<p>হাপরের কারণে সৃষ্ট বাতাসে কয়লায় গনগন করে ওঠে আগুন। জ্বলন্ত আগুনের তাপে কপাল থেকে ঝরে ঘাম, চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ থাকে কামারের। তবু থেমে থাকে না তারা। টুংটাং শব্দে মুখোরিত হয় কামারশালার চারদিক। আগুনে পোড়া লাল লোহায় পড়ে হাতুড়ির আঘাত। এরপর নরম লোহাকে আকৃতি দিয়ে তৈরি করা হয় ছুরি, চাপাতি, দা, বঁটিসহ নানান সব গৃহস্থালি।</p> <p>প্রায় বিলুপ্তির পথে থাকা এই হাপর বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির অন্যতম অংশ। এটি এক ধরনের ম্যানুয়াল যন্ত্র, যা মূলত বাতাস সঞ্চালনের জন্য ব্যবহৃত হয় হাপর। সাধারণত কাঠ ও চামড়া দিয়ে তৈরি হয় হাপর এবং দেখতে অনেকটা ব্যাগের মতো। এর দুই পাশে দুটি হাতল থাকে, যেগুলো টেনে বাতাস প্রবাহিত করা হয়। হাপরের প্রধান ব্যবহার কামারশালায়। তবে শুধু কামারশালা নয়, গ্রামীণ সমাজে বিভিন্ন কাজেই হাপরের ব্যবহার ছিল অপরিহার্য। কালের পরিবর্তনে হাপরের ব্যবহার কমতে থাকে। আধুনিক প্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি সহজলভ্য হওয়ায় হাপরের প্রয়োজনীয়তা প্রায় ফুরিয়ে গেছে। এখন লোহা গরম করার জন্য ইলেকট্রিক ব্লোয়ার ও আধুনিক ফার্নেস ব্যবহৃত হয়। তা ছাড়া, হাপর তৈরির কারিগররাও পেশা পরিবর্তন করেছেন। আর্থিকভাবে সচ্ছলতা আনতে অনেকেই এই ঐতিহ্যবাহী কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।</p> <p>আগে বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষের মধ্যে ছিল না প্রযুক্তিনির্ভরতা। তখন গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবেও কাজ করত হাপর। গ্রামের বাজারগুলোতে কামারদের তৈরিকৃত পণ্য ছিল কৃষকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দা, কোদাল, কুড়াল, শাবল, বঁটি, পেরেক, ছুরি, লাঙলের ফলা, কাস্তে, নিড়ানি, বেদে কাটি, খুন্তি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।</p> <p>একসময় বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে অন্ততপক্ষে একটি কামারশালা থাকত, যেখানে হাপরের ব্যবহার দেখা যেত। লোহার সরঞ্জাম তৈরির কাজ ছাড়াও মাটির জিনিসপত্র পোড়ানোর চুল্লি ও শিকারের ধারালো অস্ত্র তৈরিতেও হাপর ব্যবহৃত হতো।</p> <p>হাপর আমাদের গ্রামীণ জীবনের শিকড়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটি ঐতিহ্য। এটি শুধু একটি যন্ত্র নয়, বরং আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রা ও তাদের কঠোর পরিশ্রমের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। গ্রামীণ মেলা বা প্রদর্শনীতে হাপর প্রদর্শন করলে নতুন প্রজন্মের কাছে এটিকে পরিচিত করা যেতে পারে।</p> <p> </p> <p>♦  আল সানি</p>