<p>সমালোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয়। এটি শুধু একটি দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বরং সমাজের নৈতিকতা ও মানসিকতার উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সঠিক পদ্ধতির অনুসরণ। সমালোচনা যদি গঠনমূলক ও কল্যাণকামী না হয়, তাহলে তা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। বর্তমানে অহর্নিশ সমালোচনার নামে যে বিদ্রুপাত্মক ও আক্রমণাত্মক দোষ চর্চা হয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বানোয়াট অপবাদ আরোপ করা হয়, তা কখনোই ইসলামে প্রত্যাশিত নয়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘পেছনে ও সামনে প্রত্যেক পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ-ধ্বংস।’ (সুরা : হুমাজাহ, আয়াত : ১)</p> <p>আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনের অন্য জায়গায় ইরশাদ করেন, ‘তোমরা একে অন্যের দোষত্রুটি অন্বেষণ কোরো না এবং পরস্পর গিবত কোরো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তা ঘৃণাই করো। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১২)</p> <p><strong>সমালোচনা ও পরনিন্দা</strong></p> <p>সমালোচনা ও গিবতের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট। সমালোচনা হলো, কোনো ব্যক্তি বা বিষয়কে নির্মাণমূলকভাবে বিশ্লেষণ করা, যেখানে উদ্দেশ্য থাকে উন্নতি বা ভালো করার জন্য পরামর্শ দেওয়া। এতে সাধারণত তথ্যভিত্তিক ও যুক্তিযুক্ত আলোচনা করা হয়। গিবত হলো অন্যের সম্পর্কে খারাপভাবে বলা বা তাদের পেছনে কথা বলা, যা সাধারণত উদ্দেশ্যহীন বা নেতিবাচক। এটি মানুষের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করতে পারে এবং এর ফলে সামাজিক সম্পর্ক ভেঙে যেতে পারে।</p> <p><strong>ইসলামী ফিকহে সমালোচনা</strong></p> <p>ইসলামী ফিকহে (আইন) সমালোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ওলামারা বলেন, ‘যিনি অন্যের ভুল দেখেন, তাঁর কর্তব্য হলো তাকে সঠিক পথে নিয়ে আসা।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভি রহ.)</p> <p>মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনেও সমালোচনার উদাহরণ দেখা যায়। তিনি ভুল কাজের সমালোচনা করতেন, কিন্তু তা গঠনমূলকভাবে। যেমনটি রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য আয়নাস্বরূপ এবং এক মুমিন অপর মুমিনের ভাই। তারা একে অপরের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তাকে রক্ষা করে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৯১৮)</p> <p><strong>সমালোচনার মৌলিক উদ্দেশ্য</strong></p> <p>ইসলামে সমালোচনার প্রধান উদ্দেশ্য হলো ভুল সংশোধন ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা। আল-কোরআনে সুরা আল-মায়িদায় এভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে : ‘তোমরা পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতা করো ন্যায় ও সত্কর্মে, আর পাপকর্ম ও অত্যাচারে সহযোগিতা কোরো না।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ২)</p> <p>ইসলামের দৃষ্টিতে সমালোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্য প্রতিষ্ঠা, নৈতিকতা বজায় রাখা এবং সমাজের উন্নতির জন্য গঠনমূলক সমালোচনা করা। এর মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের উন্নতি সম্ভব।</p> <p><strong>সমালোচনার পদ্ধতি</strong></p> <p>সমালোচনা করার জন্য নৈতিক ও ইসলামী পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। যেমন—</p> <p>১. প্রমাণভিত্তিক সমালোচনা :  সমালোচনা অবশ্যই তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে করতে হবে। অহেতুক ধারণা বা সন্দেহবশত কারো সমালোচনা করা গুনাহের কাজ।  আল্লাহ তাআলা কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদাররা!  তোমরা অহেতুক ধারণা করা থেকে বিরত থাকো। কেননা কিছু কিছু  অহেতুক ধারণা গুনাহ।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত :  ১২)</p> <p>হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো কিছু বলবে, তার উচিত তা সঠিকভাবে জানা।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮১১)</p> <p>২. নেক নজর ও উদ্দেশ্য : সমালোচনার উদ্দেশ্য যেন হয় গঠনমূলক ও সংশোধনমূলক। ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়।</p> <p>৩. আলোচনা ও সংলাপ : সমালোচনা করার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার করা উচিত। যদি সত্যিই বিব্রতকর কিছু হয়ে থাকে তাহলে যেন সে নিভৃতে সংশোধনের সুযোগ পায়।</p> <p>৪. কঠোরতার বিপরীতে নম্রতা : ইসলাম সমালোচকের কঠোর আচরণ ও ভাষার বিপরীতে নম্র আচরণ করতে বলে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা উভয়ে নম্র ভাষায় কথা বলো। হয়তো সে শিক্ষা গ্রহণ করবে অথবা ভয় পাবে।’ (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ৪৪)</p> <p><strong>সমাজে সমালোচনার ভূমিকা</strong></p> <p>সমালোচনা সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং নৈতিকতা উন্নত করে। এটি সমাজের দায়িত্ববোধ ও ন্যায়বোধকে প্রজ্বলিত করে। এর মাধ্যমে মানুষের অজান্তে সংঘটিত ভুলভ্রান্তি ধরা পড়ে এবং অসাধু লোকদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জনসাধারণকে সতর্ক করা যায়।</p>