<p style="text-align:justify">গত দুই দশকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বাড়লেও লোকবল বাড়েনি। অবসরে যাওয়া কর্মচারীদের পদ শূন্য রয়েছে এক-তৃতীয়াংশ। এমন পরিস্থিতিতে হাসপাতালটির পরিচ্ছন্নতা নিয়ে নানা সংকট তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি দুজন অফিস সহায়ককে সাময়িক ভারপ্রাপ্ত ওয়ার্ড মাস্টার পদে দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে বির্তক তৈরি হওয়ার পর বিষয়টি সামনে আসে। প্রশ্ন উঠেছে ওয়ার্ড মাস্টার পদ যেখানে ছয়টি, সেখানে ১০ জন কিভাবে দায়িত্ব পায়?</p> <p style="text-align:justify"> </p> <p style="text-align:justify"><img alt="ঢাকা মেডিক্যাল নাকাল" height="281" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/10.October/25-11-2024/77777.jpg" style="float:left" width="346" />জানা গেছে, গত ১৫ বছরে ওয়ার্ড মাস্টার পদ শূন্য হয়েছে চারটি। তবে নতুন করে কাউকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। হাসপাতাল কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে বর্তমান ও সাবেক পরিচালক মোট আটজনকে সাময়িক ভারপ্রাপ্ত ওয়ার্ড মাস্টার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।</p> <p style="text-align:justify">স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, যদি হাসপাতাল পরিচালনা কার্যক্রম ব্যাহত হয় তাহলে শূন্যপদে সাময়িকভাবে দায়িত্ব প্রদানে বাধা নেই।</p> <p style="text-align:justify">লোকবল সংকট প্রকৃতপক্ষে কতটা অপরিচ্ছন্নতার কারণ—এমন প্রশ্নের সত্যতা খুঁজতে রাজধানীর আরো তিনটি সরকারি হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, প্রতিটি ওয়ার্ডে সার্বক্ষণিক দুজন করে সুইপার, আয়া বা ওয়ার্ডবয় থাকা জরুরি। এর সঙ্গে প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত একজন করে মাস্টার প্রয়োজন। </p> <p style="text-align:justify">৫০০ শয্যার মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২৫টি ওয়ার্ডের জন্য ওয়ার্ড মাস্টার পদ রয়েছে ২২টি।</p> <p style="text-align:justify">যদিও কর্মরত আছেন মাত্র ছয়জন। হাসপাতালটির পরিচালক ডা. হাসিবুল ইসলাম সবুজ কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন ওয়ার্ড মাস্টার থাকা জরুরি। এর সঙ্গে প্রতি শিফটে একাধিক ওয়ার্ড বয় বা আয়া ও ক্লিনার থাকতে হবে। এটি নিশ্চিত করা না গেলে হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন রাখা কোনো দিনও সম্ভব নয়। </p> <p style="text-align:justify">স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (সংক্রামক) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, আমাদের স্বাস্থ্য খাত চলে উল্টোভাবে। চিকিৎসক বেশি, নার্স কম, সহায়কজন আরো কম। যে কারণে বেশির ভাগ হাসপাতাল অপরিচ্ছন্ন থাকে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>সরেজমিনে যা দেখা গেল :</strong> জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ড—সব জায়গায় ময়লার দুর্গন্ধ। রোগীদের গোসলখানা ও শৌচাগারগুলোর অবস্থা খুবই বেগতিক। তবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এমন চিত্র গত দুই দশকের।</p> <p style="text-align:justify">সরেজমিনে দেখা যায়, পুরনো ভবনের নিচতলার মহিলা সার্জারি ওয়ার্ডে একটি শয্যার বিপরীতে রোগী রাখা হয়েছে তিনজন করে। দুই শয্যার মাঝে ফাঁকা জায়গায়ও হাঁটার উপায় নেই। সেখানে পাটি পেতে শুয়ে আছে রোগী। ওয়ার্ডের বারান্দায় ময়লার পাহাড়। ময়লার দুর্গন্ধে পেটের নাড়ি-ভুঁড়ি বেরিয়ে আসার উপক্রম। গোসলখানা ও শৌচাগারগুলোর অবস্থা আরো খারাপ।</p> <p style="text-align:justify">দ্বিতীয়তলার শিশু ওয়ার্ডের অবস্থাও একই। গোসলখানা ও শৌচাগারের পানিতে পুরো ওয়ার্ডে স্যাঁতসেঁতে অবস্থা। তবে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে আলাদা শৌচাগার রয়েছে। সেগুলোর অবস্থা ভালো।</p> <p style="text-align:justify">দ্বিতীয়তলায় নিউরোসার্জারির ওয়ার্ডের শয্যার বাইরেও মেঝে, করিডর ও ঢালু সিঁড়িতে পাটি বিছিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে খাবারের উচ্ছিষ্ট, পলিথিনের ব্যাগ, প্লাস্টিকের বোতল, ওষুধের বোতল, ইনজেকশনের শিশি-সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজ-গজ, স্যালাইনের প্যাকেট, রক্ত ও পুঁজমাখা তুলা-গজসহ নানা মেডিক্যাল বর্জ্য। মশা, মাছি ভোঁ ভোঁ করছে।</p> <p style="text-align:justify">হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, হরিজন সমপ্রদায় মানুষ পরিচ্ছন্নতায় দক্ষ হয়। কিন্তু আমরা এ সম্প্রদায়ের মানুষ পাচ্ছি না।</p> <p style="text-align:justify">পাঁচ শতাধিক গোসলখানা ও শৌচাগার থাকলেও ব্যবহার উপযোগী দু শরও কম। দিনে দুবার করে এগুলো পরিষ্কার করার কথা থাকলেও অনেক সময় একবারও করা হয় না বলে রোগী ও তাঁদের স্বজনদের অভিযোগ।</p> <p style="text-align:justify">হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সুইপার, আয়া, ওয়ার্ডবয় মিলিয়ে ৯৩৫ জনের মধ্যে কর্মরত আছেন ৭৭২ জন। এর সঙ্গে ডে লেবার নেওয়া হয়েছে ৫৫০ জন। যাঁরা তিন শিফটে পালাক্রমে হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় কাজ করেন। পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, লোকবল সংকটের পাশাপাশি কর্মীদের গাফিলতি ও তদারকিরও প্রচণ্ড অভাব রয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">জানা যায়, ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর জন্য দু শ শয্যাবিশিষ্ট ফিল্ড হাসপাতালটিকে ১৯৭২ সালে উন্নীত করা হয় এক হাজার ৮০ শয্যায়। তখন ছয়জন ওয়ার্ড মাস্টারসহ সহায়ক লোকবল ছিল আট শতাধিক। এরপর দুই ধাপে হাসপাতালটি মোট দুই হাজার ৬০০ শয্যায় উন্নীত হয়, ওয়ার্ডের সংখ্যা বেড়ে হয় ১০৯টি। এই সময় হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়লেও ওয়ার্ড মাস্টার, সুইপার, আয়া, ওয়ার্ডবয় বাড়েনি; বরং অবসরে যাওয়ার কারণে কমেছে।</p> <p style="text-align:justify">হাসপাতালটিতে রোগী ভর্তি থাকেন শয্যাসংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ। বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেয় অন্তত আরো ছয় হাজার রোগী। এক রোগীর সঙ্গে দুজন করে আত্মীয়, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্বাস্থ্যকর্মী মিলিয়ে হাসপাতালে মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় দিনে গড়ে ৪০ হাজারের বেশি। যারা হাসপাতালের শৌচাগার ব্যবহার করেন।</p> <p style="text-align:justify"><strong>পরিচ্ছন্ন হাসপাতাল কেন জরুরি :</strong> স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (সংক্রামক) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো রোগে আক্রান্ত হলে নিরাময় পেতে হাসপাতালে ছুটে যায় রোগীরা। অথচ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যথাযথ সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা না থাকায় দিন দিন হাসপাতালই হয়ে উঠছে রোগ বিস্তারের কেন্দ্র।</p>