<p>আমার এক প্রতিবেশী চাকরি সূত্রে চট্টগ্রামে থাকেন। অনেক বছর পর আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। এক পর্যায়ে তাকে খুব বিষণ্ন মনে হলো। প্রশ্ন করে উত্তর পেলাম। তার দুই ছেলে। একজন আইএসসি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। অন্যজন সামনে এসএসসি দেবে। খুব টেনশনে থাকতে হচ্ছে তাকে। গত জুলাই-আন্দোলনে দুই ছেলেই মাঠে সক্রিয় ছিল। ছোট ছেলের পায়ে গুলি লেগেছিল। তবে খুব বড় ক্ষতি হয়নি। এক পাশের চামড়া ছিঁড়ে গুলি বেরিয়ে গেছে। অল্পদিনের চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছে সে। কিন্তু ছেলে দুটি এখন যেন আর ঠিক লাইনে চলছে না। পারিবারিক শাসন কার্যকর নয় তদের মধ্যে। একটি অস্থিরতা যেন পেয়ে বসেছে।</p> <p>আজাদ সাহেব মনে করেন ছেলেদের ওপর তিনি যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। হঠাৎ করে ওরা আমাদের খুব ব্যাকডেটেড মনে করছে। ওরা যা জানে ও বোঝে, তা-ই সঠিক। লেখাপড়ায় মন তেমন নেই। ওদের হাবভাব দেখলে মনে হয় প্রায় নাবালক এই ছেলেগুলো মনে করছে ওরাই সবচেয়ে শক্তিমান। ওরা এত শক্তিশালী যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়েছে। নতুন সরকার বসিয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতায়। স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন তার নিয়োগকর্তা ওরাই। সুতরাং আর পায় কে! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আজাদ সাহেব বললেন, ‘আপনি তো ভাগ্যবান। একটিই মেয়ে আপনার। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে। এখন আবার উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাচ্ছে। কোনো শঙ্কা নেই। এদিকে ছেলেদের আচরণ দেখে আমাদের মতো বাবারা সারাক্ষণ উত্কণ্ঠায় থাকি।’</p> <p>আমার যে আশঙ্কা নেই তেমন নয়। সমাজ বিচ্ছিন্ন তো আমরা কেউ নই। ভবিষ্যতে দেশের হাল ধরবে এখনকার কিশোর-তরুণরা। কিন্তু এরা যেভাবে পথ হারাচ্ছে, তাতে গভীর শঙ্কা আমাদের বিমর্ষ করে তুলছে। আমি শিক্ষকের জায়গা থেকে দেখছি, এরা এখন লেখাপড়ায় বিশেষ মনোযোগ দিতে চাচ্ছে না। কোন সরলপথে সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে সেদিকে মন। গণ-অভ্যুত্থানের পর সরকারের দায়িত্বশীলদের তেমন দায়িত্ব নিতে দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষকদের অপমান করে পদত্যাগে বাধ্য করানোর একটি মচ্ছব গেল কিছুদিন। তারপর এই কিশোর-তরুণরা যেন ব্যবহৃত হতে থাকল। গণ-অভ্যুত্থানের পর একটি সরকার গঠিত হয়েছে। এখন যা চাওয়া-পাওয়া, দাবিদাওয়া সব উত্থাপিত হবে নিজেদের সরকারের কাছেই। কিন্তু হাইকোর্টের মর্যাদা নষ্ট করে ছাত্ররা (?) বিচারপতিদের পদত্যাগ করাতে মিছিল নিয়ে ছুটে গেল। মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করাতে বঙ্গভবন ঘেরাও করল। মনে হচ্ছিল, কারো কারো ইচ্ছাপূরণের লাঠিয়াল যেন এরা।</p> <p><img alt="প্রজন্মের জন্য আলোর পথ প্রয়োজন" height="290" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/11.November/29-11-2024/Untitled-1.jpg" style="float:left" width="320" />এরপর একে একে অরাজকতা চলতেই লাগল। খোদ রাজধানীতেই কত অঘটন ঘটল। ঢাকা কলেজ বনাম সিটি কলেজের ছাত্ররা মারামারি করে নিউমার্কেট-সায়েন্স ল্যাব এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত করল। সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটল ২১ ও ২৫ নভেম্বর রাজধানীর তিনটি কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ ও লুটপাটের ঘটনায়। এক পক্ষে ডেমরার ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা, অন্য পক্ষে রাজধানীর সরকারি কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা। চার-পাঁচ দিন আগে মোল্লা কলেজের এক ছাত্র ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে মারা গেলে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ ওঠে। এতে কলেজের শিক্ষার্থীরা মেডিক্যাল কলেজে হামলা চালায়। পরে তাদের নিবৃত্ত করতে হস্তক্ষেপ করে হাসপাতালের প্রতিবেশী কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্ষিপ্ত হয়। এই অস্থির প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা বিবেক দিয়ে চলার পথ হারিয়েছে। তারা প্রতিশোধ নিতে হামলা চালিয়ে সোহরাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট করে। লাইভ ভিডিও দেখে বিস্মিত হতে হয় আমাদের। ছাত্ররা কলেজের সোফা, ফ্যানসহ নানা কিছু লুটে নেয়। কতটা অভব্য যে ভাঙচুর আর লুটপাট করে কলেজ ক্যাম্পাসে বিজয়ের আনন্দে নৃত্য করতে থাকে। এতটুকু বিবেক যেন কাজ করছে না। কলেজের অধ্যক্ষা দুঃখ করে বললেন, এই অরাজকতা থেকে রক্ষা পেতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সহযোগিতা চেয়েও তিনি পাননি। তিনি মনে করেন, প্রায় ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে কলেজের।</p> <p>আসলে বিগত গণ-অভ্যুত্থানের সময় ও পরে পুলিশ যেভাবে হামলার শিকার হয়েছিল, আহত-নিহত হয়েছে অনেক পুলিশ। অনেক থানা আক্রান্ত হয়েছে। পুড়িয়ে ছাই করা হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে পুলিশের মনোবল ভেঙে গেছে। সরকার পুলিশের পাশে যে দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়েছে, তেমনটি চোখে পড়েনি। বরং ছাত্ররা ন্যায্য-অন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন করলে সরকার তা-ই মেনে নিয়েছে, নিচ্ছে। ফলে পুলিশ তার নিরাপত্তার কথা তো ভাববেই। কিন্তু এভাবে কি চলতে পারে! এই অঘটনের পর কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারকে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়। অন্যথায় সোমবার তারা প্রতিশোধ নিতে বেরিয়ে পড়বে।...সব স্পষ্ট থাকার পরও সরকার নীরব ছিল।</p> <p>এ প্রসঙ্গে ক্ষুব্ধ আমার প্রতিবেশী আজাদ সাহেবের উক্তি, ‘দেখে মনে হয় না দেশে কোনো সরকার কাজ করছে।’ ২৫ নভেম্বর প্রতিশোধ নিতে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের সঙ্গে আশপাশের অনেক কলেজের হাজার হাজার ছাত্র পুরান ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে ডেমরার দিকে। দু-তিন পয়েন্টে পুলিশ বাধা দিলেও যুদ্ধযাত্রা রোধ করা যায়নি। এমন হাঁকডাক করে লাঠিসোঁটা নিয়ে এগিয়ে চলা সহস্র অস্থির প্রজন্ম এগিয়ে চলল, কিন্তু দায়িত্বশীল কোনো পক্ষকে দেখা গেল না নিবৃত্ত করতে। জুলাই-অভ্যুত্থানে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে গুলির মধ্যে ঠেলে দেওয়া সমন্বয়কদেরও কোনো ভূমিকা দেখা গেল না। দেশবাসী লাইভ যুদ্ধ দেখেছে টিভির পর্দায়। দুই লড়াকু পক্ষ ছাড়া আর কাউকে দেখা গেল না। সংখ্যায় কম বলে মোল্লা কলেজের ছাত্ররা অনেকটা পরাভূত হয়। আক্রমণকারী বাহিনী প্রবলভাবে হামলে পড়ে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। তছনছ করে দেয়। লুটপাটের বদলে এরাও লুটপাট শুরু করে। চেয়ার, সোফা, মনিটর থেকে শুরু করে ফুলদানি পর্যন্ত লুট শেষে বিজয়ের আনন্দে ফিরে যায়। সব অঘটনের পরে অবশ্য রাষ্ট্রের সব বাহিনী এসে অবস্থান নেয়। শতাধিক আহত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি। গুরুতর আহতও আছে অনেকে।</p> <p>বোঝা গেল দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। কিশোর-তরুণরা বিশ্বাস করতে শিখেছে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক ওরাই। ওরা যা করবে, সরকার তা মেনে নেবে। তাই দোর্দণ্ড প্রতাপে লাল ঘোড়া ছুটছে। কিন্তু রাষ্ট্রের বৃহত্তর কল্যাণে এদের তো থামাতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অস্থির প্রজন্মকে থামাবে কে? আতঙ্কের বিষয়, আমাদের এই প্রজন্ম তো এখন আর বিবেকের শাসনে চলে না। বিবেক ছেলেবেলা থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাগ্রত হয় মনে। তাহলে একুশ শতকের তরুণ প্রজন্ম ছোটখাটো ঘটনায় এতটা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে যাচ্ছে কিভাবে? সতীর্থ বন্ধুদের রক্তাক্ত করতে দ্বিধা করে না এরা! নিজেরা শিক্ষার্থী তার পরও অবলীলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভেঙেচুরে তছনছ করছে। তারা শিক্ষকদেরও আহত করছে, অপমান করছে। আরো লজ্জার এরা চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারীদের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্পদ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। বিবেক এতটুকু সাড়া দেয় না! প্রকাশ্যে হাসতে হাসতে, নাচতে নাচতে চেয়ার, মনিটর মাথায় নিয়ে রাজপথ অতিক্রম করছিল।</p> <p>প্রতিবাদের তো অনেক শোভন উপায় আছে। সে পথে হাঁটছে না কেন!</p> <p>১৯৯১-এর একটি স্মৃতি মনে পড়ল। আমি কলকাতায় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লাইব্রেরির ক্যাম্পাসে রিডার্স হোস্টেলে থেকে লাইব্রেরি ব্যবহার করি। ন্যাশনাল লাইব্রেরির সীমানার পরই ভারতীয় সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের কর্মকর্তাদের কোয়ার্টার। এই কর্মকর্তাদের অনেকে লাইব্রেরির ক্লাব ব্যবহার করতেন। তাদের কোনো কার্যকলাপ এখানকার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা পছন্দ করতেন না। একটি চাপা ক্ষোভ ছিল। একদিন জানলাম, লাইব্রেরি ক্যাম্পাসের টেনিস কোর্টে সরকারি কর্মকর্তাদের আন্ত ভারতীয় টেনিস টুর্নামেন্ট হবে। কিন্তু কর্মচারীরা প্রতিবাদ করলেন। তারা এখানে কর্মকর্তাদের খেলা হতে দেবেন না। লাইব্রেরির পেছনের গেট আমি সাধারণত ব্যবহার করি। কারণ মেইন রোড ও বাসস্ট্যান্ড কাছে। গেটের কাছেই টেনিস কোর্ট। সংস্কার করে সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। টুর্নামেন্টের দিন ঘনিয়ে আসছে। হঠাৎ একদিন গেট পার হতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। অভ্যস্ত চোখ হোঁচট খেল। কী যেন নেই। একটু পরে বুঝলাম টেনিস কোর্টটিই নেই। তার বদলে অসংখ্য ফুলে ঝলমলে বাগান। বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করলাম। না টেনিস কোর্টের কোনো ক্ষতি করা হয়নি। পুরো ক্যাম্পাসের বিল্ডিংগুলোতে হাজার হাজার ফুলের টব রয়েছে। কর্মচারীরা ভ্যানগাড়ি করে সেসব টব এনে টেনিস কোর্টের ওপর শিল্পিতভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন। এটিই ছিল তাদের শিল্পমণ্ডিত প্রতিবাদের ভাষা। বলার অবকাশ নেই যে টুর্নামেন্ট আর হতে পারেনি।</p> <p>মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধার নামে কিছু উচ্ছৃঙ্খল তরুণ তখন অন্ধকার পথে পা বাড়িয়েছিল। সমাজে একটি বড় সংকট তৈরি হয়েছিল। এই বাস্তবতা সামনে রেখে খান আতা নির্মাণ করেছিলেন চলচ্চিত্র ‘আবার তোরা মানুষ হ’। আমাদের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি এই কিশোর-তরুণদের আলোর পথ দেখাবে কে!</p> <p>লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p>shahnawaz7b@gmail.com</p>