<p>শেখ হাসিনাকে স্বৈরশাসক থেকে ফ্যাসিস্ট বানানোর পেছনে গণমাধ্যমও দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী। সিলেট প্রেসক্লাব মিলনায়তনে শনিবার (২৬ অক্টোবর) বিকেল ৩টায় বিএফইউজের সদ্যপ্রয়াত সভাপতি রুহুল আমিন গাজী স্মরণে আয়োজিত নাগরিক শোকসভা ও দোয়া মাহফিলে প্রধান বক্তার বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।</p> <p>কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, গণমাধ্যকে বলা হয় সমাজের আয়না। কিন্তু সেটি আয়নার কাজ করেনি। সেটি করলে, ওই সরকারের ভুল, ক্রটি, দুর্নীতি, লুটপাট, লুণ্ঠন, খুন, গুম, আয়নাঘরের চিত্র তুলে ধরলে, শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হতে পারতেন না।</p> <p>এ ছাড়া অন্তবর্তীকালীন সরকারকে বিতর্কিত করার চেষ্টে চলছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘সাবধান থাকতে হবে। ফ্যাসিস্টরা যাতে সরকারকে কোনোভাবে ব্যর্থ করতে না পারে, সে ব্যাপারে আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে।’</p> <p>শোকসভায় প্রধান বক্তার বক্তব্যে বিএফইউজে মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘শেখ হাসিনা স্বৈরশাসক ছিলেন। তাকে মহা স্বৈরাচার থেকে ফ্যাসিস্ট বানানোর পেছনে আমাদের মিডিয়া কম দায়ী নয়। এই মিডিয়াকে বলা হয় সমাজের আয়না। কিন্তু মিডিয়া সমাজের আয়নার মতো কাজ করেনি। যদি আয়নার মতো কাজ করত, এই সরকারের ভুল, ক্রটি, দুর্নীতি, লুটপাট, লুণ্ঠন, খুন, রাহাজানি, গুম, আয়নাঘর এসব চিত্র যদি সেদিন তুলে ধরত, শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হতে পারতেন না। আমরা সেটা না করে সেদিন তোষামোদি করেছিলাম। এর দায় আমরা এড়াতে পারিনা।’</p> <p>সাংবাদিকরা ওয়াচডগের ভূমিকা পালন না করে পেটডগের ভূমিকায় ছিলেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের বলা হয় ওয়াচডগ, জাতির অতন্ত্র প্রহরী। কিন্তু আমরা কি সত্যিকার অর্থে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমরা ওয়াচডগের ভূমিকা পালন করেছি? যখন চুক্তি হয়েছে ভারতে, বাংলার মানুষ জানে না গোপন এই চুক্তির কথা। ভারত থেকে ফিরে এসে যখন প্রেস কনফারেন্স করলেন, আমাদের সাংবাদিকরা, সম্পাদকরা কি জিজ্ঞাস করেছেন, কি চুক্তি হয়েছে? জনগণকে অন্ধকারে রেখে সংসদে পাশ কাটিয়ে এ রকম চুক্তি করা যায় কি?’</p> <p>তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘সেদিন যদি প্রশ্নটি সাহস করে করতে পারতেন, সরকারকে জাবাবহিদিতার মুখোমুখি আনতে পারতেন, তাহলে এসব অপকর্মগুলো হতো না।’</p> <p>সাংবাদিকরা প্রশ্ন করার বদলে তৈলমর্দনে ব্যস্ত ছিলেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমরা কি করলাম, সেখানে আমরা দাঁড়িয়ে বললাম, আপনি শুধু বাংলাদেশের নেত্রী নন, আপনি আন্তর্জাতিক নেত্রী। আপনার নোবেল পাওয়া উচিত। তেল মর্দন করছে আমাদের সম্পাদকরা, সাংবাদিকরা। প্রেস কনফারেন্স আর প্রেস কনফারেন্স থাকেনি, সেটা শেখ হাসিনার সংবর্ধনা সভায় পরিণত হয়েছিল। এ দায় আমরা এড়াতে পারি না।’</p> <p>ছাত্র আন্দোলনের সময় যখন রক্তে পিচঢালা পথ রঞ্জিত হচ্ছিল তখনো তারা দালালিতে ব্যস্ত ছিলেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘যখন ছাত্রদের ওপর গুলি চালাচ্ছিল, রক্তপাতে ঢাকার পিচঢালা পথ লালে লাল হয়ে গেল। বাংলাদেশ কেঁদে উঠল, কেঁদে উঠল বিশ্ব-সমাজ। শোকের মাতম ঘরে ঘরে। মা-বোনেরা নেমে এলো রাস্তায়, বিবেকবান মানুষ নেমে এলো রাস্তায়, কিছু কিছু বিবেকবান আওয়ামী লীগও নেমে এসেছিল সেদিন। সেদিন আমরা দেখলাম, কিছু সাংবাদিক—পিন্টুদের মতো, আশিষ সৈকতদের মতো দালালরা সেদিন বললেন, এটা দমাতে হবে যেকোনো মূল্যে।’ এরপর জাতির বিবেক বলার সুযোগ আছে কি না প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘এদের আমি জাতির বিবেক বলি কিভাবে? এদেরকে আমি সাংবাদিক বলি কিভাবে? এদের আমি ওয়াচডগ বলি কিভাবে? এদের আমি ওয়াচডগ বলতে পারি না, এদের আমি বলি পেটডগ। পোষা কুকুর। এদের সমাজের অতন্ত্রপ্রহরী বলে আমি সমাজকে কলংকিত করতে চাই না।’</p> <p>সাংবাদিকদেরই সাংবাদিকতাকে বাঁচাতে হবে মন্তব্য করে বিএফইউজে মহাসচিব বলেন, ‘সাংবাদিক ভাইদের বলি, সাংবাদিকরাই একমাত্র সাংবাদিকতাকে বাঁচাতে পারে। সাংবাদিকতাকে তা্রা ধ্বংস করে গেছে আপনারা জানেন। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা বলতে কিছু ছিল না। মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৮০টি দেশের ১৬৩ নম্বরে নিয়ে গিয়েছিল শেখ হাসিনা।’</p> <p>অন্তবর্তীকালীন সরকারকে উদ্দেশ করে কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে আপনারা এখানে এসেছেন। আপনাদের মর্যাদা, আপনাদের গৌরব কত বড় হয়তো আপনারা জানেন না। আমরা চাই না আপনারা ভুল পথে যান কিংবা কোনো প্রলোভনে পড়েন।’</p> <p>সরকারকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে জানিয়ে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আজকে এই সরকারকে বিতর্কিত করার জন্য নানামুখি ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ভেতরের থেকে লোভীরা যেমন আছে ফ্যাসিবাদের দালালরা আজকে এই সরকারকে চারিদিকে ঘিরে আছে। সাবধান থাকতে হবে। এই সরকারকে কোনো অবস্থাতেই ফ্যাসিস্টরা ব্যর্থ করতে না পারে সে ব্যাপারে আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে।’</p> <p>সিলেট মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন (এসএমইউজে) এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সিনিয়র সাংবাদিক এনামুল হক জুবেরের সভাপতিত্বে ও এসএমইউজের সাধারণ সম্পাদক খালেদ আহমদের সঞ্চালনায় শোকসভার আলোচনায় অংশ নেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলিমুল ইসলাম, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মিফতাহ সিদ্দিকী, সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, সিলেট জেলা জামায়েতের আমীর ও ইবনে সিনা হাসপাতাল সিলেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান মাওলানা হাবিবুর রহমান, সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির মো. ফখরুল ইসলাম, বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের আহ্বায়ক ডা. শামীমুর রহমান। অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন এসএমইউজের সভাপতি মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা বদর।</p> <p>শোকসভায় সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আলিমুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সদ্য প্রয়াত সভাপতি রুহুল আমিন গাজী ছিলেন একজন আপসহীন সাংবাদিক নেতা। সাংবাদিকদের রুটি-রুজির আন্দোলনে তিনি সব সময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার মতো এমন সাহসী নেতৃত্ব সাংবাদিক জগতে বিরল। দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব যখনই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তখনই তিনি বুক চিতিয়ে প্রতিবাদ করেছেন।’</p> <p>তিনি আরো বলেন, ‘সর্বশেষ ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় অসুস্থ থাকার পরও তিনি রাজপথে নেমে সাংবাদিকদের সাহস জুগিয়েছেন। তার মৃত্যু সাংবাদিকতা জগতে একটি শূন্যতা সৃষ্টি করেছে।’ </p> <p>বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, ‘সাংবাদিকদের অন্যতম সর্বোচ্চ এই নেতার মারাত্মক কিডনির সমস্যা ছিল। এরপরও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে ১৭ মাস জেলে রাখে। সেখানে তাকে উপযুক্ত চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হয়নি। চিকিৎসায় অবহেলা করে তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এজন্য স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার এবং ওই সময় দায়িত্বপালন করা কারাগারের জেলার ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা উচিত। তাদের গ্রেপ্তার করে বিচার করতে হবে।’</p> <p>ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘রুহুল আমিন গাজী ভাই নেই, বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই তাকে চিনি। তিনি ছিলেন একজন অসীম সাহসী নেতা। প্রতিকূল পরিবেশেও তিনি সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। সর্বশেষ ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতনের আগের দিনও তিনি অসুস্থ অবস্থায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে পেশাজীবীদের আন্দোলনে রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছেন।’ </p> <p>সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ূম বলেন, ‘রুহুল আমিন গাজীর একটি কিডনি কেটে ফেলতে হয়েছিল। এ ধরনের রোগীকে নিয়মিত চিকিৎসা দিতে হয়। কিন্তু তাকে জেলে নিয়ে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি মূলত একজন শহীদ।’ </p> <p>জামায়াতে ইসলামীর আমির হাবিবুর রহমান বলেন, ‘রুহুল আমিন গাজী ভাইকে হারিয়ে একটি শূন্যতা অনুভব করছি। তার মতো এমন সৎসাহসী নেতৃত্ব বিরল। তার মধ্যে কোনো মৃত্যুভয় ছিল না। কোনো ভীরুতা ছিল না। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সাংবাদিকদের পেশাবিরোধী সব কালাকানুনের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেছেন। এ জন্য তাকে ১৭ মাস কারাগারে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তার পরিবারকে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে।’</p>