<p>চিংড়িকে আমরা মাছ বলি, কিন্তু সত্য কথা বলিতে গেলে ইহাকে জালের পোকা বলিতে হয়। ইহা প্রজাপতি মাকড়সা কেন্নো বা বিছেরই জাত-ভাই। আমরা যখন বেশ মজা করিয়া চিংড়ি মাছ খাই, তখন জলের পোকা খাইতেছি ইহা মনেই হয় না। কিন্তু চিংড়ি মাছ খাঁটি পোকা।</p> <p>চিংড়িদের প্রত্যেকেরই শরীর আংটির মতো অনেকটি ভাঙা ভাঙা অংশ দিয়া প্রস্তুত। আবার প্রত্যেক গাঁটের গোড়া হইতে জোড়া জোড়া পা বাহির হইয়াছে। বিছেরা এই সব পা দিয়া চলিয়া বেড়ায়। চিংড়ি মাছেরা তাহার কতকগুলি পা দিয়া খাবার ধরিয়া খায় এবং আর কতকগুলি দিয়া জলে সাঁতার কাটে। দুইয়েরই মুখে লম্বা লম্বা শুঁয়ো আছে।<br /> আমরা এখানে কেবল দু-একটি মিলের কথা বলিলাম। তোমরা খোঁজ করিলে ইহা ছাড়া আরো অনেক মিল নিজেরাই দেখিতে পাইবে। কেবল বিছের সঙ্গেই যে চিংড়ি মাছের দেহের মিল তাহা নয়। তোমরা শুঁয়ো পোকা প্রজাপতি মাকড়সা ইত্যাদি অনেক পোকামাকড়ের সঙ্গেই ইহাদের মিল ধরিতে পারিবে। এই সকল দেখিয়া-শুনিয়াও যদি তোমরা চিংড়ি মাছকে পোকা না ভাবিয়া মাছই মনে করিতে থাক, তবে ভুল করিবে।</p> <p>চিংড়ি অনেক রকম দেখা যায়। আমাদের দেশে খাল, বিল বা পুকুরের ধারে কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিলে তোমার জলের ভিতরে এক রকম ছোট চিংড়িকে ছুটিয়া চলিতে দেখিবে। ইহাদের গায়ে যে শক্ত আবরণ থাকে, তাহা কাচের মতো স্বচ্ছ। এই জন্য আবরণের ভিতর দিয়া শরীরের অনেক অংশ স্পষ্ট দেখা যায়। এই চিংড়িকে অনেকে ঘুসো চিংড়ি বলে। পুকুরের কাদায় যে সকল ছোট চিংড়ি দেখা যায়, তাহাদের ছট্‌কা চিংড়ি বলে। ইহাদের গায়ের রং কালো। গল্দা চিংড়ি তোমরা সকলেই দেখিয়াছ। এগুলি লম্বায় কখনো কখনো আধ হাতের উপরেও দেখা যায়। গায়ের রং সাদা ও কতকটা কালো বা নীলে মিশানো। ইহা ছাড়া চারি-পাঁচ আঙুল লম্বা ও সাদা চিংড়ি আমাদের জলাশয়ে পাওয়া যায়। এগুলিকে রস্‌না চিংড়ি বলে।</p> <p>সমুদ্রের জলেও চিংড়ির অভাব নাই। সেখানে নানা আকারের চিংড়ি দেখা যায়। আবার শীতের দেশে যে রকম আকৃতির চিংড়ি পাওয়া যায়, গ্রীষ্মের দেশে সে রকম খুঁজিয়া মিলে না। চিংড়িদের আকৃতি এই রকম বিচিত্র হইলেও, শরীরের মোটামুটি গড়ন ও জীবনের কাজ সকল চিংড়িরই এক।</p> <p>যদি ইহাদের চলাফেরা সাঁতার কাটা পরীক্ষা করিতে ইচ্ছা করো, তবে একটি কাচের পাত্রে জল ভরিয়া তাহাতে একটি ছোট জীবন্ত চিংড়ি মাছ ছাড়িয়া দিয়ো। এই রকম পাত্রে আবদ্ধ থাকিয়া সেটি যখন চলিয়া ফিরিয়া বেড়াইবে, তখন তাহার জীবনের অনেক কাজ তোমরা স্বচক্ষেই দেখিতে পাইবে।</p> <p>চিংড়ির  ইহার দশ জোড়া পা আছে, কিন্তু মুখের দিকে ইহার পা পাঁচ জোড়া মাত্র। কিন্তু এই সকল পা দিয়া তাহারা হাঁটে না এবং সব পায়ে নখ থাকে না, বা সেগুলিতে আঙুলের  মতো কোনো অংশ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। প্রথম বা দ্বিতীয় পা দুটাই মোটা হয় এবং প্রত্যেকের শেষে কামারের দোকানের সাঁড়াশির মতো দুটো অংশ জোড়া থাকে। এই সাঁড়াশি লাগানো পা দুখানিকে চিংড়ির দাড়া বলে। দাড়া দিয়া ধরিয়া ইহারা খাদ্য মুখে তুলিয়া দেয়,—ইহা আমাদের হাতের মতো কাজ করে। দেহের পিছনে গাঁটে গাঁটে যে আরো পাঁচ জোড়া পায়ের মতো  অংশ আছে, তাহা সাঁতার কাটিবার জন্য। এইগুলি দিয়া চিংড়িরা জল কাটিয়া সাঁতার দেয়। দেহের শেষে চিংড়ির যে পাখার মতো লেজ থাকে, তাহা তোমরা অবশ্যই দেখিয়াছ। কতকগুলি শক্ত খোলা একত্র হইয়া এই লেজের সৃষ্টি করিয়াছে। চিংড়িরা জলের মধ্যে সোজা সাঁতার দিতে দিতে একেক সময়ে হঠাৎ পিছু-সাঁতার দেয়। সমস্ত দেহটাকে না ঘুরাইয়া ইহারা ওই লেজের সাহায্যেই পিছু সাঁতার দিতে পারে।<br /> চিংড়ি ভাজা তোমরা নিশ্চয়ই খাইয়াছ, আমরাও খাইয়াছি।</p> <p>ইহাদের গায়ের উপরে খোলা কী রকমে সাজানো থাকে, তোমরা দেখ নাই কি? এবার বাজার হইতে চিংড়ি মাছ আসিলে নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিয়ো। পরীক্ষা করিলে দেখিবে, ইহাদের মাথাটা একখানা বড় খোলা দিয়া ঢাকা আছে। এই খোলার গায়েই করাতের মতো  একটা অংশ খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া থাকে। ইহা চিংড়িদের খড়্গ। শত্রু আসিয়া আক্রমণ করিলে আমরা বন্দুক বাহির করি ও তলোয়ার হাতে লইয়া শত্রুকে তাড়া করি। চিংড়ি মাছদের ঘরবাড়ি নাই, তলোয়ার বন্দুকও নাই; আছে কেবল মাথার উপরে করাতের মতো খাড়া। শত্রুরা উৎপাত আরম্ভ করিলেই, তাহারা  ওই খাড়া দিয়া শত্রুকে তাড়াইয়া দেয়। ইহা তাহাদের আত্মরক্ষার অস্ত্র।</p> <p>চিংড়িদের মাথা ভয়ানক জটিল যন্ত্র। ইহাতে অনেক ছোটোখাটো অংশ জোড়া থাকে; এই জন্যই সকল অঙ্গের চেয়ে মাথাটাই জটিল হইয়া পড়িয়াছে। চিংড়ির মাথায় পায়ের মতো ছয় জোড়া অবয়ব লাগানো দেখা যায়। আমরা আগেই বলিয়াছি, পোকামাকড়দের দেহে যত গাঁট থাকে, প্রায়ই তাহার প্রত্যেকটি হইতে জোড়া জোড়া পা বা ডানা প্রভৃতি নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বাহির হয়। সুতরাং মাথায় যে ছয় জোড়া পায়ের মতো  অংশ আছে, তাহা দেখিলে বুঝা যায়, চিংড়িদের মাথা ছয়টা গাঁটে প্রস্তুত। প্রকৃত ব্যাপার তাহাই বটে, কিন্তু চিংড়ির দেহ পরীক্ষা করিলে তাহার মাথার  ওই রকম ছয়টা গাঁট দেখিতে পাইবে না। এই ছয়টা গাঁট জোট বাঁধিয়া এক হইয়া গিয়াছে। কোনো এক সময়ে যে এই ছয়টা গাঁট পৃথক ছিল, তাহা মাথার ছয় জোড়া পায়ের  মতো অংশ দেখিলেই আন্দাজ করা যায়।</p> <p>যাহা হউক, এখন চিংড়ির মুখটি কী রকম তাহা দেখা যাউক। মাথার পূর্ব্বের ছয় জোড়া অঙ্গ ছাড়া ইহাদের দাড়ার কাছ হইতে আরো তিন জোড়া অঙ্গ বাহির হয়। এগুলি দেখিতে কতকটা আঙুলের  মতো; কেবল শেষের দুই জোড়ায় শুঁয়োর  মতো অংশ জোড়া থাকে। দাড়া দিয়া ধরিয়া চিংড়িরা যে খাদ্য মুখের গোড়ায় আনে, তাহারা ওই শেষের তিন জোড়া বিশেষ অঙ্গ দিয়া তাহাই মুখে পুরিয়া দেয়।</p> <p>মুখে খাবার পুরিলেই খাওয়া শেষ হয় না। যাহাতে খাদ্য মুখ হইতে পড়িয়া না যায়, তাহার জন্য উপর ও নিচের ওষ্ঠ চালনা করিতে হয়। তাহার পরে সহজে হজম করার জন্য খাদ্য চিবাইয়া পেটে পুরিতে হয়। চিংড়িদের মুখে যে শেষ তিন জোড়া অঙ্গের কথা বলিলাম, তাহা দিয়াই এই সকল কাজ চলে। দুই জোড়া দিয়া তাহারা খাদ্য আটকাইয়া রাখে এবং আর এক জোড়ায় তাহা চিবায়। এই তিন জোড়াতে কতকটা আমাদের মুখের চোয়ালের মতো কাজ পাওয়া যায়। কিন্তু খাদ্য চিবাইবার জন্য দাঁত কেবল এক জোড়াতেই থাকে।</p> <p>বড় চিংড়ি মাছের মাথা-ভাজা তোমরা খাইয়াছ কি? খাইবার সময় তোমরা হয়তো ইহাদের চোয়াল ও দাঁত দেখিয়া থাকিবে। দাঁত হাড়ের মতো  শক্ত, অথচ বেশ ধারালো। আমরা কোনো জিনিস ছিঁড়িয়া খাইবার সময়ে, চোয়াল উপর-নীচে নাড়াচাড়া করি, ইহাতে খাদ্য খণ্ড খণ্ড ভাগ হইয়া যায় কিন্তু চিবানো হয় না। চিবাইতে হইলে চোয়ালকে পাশাপাশি চালাইতে হয়; ইহাতে খাবার পিষিয়া যায়। গোরু যখন “জাওর কাটায়,” তখন তাহারা চোয়াল পাশাপাশি চালায়। চিংড়ি মাছেরা চোয়াল এই রকম কেবল পাশাপাশিই চলাইতে পারে। ইহাতে খুব শক্ত খাদ্যও দাঁতের ধারে পিষিয়া কাদার মতো হইয়া যায়।</p> <p><strong>চিংড়ির চোখ, কান ও নাক</strong><br /> চিংড়ির আকৃতি ও মুখের গড়নের কথা তোমরা শুনিলে,—এখন ইহাদের চোখ, কান, নাক ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের কথা বলিব।<br /> চিংড়ির মাথায় যে শুঁয়ো লাগানো থাকে, তাহা তোমরা নিশ্চয়ই দেখিয়াছ। শুঁয়ো দুই জোড়া থাকে। এক জোড়া খুব লম্বা। চিংড়িরা যখন জলের ভিতরে চলিয়া বেড়ায়, তখন এই শুঁয়ো দুইটি পিঠের উপরে পড়িয়া থাকে; ইহা তখন প্রায় লেজ পর্যন্ত পৌঁছায়। কিন্তু এই দুইটি ছাড়া চিংড়ির মাথায় আরো দু’টা শুঁয়ো দেখা যায়। এগুলি প্রথম শুঁয়োর চেয়ে অনেক ছোট। গাছের গুঁড়ি হইতে যেমন ছোট ডাল বাহির হয়, এই দুইটি শুঁয়োর প্রত্যেকটি হইতে সেই রকম তিনটি শুঁয়ো বাহির হইতে দেখা যায়। যখন জলের ভিতরে সাঁতার কাটিয়া চলে, তখন চিংড়িরা এই দুইটি ডাল-পালা-ওয়ালা শুঁয়োকে একবার ডাইনে এবং একবার বামে ফেলিয়া চলিতে আরম্ভ করে। তাহারা শুঁয়ো দুটিকে বৃথা নাড়ায় না। প্রত্যেক শুঁয়োর গোড়ায় তাহাদের কান থাকে। জলের ভিতরকার শব্দ শুনিবার জন্য উহারা শুঁয়ো নাড়িতে নাড়িতে চলে।</p> <p>কান বলিতে আমরা যাহা বুঝি, চিংড়িদের কান মোটেই সে-রকম নয়। শুঁয়োর গোড়ায় ছোট থলির মত এক-একটা অংশই ইহাদের কান। এই থলির ভিতরে লালার মতো  এক রকম জিনিস এবং কয়েক কণা বালি ভিন্ন আর কিছুই দেখা যায় না। চিংড়িরা অতি অল্প শব্দও এই কান দিয়া শুনিতে পায়।</p> <p>তোমরা যদি চিংড়ি মাছের কান দেখিতে চাও, তবে মাথার যেখানে তাহার ছোট শুঁয়ো জোড়াটি লাগানো আছে, সেই জায়গায় খোঁজ করিয়ো। লোমে-ঢাকা থলির মধ্যে উহার  অদ্ভুত কান নিশ্চয়ই দেখিতে পাইবে।</p> <p>কানের ঠিক উপরে চিংড়ির দুটি বেশ বড় বড় চোখ আছে। আমাদের চোখ যেমন মাংসের মধ্যে বসানো থাকে, ইহার চোখ সে রকম দেখিবে না। দুটি ছোট কাঠির মাথায় যেন চোখ দুটি বসানো আছে।</p> <p>চিংড়ির চোখ বড় মজার জিনিস। অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়া যদি ইহাদের চোখ পরীক্ষা করিবার সুবিধা পাও, তবে প্রত্যেক চোখে মধুর চাকের উপরকার ছোট কুঠারির  মতো শত শত কুঠারি দেখিতে হইবে। এই প্রত্যেক কুঠারিই চোখ। তাহা হইলে বলিতে হয়, চিংড়ির মাথায় যে কালো কালো দুটি চোখ দেখা যায়, তাহার প্রত্যেকটিতেই শত শত ছোট চোখ আছে। কিন্তু এতগুলি চোখ আছে বলিয়াই ইহারা যে বড় প্রাণীদের চেয়ে অনেক ভালো করিয়া দেখিতে পায়, তাহা বলা যায় না। ইহাদের চোখের পাতা নাই; কাজেই, ডাইনের এবং বামের শত শত চোখ সর্ব্বদা খোলা থাকে।</p> <p>তাহা হইলে বুঝা যাইতেছে, ছোট প্রাণী হইলেও চিংড়িদের চোখ-কান খুব জোরালো না হইলেও বেশ সজাগ।<br /> অন্ধকারে যখন কিছুই দেখা যায় না, তখন আমরা হাত বা পা দিয়া ছুঁইয়া কাছে কী কী জিনিস আছে ঠিক করি। চিংড়িরা তাহাদের লম্বা লম্বা শুঁয়ো দিয়া ছুঁইয়া দূরে কি জিনিস আছে তাহা বুঝিয়া লয়। সুতরাং ইহাদের স্পর্শ-শক্তিও কম নয়।<br /> খাদ্য দ্রব্য লুকানো থাকিলে কেবল চোখে দেখিয়া তাহার খোঁজ পাওয়া যায় না। তখন গন্ধ শুঁকিয়া লুকানো খাদ্য বাহির করিতে হয়। কুকুরের ঘ্রাণশক্তি খুব বেশি। কেবল গন্ধ শুঁকিয়া শুঁকিয়া অনেক কুকুর গভীর জঙ্গল হইতে শিকার ধরিয়া আনে। চিংড়িরা মাংসাশী প্রাণী। জলের মধ্যে পচা মাছ বা মাংস যাহা কিছু থাকে, তাহাই সন্ধান করিয়া ইহারা খায়। কাজেই লুকানো খাবার সংগ্রহ করা ইহাদের খুবই দরকার হয়। এই কাজের জন্য্য চিংড়িদের খুব ঘ্রাণশক্তি আছে। কিন্তু যে নাক দিয়া ইহারা গন্ধ লয়, তাহা শরীরের ঠিক কোন জায়গায় আছে, তাহার সন্ধান পাওয়া যায় নাই। পণ্ডিতেরা আন্দাজ করেন, চিংড়ির কান যেমন শুঁয়োর গোড়ায় আছে, নাকও হয় ত শুঁয়োরই কোনো এক জায়গায় আছে।</p> <p>লেখক : শান্তিনিকেতনের সাবেক অধ্যাপক ও বিজ্ঞান লেখক</p> <p>বিশেষ দ্রষ্টব্য: লেখকের মূল বানানরীতি অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে।</p>