<p style="text-align:justify">ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৭ আগস্ট থেকে বর্তমান পর্যন্ত যত হত্যা মামলা হয়েছে তার বেশির ভাগেই করা হয়েছে ঢালাও আসামি। রাজধানীর ঘটনায় লালমনিরহাট, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার স্থায়ী বাসিন্দাদের আসামি করা হয়েছে। ঘটনাস্থল তো দূরের কথা, এসব আসামি ঘটনার দিন রাজধানীতেই ছিলেন না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢালাও আসামি করায় মামলাগুলো নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।</p> <p style="text-align:justify">কারণ এসব হত্যা মামলার আসামি কে বা কারা, তা জানেন না খোদ বাদী কিংবা সাক্ষী। ঢালাও আসামিদের বড় একটি অংশ ব্যবসায়ী। অভিযোগ উঠেছে, হয়রানি, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, ব্যক্তিগত রেষারেষি, পূর্বশত্রুতা, চাঁদাবাজি—এসব কারণে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ঢালাও আসামি করা হয়েছে। আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব মামলা ট্রায়ালে গিয়ে প্রথম পর্যায়েই বাতিল হয়ে যাবে। এতে প্রকৃত আসামিদের বিচারকাজে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে।</p> <p style="text-align:justify">সর্বশেষ গত ১৭ অক্টোবর খিলগাঁও থানায় আন্দোলনে নিহত আহাদুল ইসলাম হত্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন জেড আই খান পান্নাকে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি করা হলে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়। এরপর বাদী থানায় আবেদন করেন ওই মামলায় এই আইনজীবীর নাম ভুলবশত এসেছে, তাঁকে যেন মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।</p> <p style="text-align:justify">মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) নির্বাহী অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান মনে করেন, এ ধরনের হয়রানিমূলক ভিত্তিহীন মামলা করে বিশিষ্ট নাগরিক ও মানবাধিকারকর্মীদের অসম্মানিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা স্বাধীন মতামত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে।</p> <p style="text-align:justify">ঢালাও হত্যা বা হত্যাচেষ্টা মামলা করায় প্রকৃত আসামি ও দায়ীদের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে জনমনে সংশয় দেখা দিয়েছে। এতে বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে।<br /> এভাবে ঢালাও মামলায় যাতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কারো নাম জড়ানো না হয়, সে জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সতর্কবার্তাও দেওয়া হয়েছে। তার পরও থামছে না ঢালাও মামলা করার প্রবণতা। </p> <p style="text-align:justify">যাত্রাবাড়ী থানার একটি হত্যা মামলা সূত্রে  জানা গেছে, ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী মোড়ে মিরাজুল (২১) নামের এক তরুণ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ওই ঘটনায় তাঁর বাবা মো. আব্দুস ছালাম ২৪ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা (মামলা নম্বর ১৭) করেন। ওই মামলায় ৩৬ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয় আরো ২০০ থেকে ৩০০ জনকে। মামলাটিতে নাম উল্লেখ করা ৩৬ জনেরই বাড়ি লালমনিরহাট সদরে। সবাই সেখানকার স্থায়ী ও আবাসিক বাসিন্দা। এঁদের মধ্যে কেউ রাজধানীতে থাকেন না। বেশির ভাগের কেউ কখনো রাজধানীতেই আসেননি।</p> <p style="text-align:justify">এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আসামিদের মধ্যে তিনজন লালমনিরহাট ১, ২ ও ৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। অন্যরা কলেজ ও স্কুল শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার। তাঁদের বেশির ভাগের দলীয় কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। তাঁদের কেউ ঘটনাস্থল তো দূরের কথা ঘটনার দিন রাজধানীতেই ছিলেন না। আবার মামলার তিন সাক্ষী লালমনিরহাটের আবাসিক ও স্থায়ী বাসিন্দা। ৫ আগস্ট এঁরা সবাই লালমনিরহাটে ছিলেন।</p> <p style="text-align:justify">মামলাটি সম্পর্কে স্থানীয় একজন সংবাদকর্মী জানান, বাদী নিজেই জানেন না যে আসামি কারা। এক পর্যায়ে বাদী যখন ১২ জন আসামির নাম প্রত্যাহারের আবেদন করেন, তখন বাদীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ধরনের অনেক ঘটনা লালমনিরহাটে ঘটেছে। চাঁদার দাবিতে করা হচ্ছে এ ধরনের মামলা।</p> <p style="text-align:justify">তিনি আরো জানান, এমন ঘটনাও ঘটেছে যে মামলা রেকর্ড হয়নি, অথচ মামলার এজাহারের কপি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ ব্যবসায়ীদের নাম বাদ দিতে বিপুল অঙ্কের অর্থ নিয়ে দর-কষাকষিও হয়েছে। অনেকে অর্থের বিনিময়ে মামলা রেকর্ডের আগে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। মূলত এলাকার রাজনৈতিক বিরোধ ও ব্যক্তিগত শত্রুতাকে কেন্দ্র করে তাঁদের আসামি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।</p> <p style="text-align:justify">বাদী মো. আব্দুস ছালাম বলেন, ‘আসামিদের কয়েকজন সংসদ সদস্য। অন্যরাও কোনো না কোনোভাবে ঢাকায় থাকেন। আমি বলি না যে তাঁরা আসলে ঘটনার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তাঁরা সংঘবদ্ধ হয়ে এই কাজটা করে থাকতে পারেন, এ রকম সম্ভাবনা থেকেই মামলাটি করেছি।’</p> <p style="text-align:justify">মামলার এজাহারের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার এসআই মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সব আসামি লালমনিরহাটের, এ বিষয়টি নিয়ে তেমন কিছু বলতে পারব না। সব বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত করা হচ্ছে।’</p> <p style="text-align:justify">অন্যদিকে আলোচিত মামলাগুলোর মধ্যে আরেকটি হলো আন্দোলনে নিহত সিয়াম হোসেন জিহাদের (১৬) মামলা। হোটেলের কর্মচারী জিহাদ ১৮ জুলাই গুলিতে নিহত হন। এ মামলার বাদী জিহাদের বাবা সোহাগ, মামলার সাক্ষী নিহতের মা জেসমিন বেগম (৪১) এবং তাঁর নানা।</p> <p style="text-align:justify">বাদী সোহাগ বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে আমাদের তিনটি দল শুধু খুঁজতেছে। উনারা আমাদের পেয়ে যত্ন করেছে। পরে আমাদের নিয়ে মডেল থানায় গিয়ে মামলা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যাঁদের আসামি করা হয়েছে তাঁদের কাউরে আমরা চিনি না।’</p> <p style="text-align:justify">খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জিহাদ হত্যা মামলায় মিরপুর বেনারসিপল্লীর এক ডজনের বেশি ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে তাঁদের কয়েকজনের আওয়ামী লীগের পদ-পদবি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাস্তবে তাঁদের এমন কোনো পদ-পদবি নেই বলে জানা গেছে। ব্যক্তিগত আক্রোশে এই মামলায় তাঁদের নাম জড়ানো হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">ভুক্তভোগী নজরুল নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমার নামে হত্যা মামলা করা হয়েছে। আমি বিচারের মুখোমুখি হব। তবে যারা আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে তাদের বিচার চাই। তারা কোন উদ্দেশ্যে মামলায় নাম দিয়েছে সেই মুখোশ উন্মোচন করতে চাই।’</p> <p style="text-align:justify">নিহত জিহাদের নানা রহিম জমাদ্দার বলেন, “উনাদের বলেছিলাম, এত বেশি আসামি দিলে মামলা হালকা হইয়া যাইবো। কম আসামি দেন। তারা তখন বলল, ‘আপনারা এডা বুঝবেন না। এটা রাজনৈতিক মামলা।’”</p> <p style="text-align:justify">মামলার সাক্ষী সরফাজুল খান পাপ্পু জানান, তিনি আন্দোলনে নিহত দুটি হত্যা মামলায় সাক্ষী হয়েছেন।</p> <p style="text-align:justify">আসামি এত বেশি কেন, জানতে চাইলে মামলার আইনজীবী কামরুজ্জামান সুমন মামলার সাক্ষী, বাদী ও থানাকে দুষলেন।</p> <p style="text-align:justify">এদিকে রাজধানীর ভাসানটেকের একটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে তিন শতাধিক ব্যক্তিকে। ৫ আগস্ট বঙ্গভবনের সামনে বিএনপির মহাসচিবের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন টেলিভিশন সাংবাদিক শাহনাজ শারমিন। কিন্তু ভাসানটেকের ১১ সেপ্টেম্বর করা মামলার এজাহার বলছে, সে সময় তিনি ফজলু নামের এক গার্মেন্টসকর্মীকে প্রথমে রড দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করেন। এরপর এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করেন। ওই মামলায় এই সিনিয়র সাংবাদিককে ৫০ নম্বর আসামি করা হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">শাহনাজ শারমিন বলেন, ‘আমি সে সময় অন্যান্য সাংবাদিকের মতো ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম, যা সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে। কেউ যড়যন্ত্র করেই আমার নামটি যোগ করে দিয়েছে।’</p> <p style="text-align:justify">এই মামলার বাদী গাড়িচালক সবুজ মিয়া ভাসানটেক এলাকা ছেড়ে গেছেন। মোবাইলে ফোন করলে তাঁর স্বজনরা জানায়, তিনি এখন সাভারে থাকেন।</p> <p style="text-align:justify">খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ অবস্থায় বর্তমানে অনেক মামলার বাদী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। মামলার কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা-ও জানেন না তাঁরা। ৭ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ডিএমপিতে অন্তত ২০টি হত্যা মামলা করা হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কেউ যদি অপরাধে জড়িত থাকে, অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কিন্তু কাউকে হেয় প্রতিপন্ন কিংবা হয়রানি করতে যত্রতত্র মামলায় ঢালাও আসামি করা উচিত নয়। এতে সুবিচার করার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়।’</p>