<p>স্বর্ণযুগেই দক্ষিণ এশীয় ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জেতেনি বাংলাদেশ, সেখানে ১৯৯৯ সাফ গেমস সাফল্য আরো দূরের গন্তব্য। তবু আশা তো ছিল। কাঠমাণ্ডুতে সহজ গ্রুপে পড়েছিল জুয়েল রানার বাংলাদেশ। প্রথম প্রতিপক্ষ মালদ্বীপ।</p> <p>আমরা হেলেদুলে মাঠে গেলাম এবং ২-১ গোলে হারলাম! দুই গোলে পিছিয়ে থাকা ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তে অধিনায়কের একবার ব্যবধান কমানো ছাড়া বাকিটা চরম হতাশার, কিছুটা বিস্ময়েরও। আরে, এই মালদ্বীপকে না একসময় গোলের মালা পরাত বাংলাদেশ!</p> <p>বিস্ময়ের রেশ নিয়ে মিডিয়া সেন্টারে গিয়ে অভাবিত এক দৃশ্যের সাক্ষী হলাম। কাঠমাণ্ডুর অভিজাত হোটেলটি একাধারে মিডিয়া সেন্টার এবং মালদ্বীপ ফুটবল দলেরও ঠিকানা। ফেভারিট বাংলাদেশকে হারিয়ে নাচছে পুরো দল, সঙ্গে দেখি দেশটির মিডিয়া কন্টিনজেন্টের একমাত্র সদস্য ইব্রাহিম মুসাও নাচছেন!</p> <p>- কী ব্যাপার, তোমার আজ নিউজ পাঠাতে হবে না?</p> <p>নৃত্যরত মুসা হাসেন, ‘আজ রবিবার।</p> <p>আমাদের ছুটি।’ এখনকার খবর জানি না, গত শতকে রবিবার মালদ্বীপের মিডিয়াও ছুটি কাটাত।</p> <p>যা-ই হোক, আমার তো এতে চলবে না। মুসাকে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে মালদ্বীপ ফুটবলের হাঁড়ির খবর জানতে চেয়ে জানলাম, বছর তিনেক আগে ফুটবলে মালদ্বীপ সরকার তিন শ কোটি রুফিয়া (ওরা এভাবেই বলে) ইনভেস্ট করেছিল।</p> <p>উদ্দাম মিউজিকের মধ্যে মুসার দেওয়া এটুকু তথ্যই আমার কৌতূহল মেটানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। সাফল্যের জন্য বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। সেটা মালদ্বীপ বুঝে গেলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তৎকালীন তারকাখচিত বাংলাদেশ ফুটবল তা বুঝতে পারেনি। যত দিনে বুঝতে শিখেছে, তত দিনে ফুটবলের ট্রেন দূরের গন্তব্য পেরিয়ে ছুটছে। আবার বুঝতে পারলেও বড় তহবিল কখনো পায়নি ফুটবল।</p> <p>সরকারি সাহায্য যা মিলেছে, তা অপ্রতুল। ফিফা ও এমফসির অনুদানের পাশাপাশি ফেডারেশন নিজস্ব উদ্যোগে যে তহবিল গড়েছে, সেসব নিয়ে আবার নয়ছয় হয়েছে। তাতে সেই গাড্ডাতেই পড়ে আছে বাংলাদেশের ফুটবল। গরিবিয়ানা থেকে মুক্তি মেলেনি, ফিফা র‌্যাংকিংয়েও খাবি খাচ্ছে।</p> <p>ফুটবলের তবু একটা কোষাগার আছে। বাকি ফেডারেশনগুলোর তহবিলের খোঁজ নিলে যে কেউ আঁতকে উঠবে। বাংলাদেশ গেমস কিংবা ইয়ুথ গেমস এলে মিডিয়ায় রটে যায় প্রস্তুতির বেহাল। ক্যাম্প চলে পেটে-ভাতে। বৈশ্বিক আসরে খেলোয়াড়ের চেয়ে কর্মকর্তা যান বেশি। ফেরেন পুরনো উপলব্ধি নতুন বোতলে ভরে—এত আর্থিক সংকট নিয়ে ভালো কিছু আশা করা কঠিন। এরপর সরকারের নড়েচড়ে বসা দেখে মনে হয়, এবার বুঝি ক্রীড়া বাজেটে বরাদ্দ বেশি মিলবে। কিন্তু সেই পুরনো গল্প। বাজেট বাড়ে সামান্যই। ভারতের কুস্তি ফেডারেশনে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগও বাংলাদেশের বার্ষিক ক্রীড়া বাজেটের চেয়ে বেশি।  এই বাজেটে ভিন্ন ভিন্ন খাতের জন্য বরাদ্দ নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রশিক্ষণ অবহেলিত হয়। বেশি বরাদ্দ থাকে অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কারে। সেসব নির্মাণকাজের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। তা ছাড়া ফান্ডের অভাবে খেলা হয় না, গরু চরে মাঠে মাঠে।</p> <p>ফুটবল বাদে সব ফেডারেশনকে এক ব্র্র্যাকেটে ঢুকিয়ে দিলে ক্রিকেট বোর্ডের আবার মন খারাপ হতে পারে! কারণ তারা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অতি ধনী। সঞ্চয়পত্রই আছে হাজার কোটি টাকার। তবু পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকা নিয়ে বিসিবিরও দুঃখের অন্ত নেই। এই দুঃখের জন্য পূর্বতন ক্রিকেট প্রশাসকরা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের স্বেচ্ছাচারিতাকে দায়ী করতেন। কথাটা আংশিক সত্যি। তবে দায় বিসিবিরও আছে। যে ফেডারেশনের অর্থ আছে, বয়সভিত্তিক থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত খেলা পরিচালনার জন্য অগুনতি মাঠ দরকার, সেই বিসিবি কিনা একটি মাঠ তৈরির জন্য হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে উঠেপড়ে লেগেছিল! এটা ছিল স্রেফ পলিটিক্যাল স্টান্ট। নৌকা আকৃতির শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম তৈরির পরিকল্পনায় রাজনৈতিক অভিলাষই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছিল। এটা ঠিক যে স্টেডিয়ামের অনুষঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল। কিন্তু যে ফেডারেশনের জেলায় জেলায় মাঠ, ইনডোর দরকার, সেই ফেডারেশন কেন একটি মাঠ তৈরির জন্য কোষাগার উজাড় করে দেবে? যাক, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেটি আর হচ্ছে না। বোর্ড সভাপতি ফারুক আহমেদের ইচ্ছা, ন্যূনতম খরচে দুটি উন্নত মাঠ তৈরির।</p> <p>এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। ফুটবল, ক্রিকেট এবং আর সব ফেডারেশন তিনটি সংকটে ডুবে আছে। প্রথমত, অর্থসংকট। এর সঙ্গে একে একে বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে আছে দুর্নীতি ও রাজনীতিকরণ। অবকাঠামো নির্মাণ কিংবা সংস্কারের নামে দুর্নীতি হয়। আর ক্রীড়া ফেডারেশনগুলো দীর্ঘকাল ধরেই রাজনীতির জালে আটকে আছে। তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা ফেডারেশনকে তাঁদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ‘কোহিনুর’ মনে করেন। বিসিবির মতো হাই প্রফাইল সংস্থার পদ পেলে ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যেও বাড়তি সুবিধা হয়। সামাজিক পরিচিতি তো আছেই। যার না তার গাড়িতে বিসিবির স্টিকার ব্যবহার নিয়ে খোদ সংস্থাটিও বিব্রত।</p> <p>যাক, এসব নির্মূলে বর্তমান সরকার সব বিভাগ ও জেলা ক্রীড়া সংস্থা ভেঙে দিয়ে একটি নতুন রূপরেখা দিয়েছে। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে স্থানীয় পর্যায়ে ক্রীড়ানুরাগী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর পথনির্দেশনা দিয়েছে। খুব ভালো কথা। কিন্তু একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাটাগরির কথা কেন বিবেচনায় এলো না, তা জানা নেই। রাজনীতিকরণ, দুর্নীতির চেয়ে খেলাধুলায় বাংলাদেশের ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ার বড় কারণ অর্থসংকট। সরকার ধনীর দুলাল নয় যে ক্রীড়াঙ্গনে মুড়ি-মুড়কির মতো অর্থ ছিটাবে। সে ক্ষেত্রে উপজেলা-জেলা থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে বিনিয়োগকারী ক্যাটাগরিতে সংস্থাগুলোয় একজনকে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি ছিল। দেশে এখন অযুত ব্যবসায়ী, যাঁরা ক্রীড়ানুরাগীও। এঁদের সবার নিজস্ব এলাকার ক্রীড়া সংস্থায় জায়গা দিলে স্থানীয় পর্যায়ে খেলাধুলা আয়োজনের পথ সুগম হবে। নতুন বিধানে যে কয়েকটি ক্যাটাগরির কথা উল্লেখ আছে, তাঁদের পক্ষে খেলা আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা করা কঠিন। সেখানে প্রতিটি ক্রীড়া সংস্থায় পৃষ্ঠপোষক ক্যাটাগরিতে একজন থাকলে নিজ এলাকায় ‘সিএসআর’ করতে তিনি নিজেই উদ্বুদ্ধ হতেন। কারণ নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর জমানা এখন নয়। স্রেফ ভালোবাসা দিয়ে মাঠে খেলা চালিয়ে যাওয়ার দিন গত হয়েছে সেই কবে!</p> <p>ক্রীড়া সংস্থাগুলোর নতুন স্ট্রাকচারে আরেকটি অনুষঙ্গ যোগ করাও জরুরি। যুগ পাল্টেছে, নিজের এলাকায় ক্রীড়াঙ্গনের উন্নতির জন্য উজাড় করে দেওয়া ভালোবাসা এমনকি দায়বদ্ধতাও নেই। ক্রীড়া সংস্থার প্রধান পদাধিকারবলে জেলা প্রশাসক। একই কারণে তিনি সেই জেলা কিংবা বিভাগের অগুনতি কমিটিরও সভাপতি। তো তিনি রাষ্ট্রীয় কাজের পর এত শত দায়িত্বে মনোযোগ দেবেন কী করে? বাকি যাঁদের অন্তর্ভুক্তির নির্দেশনা দেওয়া আছে, তাঁদের রুটি-রুজির ব্যাপার আছে। অনেকের রাজনৈতিক ব্যস্ততাও থাকবে। কর্মপরিকল্পনা হয়তো করতে পারবেন তাঁরা। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যে সময় ও পরিশ্রম দরকার, সেটি তিনি বা তাঁরা কি ম্যানেজ করতে পারবেন? তা-ও বিনা পারিশ্রমিকে!</p> <p>বাস্তবতা বলে, এমনটা বিরল। উপজেলা পর্যায় বাদ দিন, জেলা থেকে বিভাগ হয়ে ঢাকায়ও অনেক খেলাই নিয়মিত হয় না। ঈদের ছুটিতে কিংবা বিভিন্ন পালা-পার্বণে বিবাহিত-অবিবাহিত কিংবা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচ আয়োজন করা আর একটি উপজেলা কিংবা জেলার খেলার মাঠ গরম রাখা এক কথা নয়। স্থানীয় পর্যায়ের ‘মান্যবর’ কমিটির পক্ষে এই বাস্তবতাকে ভুল প্রমাণ করা কঠিন। নিশ্চিত করে বলতে পারি, কিছুদিন পর এই কমিটিও হাত-পা গুটিয়ে বলবে, ‘আমাদের তো অন্য কাজও আছে!’ পারিশ্রমিক নেই বিধায় তাঁকে জবাবদিহির মুখেও ফেলা যাবে না।</p> <p>এই সমস্যা সমাধানের পথ অবশ্য আছে। প্রতিটি ক্রীড়া সংস্থায় একজন এক্সিকিউটিভ নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে, যিনি সংস্থার কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে দায়বদ্ধ থাকবেন। এতে বাড়তি কর্মসংস্থান হবে। সংস্থার কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতাও আসবে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ প্রতিনিয়ত খবর পেয়ে যাবে কোথায় কোন খেলা হচ্ছে না হচ্ছে।</p> <p>এই দুটি মিলিয়ে একটি ছবি দাঁড় করানো যায়। ধরুন, সংশ্লিষ্ট জেলার একজন ব্যবসায়ী কিংবা ধনবান ব্যক্তি পৃষ্ঠপোষক ক্যাটাগরিতে ক্রীড়া সংস্থায় আছেন। নিজের ‘সিএসআর’ ফান্ড থেকে খেলায় বিনিয়োগ করতে তিনি উৎসাহিত হবেন। ক্রীড়া সংস্থা সেই অর্থ দিয়ে একটি লিগ আয়োজনের পরিকল্পনা করেছে। আর সেটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করছেন স্থানীয় শিক্ষিত এক তরুণ এক্সিকিউটিভ।</p> <p>তাহলে খেলা হবেই! উন্মাদনা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি—সব থাকবে।</p>