<p style="text-align:justify">প্রাচীন যুগ থেকেই পূর্ববর্তীদের কাহিনির চর্চা আছে। তবে ইসলাম ইতিহাস বর্ণনা ও সংকলনের নীতি শিক্ষা দিয়েছে। ইসলাম ইতিহাসের বর্ণনাকে অবাধভাবে গ্রহণ করা থেকে নিষেধ করেছে; বরং যাচাই-বাছাই করে গ্রহণের নির্দেশ দেয়। ইরশাদ হয়েছে : ‘হে ঈমানদাররা, যদি কোনো ফাসিক তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তা যাচাই করে নাও।’ (সুরা হুজুরাত : আয়াত ৬)</p> <p style="text-align:justify">রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটিই যথেষ্ট যে সে যা-ই শুনে যাচাইবিহীন তা-ই রটাতে থাকে।’ (মুসলিম : ১/১০)</p> <p style="text-align:justify"><strong>ইসলামে ইতিহাসশাস্ত্রের অবস্থান</strong></p> <p style="text-align:justify">ইতিহাসশাস্ত্রের অসামান্য গুরুত্ব সত্ত্বেও তার দ্বারা আকিদা বা বিধানাবলি প্রমাণিত হবে না। হালাল-হারাম বিষয়ক ফায়সালা, তদ্রুপ যে বিষয়াদিতে কোরআন-সুন্নাহ বা ইজমা-কিয়াস ইত্যাদির প্রমাণ প্রয়োজন, সেখানে ইতিহাসশাস্ত্রের একচ্ছত্র গ্রহণযোগ্যতা কেউ-ই স্বীকার করেনি। কারণ যদিও ইসলামী ইতিহাসের উৎসগুলো প্রাচীন রাজা-বাদশাদের গল্পের মতো ঠুনকো ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং অনেকটা যাচাই-বাছাইয়ের পর্ব শেষেই ইতিহাসগ্রন্থে স্থান পেয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">তা সত্ত্বেও ইতিহাসগ্রন্থ থেকে উপকৃত হওয়ার ক্ষেত্রে এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে ইসলামের আকিদা, বিধি-বিধান ও মূলনীতি প্রমাণিত হওয়ার ক্ষেত্রে যে পর্যায়ের গ্রহণযাগ্য দলিলের প্রয়োজন ওই পর্যায়ের যাচাই-বাছাই ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূূহে সাধারণত বিবেচ্য হয়নি। (মাকামে সাহাবা, মুফতি শফি, পৃষ্ঠা ৩১-৩৩)</p> <p style="text-align:justify"><strong>ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহ ও সাহাবিদের ন্যায়পরায়ণতা</strong></p> <p style="text-align:justify">ইতিহাসগ্রন্থে সাহাবিদের মর্যাদাহানিকর কিছু ঘটনা পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে মূলনীতি হলো, সাহাবিদের ন্যায়পরায়ণতা ও ক্ষমার ব্যাপারে কোরআন-সুন্নাহে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। তাঁদের প্রতি আল্লাহর ক্ষমা, সন্তুষ্টি ও জান্নাতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">তাই শুধু ইতিহাসের বর্ণনার ভিত্তিতে কোনো সাহাবির ব্যাপারে মর্যাদাহানিকর কথাবার্তা গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা ইতিহাসগ্রন্থসমূহে অনেক দুর্বল-অশুদ্ধ ও জাল বর্ণনার ছড়াছড়ি আছে। তাই শুধু ইতিহাসের বর্ণনা দ্বারা কোনো সাহাবির ন্যায়পরায়ণতা পরীক্ষা করা যাবে না, বরং ওই ঐতিহাসিক বর্ণনাটির গ্রহণযোগ্যতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা অপরিহার্য। (আল-আকিদাতুল ওয়াসিতিয়া, ইবনে তাইমিয়া, পৃষ্ঠা ২৬, মাকামে সাহাবা, পৃষ্ঠা ৩৪)</p> <p style="text-align:justify"><strong>ইসলামের ইতিহাস এবং মুসলিমদের ইতিহাস</strong></p> <p style="text-align:justify">নবীজীবনী ও সাহাবিদের জীবনীকে নিঃসন্দেহে ইসলাম ধর্মের ইতিহাস বলে অভিহিত করা যায়। কিন্তু তৎপরবর্তী মুসলিমদের ইতিহাস ধর্মের ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত নয়। যদিও পরবর্তী যুগে ধর্মীয় বহু কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ইসলামের প্রসার, অমুসলিমদের মধ্যে ইসলাম প্রচার এবং মসজিদ, মাদরাসা ও খানকা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সাম্রাজ্য পরিচালনাসহ মুসলমানদের বিভিন্ন অন্তর্দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, পারস্পরিক সংঘাত, পাপাচারী ও অত্যাচারী বাদশাদের ইতিবৃত্ত ধর্মীয় ইতিহাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি না।</p> <p style="text-align:justify">এটাকে মুসলিমদের ইতিহাস বলা যায়, যেখানে তাদের উত্থান-পতন এবং কখনো তাদের ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ফুটে ওঠে, আবার কখনো দূরত্ব। তাই ইসলামের ইতিহাস হিসেবে সংকলিত গ্রন্থগুলোকে মুসলিম জাতির ইতিহাস হিসেবে অধ্যয়ন করা উচিত, ইসলাম ধর্মের ইতিহাস হিসেবে নয়। (তারিখে উম্মতে মুসলিমা, ভূমিকা, পৃষ্ঠা ৪৩)</p> <p style="text-align:justify"><strong>ইতিহাস অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সচেতন পাঠকের দায়িত্ব</strong></p> <p style="text-align:justify">যেকোনো ভালো জিনিসের নিয়মবহির্ভূত ব্যবহার ক্ষতির কারণ হয়। ইতিহাসশাস্ত্রেরও বেশ কিছু ক্ষতিকর দিক আছে। এর যথাযথ বিবেচনা না করার ফলে বহু ইতিহাস পাঠকের মধ্যে নিজেদের অতীত নিয়ে হীনম্মন্যতা ও পূর্বসূরিদের ব্যাপারে ভুলধারণার জন্ম নিতে দেখা যায়। তাই নিম্নোক্ত বিষয়াদি লক্ষ্য রাখা অপরহার্য :</p> <p style="text-align:justify">১.  ইসলামী শরিয়তের আকিদা, বিধিবিধান ও মূলনীতি সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা।</p> <p style="text-align:justify">২.  ইসলামী শরিয়তের মৌলিক উৎস ও দলিলের ওপর প্রাধান্যমূলক সর্বোচ্চ আস্থা রাখা।</p> <p style="text-align:justify">৩.  নবীদের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন থাকা।</p> <p style="text-align:justify">৪.  সাহাবিদের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতনতা।</p> <p style="text-align:justify">৫.  যেসব বর্ণনায় ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও সালাফদের ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপিত হয়, সেগুলোকে ঢালাওভাবে গ্রহণ না করে সচেতনতার সঙ্গে গ্রহণ করা।</p> <p style="text-align:justify">৬.  ব্যক্তির ভুল ও মন্দ দিক এবং ইসলাম ধর্মের পার্থক্য বিষয়ক সচেতনতা।</p> <p style="text-align:justify">৭.  ভ্রান্ত আকিদাপন্থী লেখকের গ্রন্থ থেকে উপকৃত হওয়ার ক্ষেত্রে সচেতন থাকা।</p> <p style="text-align:justify">৮.  অমুসলিম ও প্রাচ্যবিদদের গ্রন্থ থেকে উপকৃত হওয়ার ক্ষেত্রে সচেতনতা।</p> <p style="text-align:justify">৯.  ইতিহাসের বুদ্ধিবৃত্তিক ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা নিঃশর্তভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণার নামে সর্বসম্মত বিশুদ্ধ বর্ণনা ছেড়ে দেওয়া যাবে না।</p> <p style="text-align:justify">১০. ঐতিহাসিক বর্ণনার ভিত্তিতে ইসলামী শরিয়তের সর্বসম্মত বিশুদ্ধ বিষয়াদিতে মনে প্রশ্ন এলে তা বিজ্ঞ আলেমদের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধা করার চেষ্টা করবে। (মানহাজু কিতাবাতিত তারিখ, ড. মুহাম্মাদ ইবনে শামেল, পৃষ্ঠা ৫০৯)</p> <p> </p>