এখন বাড়িতে আধুনিক বিল্ডিং, সরকারি খালের ওপর কোটি টাকার মাছের প্রজেক্ট এখনো তার নিয়ন্ত্রণে। মুন্সীরহাট বাজারে তার দখলে রয়েছে একাধিক দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।</p> <p>গত ৪ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ শহরে ছাত্র-জনতার আন্দোলত দমাতে জেলা ছাত্রলীগের এই নেতা প্রকাশ্যে অস্ত্র দিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করেছিলেন। ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা মামলার আসামি ফয়সাল মৃধা এখন পলাতক। </p> <p>শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দিন থেকে ফয়সাল মৃধা আত্মগোপনে চলে গেছেন। তবে স্থানীয় রাজনৈতিক একটি সূত্র জানিয়েছে, মন্সীগঞ্জের ফয়সালসহ প্রায় ৩০ জন ছাত্রলীগের নেতা এখন দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অবৈধ পথে আয় করা টাকা বিদেশে পাচার করেছেন তারা।</p> <p>জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহম্মেদ পাভেলের বিরুদ্ধে মুন্সীগঞ্জ থানায় একাধিক মাদক, চাঁদাবাজি ও নানা ধরনের মামলা রয়েছে। দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি মাদক ব্যবসার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। তার সঙ্গী শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ল্যাংড়া খসরু র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহতের পর থেকে পাভেট তার এলাকার মাদক সম্রাট হয়ে ওঠেন। পঞ্চসার ইউনিয়নের বণিক্যপাড়া, আধারিয়াতলা এবং রামপাল এলাকায় ছিল তার মাদকের বিশাল সাম্রাজ্য। এ ছাড়া জমি দখল, বাড়ি দখল, চাঁদাবাজি এবং টেন্ডার বাণিজ্য করে কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া ফয়েজ আহম্মেদ পাভেল এখন পলাতক।</p> <p>শহর ছাত্রলীগের সভাপতি নছিবুল ইসলাম নোবেল দলের মধ্যে শুটার নছিবুল নামে পরিচিত। গত ১৬ বছরে বিভিন্ন সময় অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে দেখা গেছে তাকে। গত ১৯ জুলাই নয়াগাঁও পশ্চিমপাড়া এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলি করে ছাত্রভঙ্গ করে দেন এই নছিবুল। সর্বশেষ গত ৪ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ শহরের সুপারমার্কেট এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি করেন তিনি। আন্দোলনকারীদের তথ্য মতে, আন্দোলনের সময় নছিবুল ইসলামের গুলিতে কারণে বহু মানুষ গুলিবিদ্ধ এবং চারজন শহীদ হয়েছেন।</p> <p>নছিবুলকে ব্যবহার করতেন আওয়ামী লীগ নেতারা। সবার জন্য দখলবাজি বা চাঁদাবজির কাজ করতেন নছিবুল। এর মাধ্যমে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। প্রতি মাসে বিদেশে ভ্রমণ ছিল তার নেশা।</p> <p>শহর ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাত হোসেন সাগর ১০ বছর আগে ছিলেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের একজন কর্মী। বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল হাইকে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা মহিউদ্দিন এবং তার ছেলে সাবেক পৌর মেয়র ফয়সাল বিপ্লবের নজরে আসেন সাজ্জাত সাগর। এরপর সাগরকে ভিড়িয়ে নেন নিজ দলের সন্ত্রাসী বাহিনীতে। সহজেই সাজ্জাত সাগর পেয়ে যান শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ।</p> <p>পদ পাওয়ার পর সাজ্জাত সাগর হয়ে ওঠেন এমপির প্রধান সন্ত্রাসী। মাঠপাড়া, ছয়ঘরিয়াকান্দি, খালইস্ট, মানিকপুরসহ পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ড নিয়ন্ত্রন করতে শুরু করে সাগর ও তার বাহিনীর লোকজন। জমি দখল, চাঁদাবাজি, বিরোধী মত দমন, হামলা, মামলা দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার বাড়িয়ে দেন সাগর। পৌরসভার যেকোনো এলাকায় জমি কেনা, বিল্ডিং নির্মাণে সাগর বাহিনীকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হতো। এর মাধ্যমে কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন সাগর।</p> <p>সর্বশেষে গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর প্রকাশ্যে গুলি চালিয়েছিলেন সাজ্জাত সাগর। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর থেকে পলাতক এই আসামি।</p> <p>সরকারি হরগঙ্গা কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি নিবির আহম্মেদ কলেজের নিয়মিত ছাত্র না। ছাত্রলীগের পদ ব্যবহার করে পুরো কলেজ নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। ২০১৭ সালে কলেজ ছাত্রাবাসে অভিযান চালিয়ে তার কক্ষ থেকে কলেজের লাইসেন্স করা বন্দুকসহ বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে পুলিশ। অস্ত্র উদ্ধারের আগের দিন কলেজের ছাত্রাবাসে সরবরাহ করতে আসা পাথরভর্তি ট্রাকে থাকা ৯০০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করে পুলিশ। এসব মামলায় দীর্ঘদিন জেলেও ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা নিবিড়। তবে তিনি পদ হারাননি। শেখ হাসিনা সরকার পতনের আগের দিন পর্যন্ত দাপট দেখিয়েছেন নিবিড়। করেছেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি।</p> <p>একই পথে হেঁটেছেন সরকারি হরগঙ্গা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর বেপারী। ঠিকাদারি ব্যবসা, বালু মহাল নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, জমি দখল এবং এলাকায় সব কিছুতে একক আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। বর্তমানে সপরিবারে পলাতন রয়েছেন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের এই নেতা।</p> <p>সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. সুরুজ মিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দুর্নীতিবাজ ও ছাত্র-জনতা হত্যা মামলার পলাতক আসামি সামসুল কবির মাস্টারের হাত ধরে আসেন রাজনীতিতে। একটা সময় ভাগিয়ে নেন সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতির পদ। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। টেন্ডারবাজি, জায়গা দখল, অবৈধ ড্রেজার বাণিজ্য, জোরপূর্বক জমি ভরাট, মাদক এবং চাঁদাবাজির মাধ্যমে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।</p> <p>এরপর আধারা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে অস্ত্রের মুখে হুমকি প্রদান করে এলাকাছাড়া করেন সুরুজ। কালো টাকার বিনিময়ে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ভাগ বসান সরকারি সব কাজে। শহরে এবং ঢাকায় কিনেছেন সম্পত্তি। কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া ছাত্রলীগের এই নেতা এখন দুবাই গিয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলেছেন।</p> <p>সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মাহমুদুল হাসান লাকুম রাঢ়িও জেলা ছাত্রলীগের সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনীর সক্রিয় সদস্য। এলাকায় মাদক বিক্রি, জমি দখল, বাড়িঘর নির্মাণে জোরপূর্বক চাঁদা আদায়, এলাকার জমি কেনাবেচায় কমিশন আদায়, অন্যের জমি নিজের নামে নামজারি করে দখলসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন লাকুম। গত ১৫ বছরে তিনি কোটিপতি হয়েছেন। সদর উপজেলা ছাত্রলীগের নেতা শাকিল আহম্মেদ, বাবু কাজীও ছিলেন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বাহিনীর অন্যতম সদস্য।</p>