<p style="text-align:justify">লাগামহীন দুর্নীতি, দখলবাজি, নিয়োগ ও তদবির বাণিজ্যসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বারবার সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। আলাদীনের চেরাগ পেয়ে রাতারাতি হয়েছেন শতকোটি টাকার মালিক। ১২ বছরে তাঁর সম্পদ বেড়েছে দুই হাজার ৮০০ গুণ। তাঁর ক্ষমতা ব্যবহার করে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে তাঁর আত্মীয়-স্বজনও।</p> <p style="text-align:justify">তাঁর অপকর্মের তালিকা বেশ লম্বা। মূলত দখলের মাধ্যমে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বাসা থেকে জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা।</p> <p style="text-align:justify"><strong>উত্থান-পতন </strong>: জাকির হোসেন ২০০৮ সালে কুড়িগ্রাম-৪ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রথমবার নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে জেপির প্রার্থী রুহুল আমিনের কাছে হেরে যান। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও জেতেন আওয়ামী লীগের টিকিটে। পরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করা হয় তাঁকে। দীর্ঘদিন পর কুড়িগ্রাম জেলায় আওয়ামী লীগের একজন প্রতিমন্ত্রী হন তিনি। কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার পরই দাপট বেড়ে যায় তাঁর। বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডের কারণে ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়নও পাননি।</p> <p style="text-align:justify"><strong>সম্পদ বেড়েছে প্রায় তিন হাজার গুণ </strong>: ২০০৮ সালে হলফনামায় জাকির হোসেন ও তাঁর স্ত্রীর বার্ষিক আয় দেখান দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা। মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ১০ হাজার টাকা। ২০১৪ সালে এক লাফে তাঁর বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ লাখ ৬২ হাজার ২৯৫ টাকায়।</p> <p style="text-align:justify">নগদ অর্থসহ সম্পদের পরিমাণ দেখান ৯১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৮৩ টাকা। মোড় ঘুরে যায় ২০১৮ সালে। আয় কমিয়ে দেখান দুই লাখ ৭৯ হাজার টাকা। তবে সম্পদ বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ কোটি ১২ লাখ টাকা। গত ১১ সেপ্টেম্বর জাকির হোসেনের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি তদন্ত করে দেখার ঘোষণা দিয়েছে দুদক।</p> <p style="text-align:justify"><strong>দখলবাজিতে ছিলেন মরিয়া </strong>: এমপি ও মন্ত্রীর ক্ষমতার প্রভাবে নানা কৌশলে দখলবাজি চালিয়ে গেছেন জাকির হোসেন। এর মধ্যে জমির শ্রেণি পরিবর্তন, অর্পিত সম্পত্তি ও খাস খতিয়ানের জমি নিজ নামে লিজসহ নানা জালিয়াতি রয়েছে। মন্ত্রীর প্রতিবেশী আনোয়ার হোসেন দাবি করেন, আগে মন্ত্রীর বাড়ি যাওয়ার রাস্তা ছিল না। তাই বাড়ির সামনে তাঁর ৪৫ শতক জমি অর্পিত সম্পত্তি দেখিয়ে কাগজপত্র বানিয়ে দখলে নেন জাকির হোসেন। প্রতিবাদ করলে অস্ত্র উঁচিয়ে ভয় দেখাতেন। নতুন বন্দর এলাকায় মমেনা বেগম নামের এক বিধবার ১৫ শতাংশ জমি দখল করে বহুতল ভবন তৈরি করেছেন এই সাবেক মন্ত্রী। চর শৌলমারী ঈদগাহ মাঠ এলাকায় জাকির হোসেন ৩৫ শতক জমি নামমাত্র মূল্যে কেনেন। পরে সৌরবিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের নামে অনেকের জমি লিখে নেন। কিন্তু বিদ্যুৎ প্লান্ট না করে আড়াই একর জায়গা প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ব্যক্তিগত স্থাপনা নির্মাণ করেন। চর শৌলমারী ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য বেলাল হোসেন জানান, জায়গাটি চাকরির লোভ দেখিয়ে দখলে নেন। ভরাটের জন্য তাঁর কাছ থেকে বালু নিয়ে তিন লাখ টাকাও মেরে দিয়েছেন জাকির হোসেন।</p> <p style="text-align:justify">২০২২ সালে তুরা রোডে মালিকানাধীন কয়েক শতাংশ জমি কিনে সড়ক ও জনপদ বিভাগের জায়গা ভরাট করে ৭০ শতক জমি দখলে নেন জাকির হোসেন। পরে ‘শেখ ফজিলাতুন্নেছা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’-এর সাইনবোর্ড টানিয়ে দখরদারি হালাল করতে চান। বর্তমানে সেখানে ছেলে শাফায়াত পাথরের ব্যবসার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তুরা রোডে আরো দুটি স্থানে ২১ ও ৫০ শতক জমি দখল করে নিজম্ব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। কর্তিমারী বাজারে অন্যের দখলে থাকা ১ নম্বর খাস খতিয়ানের ৩২ শতক জমি কিনে দখল করেন ৭০ শতক। সেখানে বহুতল মার্কেট নির্মাণের কাজ চলমান। সদর ইউনিয়নের জন্তিরকান্দা নামক স্থানে সরকারি এক একর জায়গা দখল করে ‘শিরি অটো রাইস মিল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।</p> <p style="text-align:justify">এ ছাড়া রাজীবপুর উপজেলায় শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামসংলগ্ন উপজেলা পরিষদের পুকুর ভরাট করে ২০ শতাংশ জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে দোকানঘর বানিয়েছেন জাকির হোসেন। বন্দবেড় ইউনিয়নের কুটিরচরে এক একর, দইখাওয়ায় পাঁচ একর জমি দখল, দাঁতভাঙায় এক একর সরকারি জায়গা দখল করে ‘আরব আলী বাবার মাজার’ নির্মাণসহ দোকানপাট গড়ে তোলা হয়। এ ছাড়া জামালপুরের বকশীগঞ্জে পাহাড়ি এলাকায় ৬০ বিঘা জমি দখল করে গড়ে তুলেছেন ‘মায়ের মাজার’।</p> <p style="text-align:justify"><strong>মার্কেট-বাড়ি </strong>: রৌমারী সদরের কাঁচাবাজারে রয়েছে জাকির হোসেনের একটি চারতলা মার্কেট। কর্তিমারী বাজারে কেনা ৭০ শতক জমির ওপর চারতলা সুপার মার্কেটের একতলার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। রাজীবপুর শহরেও চলছে আরো একটি সুপার মার্কেট নির্মাণের কাজ। রৌমারীপাড়ায় ৪০ শতক জমির ওপর আলিশান বাড়ি, রাজীবপুর শহীদ মিনারসংলগ্ন ১০ শতক জমির ওপর একটি পাকা বাড়ি, কুড়িগ্রাম শহরের কুমারপাড়ায় ২০ শতক জমির ওপর একটি বাড়ি, রংপুরের নাজিরেরহাটে ৪০ শতক জমি ও একটি বাড়ি রয়েছে। ঢাকায় তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া সুলতানার নামে রয়েছে ফ্ল্যাট। এ ছাড়া পূর্বাচলে একটি ১০ শতাংশের প্লট ও বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>বিতর্কিত যত কাণ্ড </strong>: মাদক বাণিজ্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে জাকির হোসেনের নাম আসে গোয়েন্দা রিপোর্টেও। ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জাকির হোসেনের পারিবারিক মাইক্রোবাসে ইয়াবা পাচারের সময় গাড়িচালক রফিকুল ইসলামকে আটক করে র‌্যাব। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের চাকরির নামে ৪৮ জন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের কাছ থেকে ৯৪ লাখ টাকা ঘুষ নেন জাকির হোসেন। কিন্তু চাকরি না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গত বছরের ৭ ডিসেম্বর টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে অভিযোগকারীদের বাসায় ডেকে এনে মন্ত্রী ও বাসার কর্মচারীরা মিলে বেদম প্রহার করেন। এ ছাড়া শোক দিবসের সভায় ‘আমরা কায়মনোবাক্যে দোয়া করি বঙ্গবন্ধুকে আল্লাহ জাহান্নামের ভালো জায়গায় স্থান করে দেয়’—এই বক্তব্য দিয়ে ভাইরাল হন।</p> <p style="text-align:justify"><strong>নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য </strong>: প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর জাকির হোসেনের ছত্রচ্ছায়ায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তাঁর স্বজনরা। নিয়োগ, বদলি, বালুর ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও এপিএস কল্লোল। কুড়িগ্রামে পার্টিসিপেটরি অ্যাডভান্সমেন্ট সোশ্যাল সার্ভিস (পাশ) নামে বেসরকারি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক খ ম আলী সম্রাট জানান, কুড়িগ্রাম সদরে নন ফর্মাল স্কুল স্থাপনের জন্য অনুমোদন দেওয়ার কথা বলে মন্ত্রীর আত্মীয় মাসুম, রাশেদ ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা কল্লোল তাঁর কাছ থেকে দুই দফায় নগদ ২০ লাখ টাকা ও চেকের মাধ্যমে পাঁচ লাখ টাকা নেন। সম্প্রতি তিনি সদর থানায় এ ব্যাপারে একটি মামলা করেছেন। পুলিশ অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ওই তিন আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে।</p>