<p>আজ ২৯ সেপ্টেম্বর। ২০১২ সালের এই দিনে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা ও বৌদ্ধদের ঘর বাড়িতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার পর বৌদ্ধদের সঙ্গে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সম্প্রীতি ফিরেছে। পুরাতন মন্দিরের জায়গায় তৈরি হয়েছে নতুন মন্দির। মন্দিরে যাচ্ছেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী দর্শণার্থীও। তবে সহিংসতার ১২ বছর পূর্ণ হলেও এ ঘটনার ১৮টি মামলার একটিরও নিষ্পত্তি হয়নি।</p> <p>স্থানীয়দের অভিযোগ, ঘটনার পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ইন্ধনে মূল হোতাদের বাদ দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীসহ নিরীহ লোকজনকে আসামি করা হয়। এতে বাদ দেওয়া হয়েছে ঘটনার সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীসহ প্রকৃত আসামিদের। এ কারণে এসব মিথ্যা মামলা নিয়ে ঘটনার পর থেকে জনমনে বিরাজ করছে চরম ক্ষোভ। জনরোষের মুখে ওই সময় এসব সহিংস ঘটনায় বিভাগীয় মামলা শুরু হয়। তবে শুরুতেই মামলার তদন্ত কার্যক্রমের নথি ফাঁস হলে প্রাথমিক পর্যায়েই মামলার কার্যক্রম থমকে যায়।</p> <p>পরে পুলিশ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিলে তাতেও বিএনপি-জামায়াতের আরো নেতাকর্মীসহ অসংখ্য নিরীহ লোকজনকে আসামি করা হয়। এতে হয়রানির শিকার লোকজনের তালিকা আরো দীর্ঘ হয়। এ কারণে মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়ার পরও ১২ বছরে একটি মামলারও নিষ্পত্তি হয়নি।</p> <p>এসব মামলা নিয়ে চরম বিতর্ক থাকায় সাক্ষীরাও সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। ফলে সাক্ষীর অভাবে এ বিচার প্রক্রিয়া থমকে গেছে বলে আদালত সূত্রে জানা যায়। অপরদিকে বিতর্কিত এসব মামলায় বছরের পর বছর আদালতে হাজিরা দিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন নিরীহ লোকজন।</p> <p>ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধদের আক্ষেপ জানিয়ে অভিযোগ করেন, মামলার আসামি ও সাক্ষী হিসেবে যাদের নাম দেয়া হয়েছিল, তাদের নাম যথাযথভাবে উল্লেখ করা হয়নি। মামলায় জড়িতদের পরিবর্তে নিরীহ লোকজনকে রাজনৈতিক ও স্থানীয় প্রেক্ষাপটে আসামি করে হয়রানি করা হচ্ছে। এখন যাদের নাম সাক্ষীর তালিকায় আছে, তাদের অনেকেই জানে না সাক্ষীর তালিকায় তাদের নাম রয়েছে।</p> <p>রামু সহিংসতার সেই কালো রাতের ঘটনা স্মরণ করে রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের পরিচালক শীলপ্রিয় থের সাংবাদিকদের বলেন, ‘২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আমাদের বৌদ্ধ বিহারগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। সেই সম্পদ ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। ঘটনাটি স্মরণ করলে এখনো চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।’ </p> <p>তার মতে, ‘সে সময়গুলো আমাদের অনেক কঠিনভাবে কেটেছে। দূর্বৃত্তরা আমাদের বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ পল্লী পুড়িয়ে দিয়ে অনেক ক্ষতি করেছে। তবে আগের চেয়ে বর্তমানে আমরা অনেক ভালো আছি। এখন আমাদের সম্প্রীতিও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা রামুবাসি সম্প্রীতিতে আছি। আগামী দিনেও আমাদের এই সম্প্রীতি ধরে রাখতে হবে।’</p> <p>কক্সবাজার বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, রামু সহিংসতার ১২ বছরে ফিরে এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। রামুর বৌদ্ধরা পেয়েছে দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধ বিহার। কিন্তু রামুর ঘটনার ১২ বছরেও মামলার কার্যক্রম প্রাথমিক পর্যায়ে থমকে আছে। পুলিশ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিলেও একটি মামলাও নিষ্পত্তি হয়নি। সেই মামলার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা সংশয়।</p> <p>কক্সবাজার জেলা যুবদলের সহ-তথ্য ও যোগাযোগ বিষয়ক সম্পাদক রোকনুজ্জামান চৌধুরী জানান, বৌদ্ধ মন্দির হামলার সঙ্গে তিনি বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ত নন। অথচ বিএনপি নেতা হওয়ায় তাকে আসামী করা হয়েছে। শুধু তিনি নন, তৎকালীন বিরোধীদলীয় অসংখ্য নেতাকর্মীকে এভাবে মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। অবিলম্বে এসব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।</p> <p>কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ছৈয়দ রেজাউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি পিপি হিসাবে নিযুক্ত হয়েছি তিন মাসের কাছাকাছি সময়। ইতোমধ্যে আমি সকল অতিরিক্ত পিপি, সহকারি পিপি দের নিয়ে বসেছিলাম। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পতির জন্য সকলকে আন্তরিক হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছি। তার মধ্যে বৌদ্ধ মন্দিরে মামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাগুলো অত্যন্ত স্পশ্কাতর ও আলোচিত ১৮টি মামলার মধ্যে প্রায় ৯০০ জন আসামি ও ১৬০ জনের মতো সাক্ষী আছেন। মামলাগুলো বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। আমরা চেষ্টা করছি তথ্য প্রমাণ আর সাক্ষীর মাধ্যমে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে। কিন্তু সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে বিচার প্রক্রিয়া কিছুটা থমকে আছে। সাক্ষীদের নামে সমন জারি করা হয়েছে অনেকবার। কয়েকটি মামলায় সাক্ষী চলমান থাকলেও সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করছেন তারা। আমরা চাই সবাই যেন ন্যায়বিচার পায়।’</p> <p>উত্তম বড়ুয়া কোথায়?</p> <p>২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামু ট্র্যাজেডির ঘটনায় ফেইসবুকে কুরআন অবমাননার ছবি ট্যাগকারী সেই উত্তম বড়ুয়া কোথায়, কী অবস্থানে আছেন, জানে না আইনশৃংখলা বাহিনী। বৌদ্ধ বিহার পোড়ানোর দিনই পালিয়ে যান উত্তম বড়ুয়া। বৌদ্ধদের অনেকের সন্দেহ, নিখোঁজ উত্তম বড়ুয়া আজও বেঁচে আছেন কি না। যাকে নিয়ে রামু, টেকনাফ, উখিয়া ও পটিয়ায় এতোবড় ঘটনা ঘটেছিল সে এখন কোথায়? বেঁচে থাকলে তার হদিস এখনো পায়নি কেনো পুলিশ? কে, কিভাবে তার ফেসবুকে এই ছবি ট্যাগ করলো সেটি জানতেও দরকার উত্তম বড়ুয়ার স্বীকারোক্তি। কিন্তু ঘটনার একযুগ পার হলেও পুলিশ তার অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য না দিতে পারায় ক্ষুব্ধ রামুর সাধারণ মানুষ।</p> <p>প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পবিত্র কুরআন অবমাননার একটি গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই দিন কক্সবাজারের রামুতে এবং পর দিন উখিয়া ও টেকনাফের বৌদ্ধ বিহার, বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা ও অগ্নিসংযোগে ১৯ বৌদ্ধ বিহার, ৪১ বসতঘর পুড়িয়ে দেয় দূর্বৃত্তরা। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় আরো ৬টি বৌদ্ধ বিহারসহ অর্ধশত বসতঘরে। এতে কয়েক শত বছরের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পুড়ে যায়। </p> <p>এ ঘটনার পর দায়ের করা হয় ১৮টি মামলা। এর মধ্যে রামুর আটটি মামলায় ৪৫৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। তবে রামু থানায় জনৈক সুধাংশু বড়ুয়ার করা মামলাটি দু’পক্ষের আপস মিমাংসার ভিত্তিতে প্রত্যাহার করা হয়।</p>