<p>একদলীয় শাসন কায়েম করতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ধ্বংস করা হয়েছে। ফ্যাসিবাদ দীর্ঘায়িত করে গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হয়েছে। সংবিধানে কুঠারাঘাত করা হয়েছে।</p> <p>সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানিতে এসব কথা বলেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) মো. আসাদুজ্জামান। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চে রুলটির শুনানি চলছে। গতকাল বুধবার পঞ্চম দিনের শুনানি চলছিল।</p> <p>শুনানিতে পঞ্চদশ সংশোধনীকে কালারেবল লেজিসলেশন (ছদ্মবেশী আইন) উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাহাত্তর সালে আমরা একটা সংবিধান পেয়েছি। সেই সংবিধানের অধীনে ১৯৭৩ সালে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশ সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। সেই স্বৈরশাসনকে বিতাড়িত করতে রাজপথে জীবন দিয়েছেন ডা. মিলন, নূর হোসেন, রউফুন বসুনিয়া, সেলিম, দেলোয়ারসহ অনেকে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন হয় স্বৈরশাসনের। গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু এই অন্তর্বর্তী সরকারের বিধান আমাদের সংবিধানে ছিল না। জনগণের অভিপ্রায় এবং রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে ওই সরকার গঠিত হয়।’</p> <p>এ সময় প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের (প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের বাবা) একটি অভিমত আদালতে তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘উনি বলেছিলেন সংবিধানে না থাকলেও যদি জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য সবাই ঐকমত্যে আসে সেটাই হবে সাংবিধানিক কাঠামো। এ জন্যই তখন রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছিল। সেই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়েছে।’</p> <p>তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। এই সরকারব্যবস্থার অধীনে যে কয়টি সংসদ নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো ছিল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে (ত্রয়োদশ সংশাধনী বাতিলের রায়) পাশ কাটিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে। এতে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়।</p> <p>তত্কালীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলে যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে দেয়নি দাবি করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রায় ঘোষণার ১৬ মাস পরে (প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসরের পর) বিচারপতি খায়রুল হক লিখিত রায়ে বললেন, পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে কি হবে না এটা নির্ধারণ করবে সংসদ। তাঁর লেখা এই রায়ের সঙ্গে দুজন বিচারপতি একমত পোষণ করলেন। তিন বিচারপতি বললেন, তত্ত্বাধায়ক সরকার ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে বৈধ। আর বিচারপতি এস কে সিনহা বললেন, পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে। তার মানে দাঁড়ায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে পরবর্তী দুটি নির্বাচন হবে কি হবে না, সেটি সংসদ নির্ধারণ করবে—এই মত দিয়েছেন তিনজন বিচারপতি। আর পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার পক্ষে মত দিয়েছেন চারজন বিচারপতি। যে তিনজন বিচারপতি সংসদ নির্ধারণ করবে বলে মত দিয়েছেন, তাঁরা সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। রায়ের ভুল ব্যাখ্যা করে সংবিধানকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন, যে কারণে দেশ গণতন্ত্রহীনতার দিকে গেছে। এই সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা। একটি নির্দিষ্ট দলের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা এবং ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠা করতেই ত্রয়োদশ সংশোধনীকে পাশ কাটিয়ে এই সংশোধনী আনা হয়েছিল।</p> <p>পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ করার বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “উনি মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা। উনার অবদান অনস্বীকার্য। তবে আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘আমরা’ (উই) বলা হয়েছে। প্রস্তাবনায় একক কোনো ব্যক্তির প্রাধান্য নেই। একজন ব্যক্তি সব কিছু করেছে—এটা আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার ধারণা নয়। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, উ দ্য পিপল অব বাংলাদেশ (আমরা বাংলাদেশের জনগণ)।”</p> <p>অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘জাতির পিতা একক কোনো বিষয় না। বিষয় হচ্ছে, উনাকে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, শুধু রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার জন্য। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কৃতিত্ব ধ্বংস করার জন্য উনারাই (তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার) দায়ী।’</p> <p> </p>