<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সামন্তবাদী কিংবা পুঁজিবাদী, আধিপত্যবাদী কিংবা উপনিবেশবাদী</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">যেখানেই যেকোনো ধরনের অপশাসন ও শোষণ দেখেছেন, সেখানেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে গর্জে উঠেছেন আজন্ম সংগ্রামী মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। খোলা তরবারির মতো ঝলসে উঠেছে তাঁর দুটি হাত। কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে বিদ্রোহের হুংকার। কৈশোর থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত তাঁর দীর্ঘ ৯৬ বছরের জীবনটি ছিল সংগ্রামের একটি পরিপূর্ণ ইতিহাস। তিনি যেমন দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের হয়ে জমিদার, মহাজন ও শিল্পপতিদের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তেমনি পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সার্বিক সংগ্রামে ছিলেন আপসহীন। তাঁর দীর্ঘ জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কেটেছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসকদের কারাগারে। তৎকালীন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জে ১৮৮০ সালে জন্মগ্রহণ এবং ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর টাঙ্গাইলের সন্তোষে মৃত্যুবরণ করেন এই অগ্নিপুরুষ। এর মধ্যে আড়াই দশকের মতো তিনি ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলে কাটিয়েছেন। শৈশবে মা-বাবাকে হারিয়ে ভাসানীর শুরু হয়েছিল নিজের অস্তিত্ব রক্ষার এক নিদারুণ সংগ্রাম। শৈশবে একসময় তিনি সিরাজগঞ্জ বাজারে মুটে-মজুরের কাজ করে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। এবং রাতে তাঁর আশ্রয় হতো যমুনার বুকে নোঙর করা সওদাগরি নৌকায় নতুবা দোকানের খোলা বারান্দায়। অথচ সেদিনের সেই কিশোরটির জন্ম হয়েছিল এক অবস্থাপন্ন গ্রামীণ পরিবারে। পিতৃ-মাতৃহীন কৈশোর থেকেই শোষণ-শাসন ও বঞ্চনার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল ভাসানীর। তিনি সমাজের পদে পদে প্রত্যক্ষ করেছেন কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি জনতার ওপর অন্যায় শোষণ-শাসন ও জুলুম-নির্যাতনের চিত্র, যা তাঁকে ক্রমে প্রতিবাদী এবং এক পর্যায়ে বিদ্রোহী করে তোলে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><img alt="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/11.November/17-11-2024/2/kalerkantho-ed-1a.jpg" height="316" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/11.November/17-11-2024/2/kalerkantho-ed-1a.jpg" style="float:left" width="350" />সে অবস্থায় বেড়ে ওঠার মধ্যেও তরুণ ভাসানী বিভিন্ন সময় ও সুযোগমতো কিছু ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তিনি এক পর্যায়ে ময়মনসিংহের একটি মাদরাসা থেকে টাঙ্গাইলের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় ফিরে আসেন। বলতে গেলে সেই থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে শুরু হয়েছিল ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১৯ সালে ভাসানী ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ এবং খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে তিনি সে সময়ে বিরাজমান মহামন্দা ও দুর্ভিক্ষকালীন অসহায় কৃষককুলের পাশে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সে অবস্থায় তাঁর এক বিবাদ শুরু হয়েছিল সন্তোষের তৎকালীন মহারাজার সঙ্গে, যা শেষ পর্যন্ত তাঁকে টাঙ্গাইল ছাড়তে বাধ্য করেছিল। সংগ্রামী ভাসানী ১৯৩০ সালের শেষের দিকে টাঙ্গাইল থেকে আসামের ঘাগমারায় নিজেকে স্থানান্তর করেছিলেন। সেখানে তিনি ছিন্নমূল বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের স্বার্থের পক্ষে আন্দোলন জোরদার করে তোলেন। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ভাসান চরে কৃষকদের বন্যা থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি বাঁধ নির্মাণ করেন এবং বিভিন্ন পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। সেই থেকে আবদুল হামিদ খানের নাম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ভাসানীর মওলানা</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> হিসেবে। কৃষক ও শ্রমিক কুলের বেশির ভাগ মানুষ তাঁর প্রকৃত বা আসল নামটি জানতই না। সবাই চিনত মওলানা ভাসানী নামে। সে সময় আসাম সরকার বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের বিস্তার রোধ করার জন্য ভৌগোলিকভাবে একটি </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লাইনপ্রথা</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> চালু করে। এতে বাঙালি বসতি স্থাপনকারী, বিশেষ করে ভূমিহীন কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের সমূহ ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। সে প্রথার বিরুদ্ধে বাঙালি কৃষকসমাজকে সংঘবদ্ধ করে ভাসানী একটি আন্দোলন গড়ে তোলেন। সে আন্দোলনই মওলানা ভাসানীকে প্রকৃত অর্থে সমগ্র ভারতবর্ষ এবং আন্তর্জাতিকভাবে একজন কৃষক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। লাইনপ্রথা আন্দোলনই ভাসানীকে সব দিক থেকে ভাসানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এ মন্তব্য করেছিলেন বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক প্রয়াত সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি ভাসানীর ওপর লিখিত তাঁর একটি তথ্যবহুল ও মূল্যবান গ্রন্থে সে কথা উল্লেখ করেছেন।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৩৭ সালে আসাম মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। এতে নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে ভাসানীর সাংগঠনিক শক্তি ও মর্যাদা অনেক বেড়ে যায়। এবং আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী স্যার মোহাম্মদ সাদ উল্লাহ ও অন্যান্য স্থানীয় নেতার সঙ্গে তখন ভাসানী ও তাঁর বাঙালি কৃষক অনুসারীদের এক বিরাট দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছিল। ভাসানী তখন আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় অবস্থান নিয়েছিলেন। ভাসানীকে তখন চক্রান্তমূলকভাবে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৯৪৭ সালে আসাম থেকে চিরস্থায়ীভাবে চলে যাওয়ার শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জঙ্গল ও ঝোপঝাড় কেটে আবাদ করা আসামের ওপর মওলানা ভাসানী কখনো বাঙালি কৃষককুল ও শ্রমিক শ্রেণির অধিকারের বিষয়টি ভুলে যাননি কিংবা রাজনীতিগতভাবে তাদের দাবির প্রশ্নে আপস করেননি। সে কারণে মৃত্যুর আগেও তিনি আসামের বেশ কিছু অঞ্চল (করিমগঞ্জসহ) বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করার কথা বারবার বলে গেছেন। আসাম, পূর্ব বাংলা, ত্রিপুরা রাজ্যসহ বেশ কিছু অবিচ্ছেদ্য অঞ্চল নিয়ে তিনি বৃহত্তর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। এ ক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলার কথাও তিনি দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, পশ্চিম বাংলা, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যকে প্রস্তাবিত বৃহত্তর বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা একটি সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের অংশ। পশ্চিম বাংলার শরৎ বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম, মওলানা ভাসানীসহ অনেকে তখন ভারত বা পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে অখণ্ড স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য রীতিমতো আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতদ্বৈতের কারণে শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে বিফল মনোরথ হয়ে ১৯৪৮ সালের সূচনায় ভাসানী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। এবং তাঁর অতীত সংগ্রামের বিচরণক্ষেত্র টাঙ্গাইলে ফিরে এসে তিনি পর পর কয়েকটি কৃষক সমাবেশের আয়োজন করেন। স্থানীয় কৃষকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ভাসানী তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। সে সময় তিনি একটি উপনির্বাচনে টাঙ্গাইলের করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাফল্য লাভ করেও কেন্দ্রের মুসলিম লীগ নেতৃত্বের কূটচালে তা হারিয়ে ফেলেন। সেসব কারণে অতি অল্প সময়ের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানি, বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের আধিপত্য বিস্তার ও শোষণ-শাসনের অপকৌশল দেখে ভাসানী মুসলিম লীগের ওপর আস্থা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেন। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">উল্লিখিত কারণে ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান মুসলিম লীগ থেকে পৃথক হয়ে মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫২ সালের শুরুতে ভাসানী রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে মাঠে নামেন। তিনি সে সময় পুরান ঢাকার বার লাইব্রেরিতে একটি সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। সে বছর ২৩ ফেব্রুয়ারিতে ভাসানীকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছিল। জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। এতে কৃষক-শ্রমিক পার্টির প্রতিষ্ঠাতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান, হাজী মোহাম্মদ দানেশসহ অনেকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামেন। সে প্রক্রিয়ায় ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট পেয়েছিল ২২৩টি আসন এবং অন্যদিকে মুসলিম লীগ পেয়েছিল সাতটি। সে প্রাদেশিক নির্বাচনে বিজয় শেষ পর্যন্ত বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের একটি বিশেষ অংশকে নিয়ে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন, যার প্রধানমন্ত্রী পদে তিনি অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তখন থেকে বিভিন্ন নীতিগত মৌলিক প্রশ্নে তাঁদের সঙ্গে বিরোধ বাধে মওলানা ভাসানীর। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাক্ষরিত পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি এবং সেন্টো ও সিয়াটো গঠনের সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যের প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী নিজের প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেছিলেন। ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ভাসানী তাঁর অনুসারীদের নিয়ে গঠন করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। তখন সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার অভিযোগ ওঠে। তা ছাড়া সে সম্মেলনেই ভাসানী পাকিস্তানকে সালাম জানিয়ে বিদায় দেন। অফুরন্ত রাজনৈতিক প্রাণশক্তির অধিকারী মওলানা ভাসানী সেখানেই থেমে থাকেননি। তিনি সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের প্রগতিশীল অংশের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন। তাই ১৯৬৭ সালে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব বিভিন্ন নীতির প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়লে ভাসানী মস্কোর নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত রাজনীতির বিপক্ষে চীনের মাও জেদংয়ের বিভাজনের দিকে অবস্থান নেন।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এর আগে অর্থাৎ তৎকালীন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে যখন তাঁর দলের ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, তখনই তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, এতে কোনো ফায়দা হবে না। এই ছয় দফা শিগগিরই এক দফায় রূপান্তরিত হবে। ভাসানী জানতেন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবের কর্মসূচি মানবে না। এবং পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকরা ক্রমে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাবে। কর্মসূচি ঘোষণার কিছুদিন পরই পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করেন। তখন মওলানা ভাসানী সংগ্রামী ছাত্র-জনতাকে নিয়ে শেখ মুজিবের মুক্তির লক্ষ্যে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এবং তাঁরই নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল উনসত্তরের মহান গণ-অভ্যুত্থান। ভাসানী বঙ্গভবন ঘেরাও করেন এবং প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাকে সম্পূর্ণ অচল করে শেষ পর্যন্ত বিনা শর্তে শেখ মুজিবকে মুক্ত করেন। কিন্তু তাতে মূল সমস্যার সমাধান হয় না। ছয় দফা কর্মসূচিকে চলমান রেখেই শেখ মুজিব শেষ পর্যন্ত যোগ দেন সত্তরের নির্বাচনে। ভাসানী কৌশলগতভাবে নির্বাচনকে পাশ কাটিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন তাঁর শেষ পরিণতি দেখার জন্য। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি সচেতন মানুষ যা ভেবেছিল, শেষ পর্যন্ত তা-ই ঘটল। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা দেওয়া হলো না। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী ১৯৭১ সালের ২০ মার্চ  চট্টগ্রামে প্রথমে এক সংবাদ সম্মেলন এবং পরে সেখানে আয়োজিত এক জনসভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করলেন। তিনি এ ব্যাপারে শেখ মুজিবের সঙ্গে জেনারেল ইয়াহিয়াকে যাবতীয় হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে নিতে বললেও পাকিস্তানিরা ২৫ মার্চ তাঁর ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। এরই মধ্যে ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে সেদিন রাতেই নিরীহ জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পরে আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয় যে ঢাকা ত্যাগ করার আগে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণী প্রচার করার ব্যবস্থা করেন।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ ১০ ও ১৭ এপ্রিল স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও প্রবাসী সরকার গঠন করার পর তাঁরা একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন, যার প্রধান করা হয়েছিল মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে। এসব নিয়ে তর্কবিতর্ক যা-ই থাকুক, ভাসানী তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে সক্ষম হয়েছেন। নির্বাসিত জীবন থেকে স্বদেশে ফিরেই তিনি দাবি জানিয়েছিলেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অবিলম্বে সব ভারতীয় সৈন্য ফিরিয়ে নেওয়া হোক।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> তিনি চেয়েছিলেন সত্যিকার অর্থে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র, যেখানে থাকবে সব মানুষের সমান গণতান্ত্রিক অধিকার এবং ঘটবে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি। অন্যায়, অবিচার ও শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটবে। ভাসানী একজন গণতন্ত্রমনা ধার্মিক মানুষ হলেও সাম্যবাদীদের সঙ্গে তাঁর ছিল না কোনো বিরোধ। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধান হয়েও নিজে ক্ষমতার বলয় থেকে দূরে থাকতেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, ভাসানী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইসলামী অনুশাসনের সার্থক সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন; যেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি ও আধ্যাত্মিকতা মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি এবং শান্তি নিশ্চিত করবে। শৈশব-কৈশোরে সিরাজগঞ্জ বাজারে মুটে মজুরের কাজ করে যাঁর জীবন শুরু হয়েছিল, পরিণত বয়সে তিনিই স্বীকৃতি পেয়েছিলেন আফ্রো-এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের একজন নির্ভরযোগ্য নেতা হিসেবে। তিনি মহান চীনের অবিসংবাদিত নেতা মাও জেদং থেকে শুরু করে অনেক স্বনামধন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলবন্ধন রচনা করেছিলেন। তরুণ বয়সে প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ তিনি কখনো পাননি। পরে ভারতের প্রসিদ্ধ ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র দেওবন্দে তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন। আজ পশ্চিমা জগতের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মওলানা ভাসানীর আদর্শভিত্তিক সংগ্রামী জীবনের ওপর গবেষণা করে অনেক ছাত্র-ছাত্রী ডক্টরেট-পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করছেন। ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের এটি একটি সার্থকতা, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু আজও বাংলাদেশে মওলানা ভাসানীর সঠিক মূল্যায়ন হয়নি বলে অনেকে অভিযোগ করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাসূচিতে কোথাও মওলানা ভাসানীর সংগ্রামী জীবন পড়ানো হয় না। অথচ এ দেশের গণ-আন্দোলনের ক্ষেত্রে ভাসানী এখনো প্রাসঙ্গিক।</span></span></span></span></p> <p> </p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">gaziulhkhan@gmail.com</span></span></span></span></p>