<p>এসআর সমাজকল্যাণ সংস্থা বরিশাল সদর উপজেলা ও সিটি করপোরেশনে বেশ পরিচিত নাম। কারণ এই সংস্থার সঙ্গে সাধারণ মানুষের প্রাপ্তির সম্পর্ক রয়েছে। বরিশাল সিটি করপোরেশন ও সদর উপজেলায় সংস্থাটির প্রায় ৩০ হাজার সদস্য রয়েছে, যাদের মধ্যে বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যরাও অন্তর্ভুক্ত। সংস্থাটির সদস্য হওয়ার মূল কারণ হলো সংস্থাটির কাছ থেকে প্রত্যেক সদস্যই মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়েছেন।</p> <p>এসআর সমাজ কল্যাণ সংস্থার যাত্রা শুরু করে ২০১৬ সালে। গত আট বছরে সংস্থাটি তাদের সদস্য ও সদস্যের বাইরে শতকোটি টাকা ব্যয় করেছে। আর এই ব্যয় মাধ্যম হিসেবে তারা বেছে নিয়েছে সংস্থার সদস্য ও স্থানীয় সাধারণ মানুষকে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, সেলাই মেশিন ইত্যাদি বিতরণ। বেশ কয়েকবার কোটি টাকা ব্যয় করে চোখের চিকিৎসাও দিয়েছে। </p> <p>সংস্থার সুবিধাভোগীরা সাধারণত সংস্থার মূল উৎস ও লক্ষ্য নিয়ে চিন্তিত হন না। অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের ঠিকাদার এবং আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য সালাউদ্দিন রিপন (এসআর) সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার নামের সংক্ষিপ্ত রূপ দিয়ে এই সমাজকল্যাণ সংস্থার নামকরণ করেন। তবে অভিযোগ রয়েছে যে সালাউদ্দিন রিপন এই সংস্থাকে তার অবৈধ অর্থকে বৈধ করতে ব্যবহার করছেন।</p> <p>২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে সালাউদ্দিন রিপন হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হন। ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত তার সম্পত্তির তালিকা থেকে জানা যায়, তার ঢাকায়, বরিশালে এবং নারায়ণগঞ্জে মোট ৪৪৯.৩২ শতাংশ জমি রয়েছে, যার বাজারমূল্য তিনি ৪১ কোটি ১৮ লাখ ৮২ হাজার ৫৮৩ টাকা দেখিয়েছেন। তবে সূত্র মতে, এর প্রকৃত বাজারমূল্য ৫০০ কোটি টাকারও বেশি।</p> <p>সালাউদ্দিন রিপনের ঢাকায় ও চট্টগ্রামে চারটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা হলেও বর্তমান বাজারমূল্য তার তিন গুণেরও বেশি। তার এবং তার স্ত্রীর নামে ২০ কোটি টাকারও বেশি সঞ্চয়পত্র এবং এফডিআর রয়েছে। তার বার্ষিক ব্যাবসায়িক আয় প্রায় দেড় কোটি টাকা। প্রশ্ন থেকে যায়, যখন বাংলাদেশ রেলওয়ে বিশাল পরিমাণে লোকসান করছে, তখন ঠিকাদার সালাউদ্দিন রিপনের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কিভাবে অর্জিত হচ্ছে?</p> <p>বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের বাটনা গ্রামে সালাউদ্দিন রিপনের দাদার নামে নির্মিত ধলু হাওলাদার বাড়িতে দেখা যায়, প্রায় ৫০ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত একটি দুই তলা ভবন, যা এসআর সমাজকল্যাণ সংস্থার কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ওই এলাকায় তিনি মেসার্স হাওলাদার ব্রিকস নামে একটি ইটভাটা স্থাপন করেছেন, যা তার বড় ভাই সালাউদ্দিন বিপ্লব পরিচালনা করেন। ইটভাটাকে ঘিরে তিনি কয়েক একর জমিও কিনেছেন। নগরীর বাটার গলি এলাকায় তার আরো একটি পাঁচ তলা ভবন রয়েছে, যেখানে তার চাচা আব্দুল মালেক হাওলাদার বসবাস করেন।</p> <p>সালাউদ্দিন রিপনের প্রতিবেশী শহিদুল ইসলাম জানান, একসময় তার এলাকায় একটি পোল্ট্রি ফার্ম ছিল। তবে মুরগির ব্যবসায় লাভবান না হয়ে ২০০২ সালে তিনি ঢাকায় যান এবং চাচা রফিকুল ইসলামের রেলের ঠিকাদারি কাজ দেখাশোনা শুরু করেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তিনি দ্রুত সম্পদশালী হন। বরিশালে এসে নিজেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে পরিচয় দিতেন। তার সঙ্গে থাকত চার-পাঁচটি দামি গাড়ি। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত তিনি সংসদ সদস্য হওয়ার আশায় কয়েক শ কোটি টাকা বিলিয়েছেন। তবে ৫ আগস্টের পর থেকে তার এবং তার পরিবারের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।</p> <p>এ বিষয়ে সালাউদ্দিন রিপনের ব্যক্তিগত দুটি মোবাইল নম্বরে ফোন করলে সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়। তার গ্রামের বাড়ি বাটনায় গিয়ে ভাই বিপ্লবের কোনো খোঁজও পাওয়া যায়নি। তার চাচা, সদ্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক হাওলাদারের নগরীর বাটার গলি এলাকার বাড়িতে গেলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।</p> <p>সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বরিশাল শাখার সভাপতি অধ্যক্ষ গাজী জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমি সালাউদ্দিন রিপনের চাচা আব্দুল মালেক হাওলাদারকে চিনি। তিনি একজন স্কুলশিক্ষক ছিলেন। যখন শুনলাম তিনি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন, তখন বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ ওই নির্বাচনে তাকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছিল। আমাদের অনুসন্ধানে জানতে পারি, তার ভাইয়ের ছেলে সালাউদ্দিন রিপন নির্বাচনী সব খরচ বহন করেছেন। এরপর জেনেছি, সালাউদ্দিনের নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছে, যেখান থেকে তিনি কোটি কোটি টাকা দান করেছেন। এটি সত্যিই বিস্ময়ের বিষয়। একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে মুরগির ব্যবসা থেকে এত অল্প সময়ে শতকোটি টাকার মালিক হলেন, তা অবশ্যই তদন্তের দাবি রাখে। এতে দুর্নীতি রয়েছে, আর তদন্ত করলে আসল সত্য বেরিয়ে আসবে।’</p> <p>বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের বাটনা গ্রামের কৃষক আব্দুল মান্নান হাওলাদারের ছেলে সালাউদ্দিন রিপন স্বরূপকাঠি নেছারাবাদ মাদরাসায় পড়াশোনা শেষ করে এলাকায় মুরগির ফার্ম চালু করেছিলেন। ব্যবসায় লাভ না হলে ২০০২ সালে ঢাকায় পাড়ি জমান এবং রেলওয়ের ঠিকাদারি কাজ দেখাশোনা শুরু করেন। চাচা রফিকুল ইসলামের মৃত্যুর পর তিনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সালের মধ্যে কয়েক শ কোটি টাকার মালিক হন সালাউদ্দিন। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির সদস্য পদ নিয়ে বরিশালে ফিরে আসেন। ২০১৬ সালে নিজ নামে গঠন করেন ‘সালাউদ্দিন রিপন (এসআর) সমাজকল্যাণ সংস্থা’।</p> <p>২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন তিনি। তবে দমে না গিয়ে ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত একইভাবে বরিশাল সিটি করপোরেশন ও সদর উপজেলার ১০ ইউনিয়নে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে থাকেন। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন এবং নির্বাচনে শতকোটি টাকার বেশি খরচ করেও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জাহিদ ফারুক শামীমের কাছে পরাজিত হন।</p> <p>এরপর তিনি বরিশাল সদর উপজেলার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চাচা আব্দুল মালেক হাওলাদারকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করান এবং বিপুল অর্থ ব্যয়ে তাকে বিজয়ী করেন। ওই নির্বাচনে প্রতিটি ভোট ৫,০০০ টাকায় কিনেছেন বলে গুজব রটে। তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর থেকেই সালাউদ্দিন রিপনের কোনো খোঁজ নেই। তার প্রতিষ্ঠিত ‘সালাউদ্দিন রিপন সমাজকল্যাণ সংস্থা’র কার্যক্রমও বরিশাল সদর উপজেলায় স্থবির হয়ে পড়েছে।</p> <p>বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হাফিজুর রহমান বলেন, ‘সালাউদ্দিন রিপনের বাড়ি আমার বাড়ির কাছেই। তার বাবা আব্দুল মান্নান হাওলাদার কৃষিকাজ করতেন। সালাউদ্দিন মাদরাসা থেকে লেখাপড়া শেষে মুরগির ফার্ম দেন। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি ঢাকায় যান এবং কয়েক বছরের মধ্যেই হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। বরিশালে কয়েক শ কোটি টাকা বিলিয়েছেন সালাউদ্দিন রিপন। এ টাকার উৎস কী, তা কারোই জানা নেই। মূলত সালাউদ্দিন রিপনের পুরো জীবন রহস্যময়।’</p>