<p>হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের হাত ধরে যে তৃণমূল সংগঠনের সূচনা হয়েছিল, জাপানের সেই ‘নিহন হিদানকিয়ো’ পাচ্ছে এবারের শান্তির নোবেল। গতকাল শুক্রবার নরওয়ের রাজধানী অসলোর নোবেল ইনস্টিটিউট থেকে এই ঘোষণা দেওয়া হয়।</p> <p>নোবেল কমিটি বলছে, পরমাণু অস্ত্রমুক্ত একটি বিশ্ব গড়ার প্রচেষ্টা এবং পরমাণু অস্ত্র আর কখনো ব্যবহার করা যে উচিত নয়, সেটি প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যের মাধ্যমে তুলে ধরার জন্য জাপানের সংগঠনটিকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।</p> <p>হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে ১৯৪৫ সালে পারমাণবিক বোমা হামলা চালানো হয়েছিল। এই হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে ১৯৫৬ সালে তৃণমূলের এই সংগঠনটি গড়ে ওঠে। সংগঠনটি বোমায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার পাশাপাশি পারমাণবিক অস্ত্র বিলোপের পক্ষে জোরালো আন্দোলন চালিয়ে আসছে। নিহন হিদানকিয়ো সংগঠনটি ‘হিবাকুশা’ নামেও পরিচিত।</p> <p>শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবরে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন সংগঠনটির সহপ্রধান তোশিউকি মিমাকি। প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সংগঠনটি যে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাবে, তা তিনি কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি।</p> <p>এ বছরের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের ঘোষণাটি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কারণ খুব কম মানুষই ধারণা করেছিল যে নিহন হিদানকিয়ো এত তাত্পর্যপূর্ণভাবে স্বীকৃত হবে। পারমাণবিক যুদ্ধের বিপর্যয়কর পরিণতি সম্পর্কে স্মরণ এবং সে সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সংস্থার কার্যকর ভূমিকার ওপর জোর দিয়ে নোবেল কমিটি তার পছন্দের বিজয়ীকে ন্যায়সংগত করার প্রয়াস পেয়েছে বলে সমালোচকরা একমত হয়েছেন।</p> <p>সময় যত যাচ্ছে, জীবিতদের সংখ্যা ততই কমছে এবং এ কারণে নোবেল কমিটি এ বছরের বিজয়ীদের পক্ষে তাদের যুক্তি তুলে ধরার অপরিহার্যতার ওপরও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছে। হিবাকুশা বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকারতম মুহূর্তগুলোর ওপর জীবন্ত সাক্ষী হিসেবে কাজ করেছে এবং জাপানের ভেতরে ছাড়াও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পর্যায়ক্রমিক নতুন প্রজন্মের মধ্যে সফলতার সঙ্গে তাদের উত্তরাধিকারের বীজ বপনে সচেষ্ট হয়েছে। বিশ্বের জোরালো সমর্থন এবং শান্তি শিক্ষার প্রতি গভীর অঙ্গীকারের মাধ্যমে তারা পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্বমানবতার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে, যাকে নির্দ্বিধায় বিশ্বমানবতার জন্য শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যত্ তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে নোবেল কমিটি মনে করেছে।</p> <p>নোবেল শান্তি পুরস্কার তাদেরই স্বীকৃতি দেয় যারা ‘মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ উপকার’ বয়ে এনেছে এবং তাদের কাজ আলফ্রেড নোবেলের শেষ ইচ্ছার সঙ্গে গভীরভাবে অনুরণিত হয়। নিহন হিদানকিয়োর স্বীকৃতি পূর্ববর্তী বিজয়ীদের সঙ্গে যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ, যারা পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের কাজে চ্যাম্পিয়ন ছিল। পরমাণু হুমকিমুক্ত বিশ্বের জন্য যারা আন্তরিকভাবে শ্রম দিচ্ছে, তাদের সম্মান জানানো নোবেল শান্তি পুরস্কারের ঐতিহ্যকে আবারও নিশ্চিত করে এই পুরস্কার।</p> <p>নিহন হিদানকিয়োর মিশন সব সময়ই বহুমুখী—‘পারমাণবিক বোমা হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের স্বীকৃতি ও সমর্থন চাওয়া, পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো এবং সম্পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করা। অকল্পনীয় যন্ত্রণা থেকে উঠে আসা তাদের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয় তাদের বহু উদ্যোগের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে জোরালো সাক্ষ্য থেকে শুরু করে পারমাণবিক বিভীষিকা সম্পর্কে সচেতন বিশ্বকে গড়ে তোলা তৃণমূল পর্যায়ের প্রচারণায়। কনফেডারেশনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে রাজনৈতিক ওকালতি, অনুপ্রেরণামূলক শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নীতির বাইরেও পৌঁছেছে এই সংস্থার কার্যক্রম। হিবাকুশা শুধু তাদের দুঃসহ অভিজ্ঞতাই ভাগাভাগি করেনি, বরং শান্তি ও পুনর্মিলনের ক্ষেত্রেও সক্রিয়ভাবে সংলাপেও নিজেদের নিয়োজিত করেছে তারা। তারা বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে পারমাণবিক যুদ্ধে ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের ওপর রেখে যাওয়া অমোচনীয় ক্ষতচিহ্ন, যা মানবতার পারমাণবিক প্রযুক্তি পরিচালনার বিষয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের নীতিগত সিদ্ধান্তকে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করবে।</p> <p>নিহন হিদানকিয়োর বার্তা অত্যন্ত পরিষ্কার—‘আর হিরোশিমা নয়, আর নাগাসাকি নয়, আর পারমাণবিক অস্ত্রের শিকার নয়’। পরমাণু অস্ত্রমুক্ত ভবিষ্যতের মানদণ্ড বহনকারী হিসেবে তারা শান্তি ও নিরাপত্তা নিয়ে বৈশ্বিক আলোচনাকে নতুন মাত্রা ও আকার দিয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) এবং পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কিত সাম্প্রতিক চুক্তির মতো আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোতেই তাদের প্রভাবে স্পষ্ট সাক্ষ্য বোঝা যায়। নোবেল শান্তি পুরস্কার শুধু অতীতের অর্জনগুলোকেই স্বীকৃতি দেয় না, বরং অপূর্ণ লক্ষ্যের দিকে অব্যাহত প্রচেষ্টাকেও উত্সাহিত করে। নিহন হিদানকিয়ো ২০২৪ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি পদক্ষেপের আহ্বান হিসেবে দাঁড়িয়েছে—নিরস্ত্রীকরণ, অ-বিস্তার এবং শেষ পর্যন্ত এমন একটি বিশ্ব, যেখানে শান্তি পারমাণবিক ট্রিগারে অনিশ্চিতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ নয়।</p> <p>নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, তাদের বার্তা সীমানা এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অনুরণিত হতে থাকবে—আমরা যেন কখনো ভুলে না যাই, আমরা সর্বদা শিখতে পারি এবং আমরা যেন চিরকাল শান্তির জন্য সংগ্রাম করতে পারি, এই বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের কণ্ঠস্বর ইতিহাসের বিশাল হলওয়েতে চিরকাল প্রতিধ্বনিত হবে।</p>