<p>ইসলামী সভ্যতায় হাম্মাম বা গোসলখানার আছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। মুসলিম সমাজে হাম্মামের বিশেষ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব রয়েছে। হাম্মামের ধারণাটি রোমান সভ্যতা থেকেই মুসলিমরা গ্রহণ করেছে বলে ধারণা করা হয়। ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার আগে মধ্যপ্রাচ্য ও তুরস্কের বিস্তীর্ণ অঞ্চল রোমানরা শাসন করত। এসব অঞ্চল মুসলিম শাসনাধীন হওয়ার পর রোমান সভ্যতার অনেক কিছুই মুসলিম সভ্যতায় যুক্ত হয়।</p> <p>ইসলাম ধর্মে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার বিশেষ গুরুত্ব থাকায় হাম্মামের ধারণা সহজেই মুসলিম সমাজে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে মুসলিম শাসনাধীন মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, স্পেন, পর্তুগাল, মধ্য এশিয়া, ভারতীয় উপমহাদেশ ও ইউরোপের তুর্কিশাসিত অঞ্চলে হাম্মামের ব্যাপক বিস্তার ঘটে।</p> <p><strong>মুসলিম হাম্মাম ভিন্ন যেখানে</strong></p> <p>রোমান হাম্মাম ও মুসলিম হাম্মামের মধ্যে মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে। রোমান হাম্মাম অনেকটাই আধুনিক সুইমিংপুলসদৃশ ছিল। কিন্তু পবিত্রতা ও অপবিত্রতা বিষয়ক বিধি-নিষেধের কারণে মুসলিম সমাজে হাম্মামের ধারণাটি পাল্টে যায়। এখানে ব্যক্তিগত গোসলকক্ষের ধারণাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তারা স্থির পানির পরিবর্তে প্রবহমান পানিতে গোসল করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। রোমান হাম্মামে শরীরচর্চার ব্যবস্থা থাকলেও মুসলিম হাম্মামে তা সংযুক্ত হয়নি। তবে গরম ও ঠাণ্ডার পৃথক ব্যবস্থা রোমান ও ইসলামী হাম্মাম উভয়টির ক্ষেত্রে  প্রযোজ্য ছিল।</p> <p><strong>মুসলিম সভ্যতায় হাম্মামের বিকাশ</strong></p> <p>প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুসারে উমাইয়া শাসনামলে মুসলিম বিশ্বে হাম্মামের প্রচলন ঘটে, যা মুসলিম বিশ্বের বহু অঞ্চলে এখনো নানারূপে টিকে আছে। ঐতিহাসিক সূত্র অনুসারে, উমাইয়া আমলে সিরিয়া ও জর্দান অঞ্চলে সর্বপ্রথম হাম্মাম গড়ে ওঠে। হাম্মাম প্রতিষ্ঠা করা হয় সাধারণ ও মরু প্রাসাদের অংশ হিসেবে। সে সময়ের প্রসিদ্ধ কয়েকটি হাম্মাম হলো আমারা প্রাসাদের হাম্মাম, হাম্মাম আল সারাহ, কাসার আল হায়ের আল শারকির হাম্মাম, কিরবাত আল মাজফার ইত্যাদি।</p> <p>আমারা প্রাসাদের হাম্মামটিই মুসলিম বিশ্বের প্রথম হাম্মাম বলে ধারণা করা হয়। আর কিরবাত আল মাজফার হলো সবচেয়ে সুন্দর উমাইয়া হাম্মাম। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে অবস্থিত এই হাম্মামের আয়তন প্রায় ৯ হাজার বর্গফুট। এতে ছিল একাধিক গোসলের কক্ষ এবং গরম পানির বিশেষ ব্যবস্থা।</p> <p>আব্বাসীয় আমলে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্রই হাম্মামের বিকাশ ঘটে। প্রত্নতাত্ত্বিত নিদর্শন অনুসারে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে মরক্কো ও মুসলিম স্পেনে হাম্মাম প্রতিষ্ঠিত হয়। মরক্কোর ভোলুবিলিস, স্পেনের কর্ডোভাসহ অন্যান্য শহরে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে প্রতিষ্ঠিত হাম্মামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আব্বাসীয় আমলে শুধু বাগদাদেই ৬০ হাজার হাম্মাম ছিল।</p> <p><strong>পারস্য ও ভারতে মুসলিম হাম্মাম</strong></p> <p>মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার আগে পারস্যে হাম্মামের প্রচলন ছিল না। মুসলিমরাই সেখানে হাম্মামের প্রচলন ঘটায়। খ্রিস্টীয় ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইরানে বিপুলসংখ্যক হাম্মাম তৈরি হয়। ঐতিহাসিক ইস্পাহান শহরে মুসলিম আমলে তৈরি বহু হাম্মাম টিকে আছে। ষোড়শ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত মুসলিম শাসকরা ভারতীয় উপমহাদেশে অসংখ্য হাম্মাম তৈরি করেছিল। এসব হাম্মামের বেশ কিছু এখনো অবশিষ্ট আছে; যেমন—ফতেহপুর সিক্রির হাম্মামখানা, দিল্লির লালকেল্লার হাম্মাম, ভূপালের হাম্মামে কাদিমি ইত্যাদি।</p> <p><strong>তুর্কি সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতা</strong></p> <p>হাম্মামের প্রসারে উসমানীয় সুলতানরাই প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালন করেন। তারা এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকায় তাদের শাসনাধীন অঞ্চলে হাম্মামের ব্যাপক প্রচলন ঘটান। পূর্ব ও মধ্য ইউরোপে মূলত উসমানীয়রাই হাম্মামের প্রসার ঘটায়। বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, গ্রিস ও হ্যাঙ্গেরিতে উসমানীয় আমলের হাম্মাম এখনো টিকে আছে। উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র, যা আধুনিক তুরস্কের সীমানাধীন, তাতে হাম্মামের অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটে। উসমানীয় আমলের প্রাচীনতম কয়েকটি হাম্মাম হলো তাহতাকালে হাম্মাম, মাহমুদ পাশা হাম্মাম, দ্বিতীয় বায়েজিদ হাম্মাম ইত্যাদি। তুরস্কের বিখ্যাত স্থাপত্য প্রকৌশলী মিমার সিনানের নকশায় একাধিক হাম্মাম তৈরি হয়েছিল, যাকে উসমানীয় আমলের মৌলিক স্থাপত্যরীতি মনে করা হয়। যেমন—চেম্বারলিটাস হামামি, সুলাইমানি হাম্মাম (সুমাইমানি মসজিদ কমপ্লেক্সের অন্তর্গত), হাসেকি হুররেম সুলতান হাম্মাম ইত্যাদি। তুর্কি সমাজে ব্যক্তিগত হাম্মামের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সুলতান তৃতীয় মোস্তফা ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রীয় হাম্মাম তৈরি বন্ধ করার নির্দেশনা জারি করেন।</p> <p><strong>হাম্মামে নারীর অংশগ্রহণ</strong></p> <p>ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলিম নারীরা হাম্মামে গোসল করত না। কিন্তু খ্রিস্টীয় দশম শতকের পর মুসলিম বিশ্বে নারীদের জন্য পৃথক হাম্মাম গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে তা নারীদের সামাজিক যোগাযোগ ও আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে।</p> <p><strong>হাম্মামের প্রকারভেদ</strong></p> <p>মুসলিম সমাজে চার ধরনের হাম্মামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তা হলো—</p> <p>১. ব্যক্তিগত হাম্মাম : মানুষ ব্যক্তিগতভাবে নিজ বাড়ি বা প্রাসাদে তৈরি করত।</p> <p>২. উন্মুক্ত হাম্মাম : সাধারণ মানুষের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তৈরি করা হতো। এসব হাম্মামের যাবতীয় ব্যয় রাষ্ট্র নির্বাহ করত এবং সাধারণ মানুষ ছিল তার সুবিধা গ্রহণকারী।</p> <p>৩. ওয়াকফ হাম্মাম : মাদরাসা, মসজিদ ও খানকাহর মতো কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সংস্থানের জন্য রাষ্ট্র বা সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে ওয়াকফ হিসেবে তৈরি করে দেওয়া হতো। এসব হাম্মাম থেকে উপার্জিত অর্থ এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে ব্যয় করা হতো।</p> <p>৪. বাণিজ্যিক হাম্মাম : মানুষ অর্থ উপার্জনের জন্য তৈরি করত এবং নগরবাসী অর্থের বিনিময়ে এর সেবা গ্রহণ করত।</p> <p><strong>বাংলাদেশে মুসলিম হাম্মাম</strong></p> <p>বাংলায় হাম্মাম স্থাপত্যের বিকাশ ঘটেছে মধ্যযুগের শেষ ভাগে। বাংলার সমাজকাঠামো ও সংস্কৃতিতে হাম্মাম একটি নতুন ও অভিনব সংযোজন। স্থাপত্যবিদ্যার ক্ষেত্রে এই ধরনের গোসলখানা বা ইমারত নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছে। পশ্চিম বাংলার মালদহ জেলার হজরত পাণ্ডুয়ায় অবস্থিত সাতাইশগড় হাম্মামখানাটি প্রাচীনতম হাম্মাম বলে ধারণা করা হয়। এতে মোট ২৭টি গোসলকক্ষ আছে বলেই স্থাপত্যটির নাম এরূপ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। পশ্চিম বাংলার গৌড় ও রাজমহলের হাম্মাম দুটির নির্মাণকৌশল ও পরিকল্পনায় মোগলদের গড়া উত্তর ভারতীয় স্টাইল অনুসরণ করা হয়েছিল। বাংলা অঞ্চলের বেশির ভাগ হাম্মাম মোগল প্রশাসকদের বাসভবনের সন্নিকটে নির্মাণ করা হতো।</p> <p>বাংলা অঞ্চলে মোগল বা প্রাক-মোগল যুগে বেশ কিছু হাম্মাম নির্মিত হয়েছিল। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ছয়টি হাম্মাম চিহ্নিত করা গেছে। এগুলো হলো ঢাকার লালবাগ ও জিঞ্জিরা, যশোরের মির্জানগর, সাতক্ষীরার ঈশ্বরীপুর ও জাহাজঘাটা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছোট সোনামসজিদ সংলগ্ন হাম্মাম। এর মধ্যে ঢাকা, মির্জানগর, ঈশ্বরীপুর ও জাহাজঘাটা (দুটি) হাম্মামখানার নির্মাণকৌশল ও পরিকল্পনা উত্তর ভারতীয় স্টাইল অনুসরণে নির্মিত।</p> <p><em>তথ্যঋণ : আরব নিউজ, মিট মিউজিয়াম ডট অর্গ, বাংলাপিডিয়া ও উইকিপিডিয়া</em></p>