<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এবারের বন্যাটা অস্বাভাবিক। তবে অভূতপূর্ব নয়। বাংলাপিডিয়া অনুযায়ী ১৭৮১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এ ধরনের বন্যা বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও বহুবার হয়েছে। সুদূর অতীত কালেও এ ধরনের বন্যা হতো। রামায়ণ-মহাভারত এবং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এর কিছু প্রমাণ আছে। তবে প্রথাগতভাবে বন্যা সম্পর্কিত ধারাবাহিক তথ্য সংরক্ষণ করার ইতিহাস বোধ হয় বেশিদিনের নয়। ১৮৭০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত সংগৃহীত উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত এক বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনের কথা জেনেছি। ওই প্রতিবেদন মোতাবেক প্রতি সাত বছরে একবার বন্যা হতো ব্যাপক আকারে। আর করালগ্রাসী আকারে দেখা দিত প্রতি ৩৩ থেকে ৫৫ বছরে একবার। ১৯২২ সালের পর থেকে আরো ৫০ বছর পর্যন্ত হয়তো এই হিসাবটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু এর পর থেকে বন্যার প্রখরতা যেমন বেড়েছে, তেমনি পুনরাবৃত্তির সময়ও কমে এসেছে। নিকট অতীত যেমন ১৯৭১, ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ২০০৪, ২০০৭, ২০১৭, ২০২২ সালের করালগ্রাসী বন্যাগুলো দেখে তা-ই মনে হয়। নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কাছে প্রকৃত তথ্য আছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নই এ ধরনের বন্যার অন্যতম কারণ। তাঁরা বলছেন যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিমালয়ের গ্লেসিয়ার গলছে আশঙ্কাজনক হারে। বরফগলা সেই পানি তার স্বভাব অনুযায়ী নিচের দিকে আসছে আগের চেয়ে অনেক বেশি করে। সমুদ্রের পানির বাষ্পীভবনের হার আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। ফলে পাহাড় ও সমভূমিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেড়ে গেছে। এ ছাড়া মানুষের উৎপাতে পাহাড়ের গাছপালা কমে গেছে। ফলে মাটির ক্ষয়বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাহাড় আগের মতো পানি ধরে রাখতে পারছে না।  পাশাপাশি পাহাড় ধোয়া পানিতে থাকা পলির কারণে আমাদের নদীনালা-বিল-বাঁওড়গুলো ভরে যাওয়ায় সেগুলো তাদের স্বাভাবিক পানিধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এবার আসি সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি  হয়ে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ইত্যাদি জেলায় সাম্প্রতিক বন্যার বিষয়ে। ১৯ আগস্ট থেকে উজানে ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের সমগ্র পূর্বাঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। এসব অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের পেছনে উপর্যুক্ত কারণগুলোর সঙ্গে লা-নিনার  (</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">La-Nina</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">) প্রভাব আছে বলে বিজ্ঞানীরা বলছেন। কিন্তু সাধারণের বিশ্বাস, ত্রিপুরার ডম্বরু বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে এ ধরনের অস্বাভাবিক বন্যা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের বিজ্ঞানভিত্তিক মতামত সাধারণের আবেগের কাছে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ভেসে যাচ্ছে। অকস্মাৎ এই বন্যায় অপূরণীয় ক্ষতির শিকার এসব সাধারণ মানুষের আবেগের কাছে এ মুহূর্তে চুপ থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। যা হোক, এখন ভাবতে হবে ভবিষ্যতে রাজনৈতিকভাবে কতখানি কী করা যায়।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আকস্মিক এই বন্যার কারণে ভুক্তভোগী এলাকার  বেশির ভাগ ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। আমি শুধু ধানের কথা বলছি। এখন ভাদ্রের মাঝামাঝি। অনেক জায়গায় </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কাটার উপযোগী</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> নাবি আউশ ধান ডুবে গেছে। বেশির ভাগ জায়গায় আমন ধান তার বৃদ্ধি পর্যায়ের প্রথম দিকে ছিল। যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, বন্যার পানি নামতে সময় নিলে সেগুলো পুরোই নষ্ট হয়ে যাবে। তবে জলমগ্ন-সহিষ্ণু জাত (ব্রি ধান-৫১, ব্রি ধান-৫২, ব্রি ধান-৭৯,  বিনা ধান-১১, বিনা ধান-১২)  হলে প্রায় দুই সপ্তাহ পর্যন্ত পানির নিচে টিকে থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে পানি বেশি ঘোলা হওয়া চলবে না। পানির তাপমাত্রাও বেশি হওয়া যাবে না। যা হোক, ধান আমাদের প্রধান ফসল। তাই যেখানে যখন যে অবস্থাই হোক না কেন, ধানের ক্ষতি মেনে নেওয়া বেশি কষ্টকর। তাই কৃষি পুনর্বাসনের প্রয়োজনে কৃষক এবং কৃষি বিভাগের প্রথম পছন্দ ধান। তো এখন কী ধান চাষ করা যেতে পারে? আমন রোপণের স্বাভাবিক সময় শেষ। এমনকি নাবি আমন রোপণের শেষ সময় ৩১ ভাদ্র। তবে চারার বয়স হতে হবে ৩০ দিন। আর উচ্চ ফলনশীল নাবি আমন হিসেবে শতভাগ আলোকসংবেদী জাত বিআর-২২, বিআর-২৩ এবং ব্রি ধান-৪৬ ও ব্রি ধান-৫৪-এর বিকল্প নেই। পাশাপাশি স্থানীয় জাত থেকে বাছাই করা আলোকসংবেদী জাত বিআর-৫, ব্রি ধান-৩৪ ও নাইজার শাইল আবাদ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্রির পরামর্শ হলো ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরাসরি বপন অথবা ১৫ সেপ্টেম্বরের (ভাদ্রের শেষ দিন) মধ্যে রোপণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গোছাপ্রতি চার-পাঁচটি চারা ঘন করে (২০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার) রোপণ করতে হবে। চারা দাপোগ পদ্ধতি বা প্লাস্টিক ট্রে বা ভাসমান বীজতলায় তৈরি করে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে চারার বয়স ১২ থেকে ১৫ দিন হলেই চলবে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><img alt="বন্যা-পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসনে উপযোগী ধান-প্রযুক্তি" height="452" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/08.July/29-08-2024/0.jpg" style="float:left" width="500" />এবারে এ ধরনের পরিস্থিতিতে আলোকসংবেদী বিআর-২২ নিয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি। ৩০ দিনের চারা ২১ আশ্বিন (৬ অক্টোবর) রোপণ করে বিঘাপ্রতি প্রায় ১২ মণ ফলন পাওয়া সম্ভব। তবে একই বয়সের চারা ভাদ্রের শেষ দিনে (১৫ সেপ্টেম্বর) রোপণ করে ফলন পাওয়া গিয়েছিল বিঘাপ্রতি ১৬ মণ। আমার বিশ্বাস, আশ্বিনের ২১ তারিখ নয়, ১৫ তারিখের (৩০ সেপ্টেম্বর) মধ্যে রোপণ করতে পারলে একটা চলনসই ফলন পাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে আগস্টের শেষ বা সেপ্টেম্বরের প্রথমে বীজতলায় বীজ ফেলা যেতে পারে। তবে দেরি করে রোপণ করলে ফলন কিছুটা কমে যাবে। আমার হিসাব মতে, পহেলা আশ্বিন থেকে ধান রোপণের জন্য প্রতি এক দিন দেরি হলে বিঘায় প্রায় ছয় কেজি করে ফলন কমতে থাকে। যা হোক, ১৫ থেকে ২১ আশ্বিন পর্যন্ত রোপণ করা এই জাতীয় ধানের থোড় শুরুর সময়টা কার্তিকের ২০ থেকে ৩০ তারিখ। অর্থাৎ অঘ্রান মাসের শেষ নাগাদ ধান ফুলে যাবে। আমার বিশ্বাস, অন্যান্য আলোকসংবেদী জাত একই ধরনের ফলাফল প্রদর্শন করবে। যা হোক, বিআর-২২ এবং বিআর-২৩ জাত দুটি টুংরো ভাইরাসের প্রতি দুর্বল। তাই বীজতলায় থাকতেই ভাইরাসের বাহক সবুজ পাতা ফড়িং দমন করতে হবে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">নাবি রোপা আমনের উপযোগী জাত না থাকলে ব্রি ও বিনা উদ্ভাবিত স্বল্প জীবনকালীন জাত; যেমন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ব্রি ধান-৩৩, ব্রি ধান-৫৭, ব্রি ধান-৬২, ব্রি ধান-৭১, ব্রি ধান-৭৫, বিনা ধান-৭ এবং বিনা ধান-১৭ জাতের গজানো বীজ আগস্টের শেষ সপ্তাহে জমি থেকে পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি বুনে দেওয়া যেতে পারে। যদি রোপণ করতে হয়, তবে ১৫ থেকে ৩০ দিনের চারা গুছিতে বেশি করে রোপণ করতে হবে। চারা উৎপাদনের পদ্ধতিটা ওপরে যেভাবে বলা হয়েছে। ব্রি বলছে এই বোনার কাজটা ২৫ আগস্টের (১০ ভাদ্র) মধ্যে করা ভালো। তবে  নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাইরে এই জাতগুলো এভাবে করা যাবে না। লক্ষণীয় যে জাতগুলো উল্লিখিত সময়ের মধ্যে বপন করতে পারলেও বেশ খানিকটা ঝুঁকি থেকে যায়। তাদের প্রজনন পর্যায়ে (নভেম্বরের ১৫ থেকে ৩০ তারিখ : কার্তিকের শেষ থেকে অঘ্রানের মাঝামাঝি) একটানা তিন থেকে পাঁচ দিন যদি দিন ও রাতের তাপমাত্রা ২০০ সেলসিয়াস বরাবর বা এর নিচে অবস্থান করে, তাহলে ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফসল বোনার সময় আরো কিছুটা পিছিয়ে গেলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে। তবে আলোকসংবেদী জাত এই সংকট তাপমাত্রা পড়ার আগেই ফুলে  (</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">Flowering</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">) যেতে সক্ষম। কিন্তু তাপমাত্রার কথা তো বলা যায় না। সংকট মাত্রা থেকে আরো কমে গেলে পুরো ধান চিটা হয়ে যেতে পারে। তাই এই ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে স্বল্প জীবনকালীন মাষকলাই, মুগকলাই, সরিষা, শাক-সবজি ইত্যাদি ফসল করা যেতে পারে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমাদের মাঠের সমস্যা বহুবিধ। করালগ্রাসী বন্যার পরে এই সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করেছে সন্দেহ নেই। এরই মধ্যে মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা ক্ষতির প্রকৃতি নির্ধারণ করে ফেলেছেন। কৃষি পুনর্বাসনের প্রয়োজনে তাঁরা তাঁদের কর্মপরিকল্পনাও ঠিক করে ফেলেছেন। তার পরও আমার এই ধানের জাত নির্বাচন ও রোপণের সময় সম্পর্কিত কিছু প্রায়োগিক বিষয় তাঁদের সঙ্গে শেয়ার করছি।  </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন</span></span></span></span></p>