<p>‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ডাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৭২ ঘণ্টার সড়ক অবরোধ গতকাল সোমবার শেষ হয়েছে। চেনা ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে পাহাড়ি জনপদ। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে সহিংস ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতি এখন অনেকটাই শান্ত। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে জনজীবন। গতকাল খাগড়াছড়ি বাজারের সাপ্তাহিক হাটে মিলিত হয় সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালি ক্রেতা-বিক্রেতারা। অনেক পাহাড়ি জুমিয়া তাঁদের উত্পাদিত শাক-সবজির পসরা নিয়ে বাজারে আসেন। রাঙামাটিতে পরিবহন শ্রমিকদের ডাকা পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার করার পর গতকাল সকাল থেকে শহরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা</p> <p>চলাচল শুরু হয়। এতে নগরজীবনে স্বস্তি ফিরে আসে। পাশাপাশি রাঙামাটি-চট্টগ্রাম রুটেও যান চলাচল শুরু হয়। তবে বন্ধ ছিল রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি-বান্দরবান রুটে যান চলাচল। ছেড়ে যায়নি যাত্রীবাহী কোনো লঞ্চ। শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক অবস্থান ছিল।</p> <p>সাজেকে দুর্ভোগে পর্যটকরা, আজ ফিরতে পারে : এদিকে অবরোধের কারণে সাজেক ভ্যালিতে বেড়াতে গিয়ে তিন দিন ধরে আটক রয়েছে প্রায় দেড় হাজার পর্যটক। গতকাল সন্ধ্যায় অবরোধ শেষ হওয়ার পর আজ মঙ্গলবার সকালে তাদের সাজেক ছাড়ার কথা রয়েছে। চার দিন ধরে সাজেকে বিদ্যুত্ না থাকায় দুর্ভোগে পড়ে পর্যটকরা। বৃহস্পতিবার রাতে দীঘিনালা-সাজেক সড়কে বৈদ্যুতিক খুঁটির ওপর গাছ পড়ে সাজেকে বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। চার দিন ধরে বিকল্প ব্যবস্থায় জেনারেটর ব্যবহার করে পর্যটকদের বিদ্যুত্ সরবরাহ দিতে পারলেও অবরোধে জ্বালানি তেলের গাড়ি সাজেকে যেতে না পারায় ওই বিকল্প ব্যবস্থাও সব সময় চালু রাখা সম্ভব হয়নি। সেই সঙ্গে পানি ও খাবারের সংকটও দেখা দিয়েছে।</p> <p>পর্যটক সেলিম উদ্দিন গতকাল বিকেলে জানান, এখানে আসার পর বিদ্যুত্ ছিল না। জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুত্ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা সার্বক্ষণিক না। জ্বালানি তেলও নাকি শেষ হয়ে গেছে, তাই জেনারেটর চলছে না। আজকের (সোমবার) রাত কিভাবে কাটবে বুঝতে পারছি না। আবার পানি ও খাবার পর্যাপ্ত নেই।</p> <p>সাজেকের অবকাশ কটেজের স্বত্বাধিকারী বিজয় ঘোষ বলেন, ‘অবরোধের কারণে আমাদের কটেজে ৬৫ জনসহ সাজেকে প্রায় দেড় হাজার পর্যটক আটকা পড়ে আছে শনিবার থেকে। বিদ্যুত্ নেই বৃহস্পতিবার থেকে। জেনারেটর দিয়ে পর্যটকদের বিদ্যুেসবা দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু বর্তমানে জ্বালানি তেলের সংকটে সেই সেবাও বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এতে গরমে শিশুরা কষ্ট পাচ্ছে। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।’</p> <p>সাজেকের রিসোর্ট-কটেজের মালিক সমিতির সহসভাপতি চাই থোয়াই চৌধুরী জয় জানান, আটকে পড়া পর্যটকদের জন্য প্রথম দিন ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্ট এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন ৭৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়েছে। খাবারের সংকট মেটাতে আজ (সোমবার) রাতে কটেজ মালিক সমিতি ও ট্রাভেল এজেন্সি ইলেকট্রনিক ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে পর্যটক, গাড়ির চালক, স্টাফ—সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।</p> <p>রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, অবরোধের কারণে বাঘাইহাট-দীঘিনালা সড়কে একাধিক স্থানে গাছের গুঁড়ি ফেলে রাখা হয়েছে। এতে গাড়ি চলাচল করতে না পারায় পর্যটকদের তিন দিন সেখানে অবস্থান করতে হচ্ছে। মঙ্গলবার (আজ) সকাল সকাল তারা সাজেক ত্যাগ করতে পারবে।</p> <p>খাগড়াছড়ির জনজীবন স্বাভাবিক হচ্ছে : খাগড়াছড়ির পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত। আতঙ্ক কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে জনজীবন। গতকাল খাগড়াছড়ি বাজারের সাপ্তাহিক হাটে মিলিত হন সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালি ক্রেতা-বিক্রেতারা।</p> <p>দীঘিনালা সড়কের পাঁচ মাইল নামক এলাকার ভুবন ত্রিপুরা জুমের ভুট্টা নিয়ে গতকাল ভোরে বাজারে আসেন। তাঁর মধ্যে ভয়ভীতির চিহ্ন দেখা যায়নি। কৃষি গবেষণা এলাকার ম্রাসং মারমা বললেন, ‘কিছুটা আতঙ্ক নিয়েই বাঁশ কড়ুল আর শাক নিয়ে বাজারে এসেছি। আমরা গরিব মানুষ; মারামারি চাই না।’ জেলার অন্যতম ক্রীড়া সংগঠক ধূমকেতু মারমা বললেন, ‘এত দ্বন্দ্ব-সংঘাত করে লাভ কী? যে ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে, আসুন তা নিরসন করে এক কাতারে সমবেত হই।’ তিনি গুজবে কান না দিয়ে মিলেমিশে থাকার আহ্বান জানান।</p> <p>সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা সাধারণ সম্পাদক নির্মল কান্তি দাশ বলেন, পাহাড়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। সুবিধাবাদী গোষ্ঠী স্বার্থ হাসিলের জন্যই নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত জিইয়ে রাখতে চায়। তিনি অপচেষ্টাকারীদের বিষয়ে প্রত্যেককে সজাগ থাকার অনুরোধ জানান।</p> <p>জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। বৃহস্পতিবারের পর এ জেলার কোথাও অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি। এর পরও সেনাবাহিনীর টহলের পাশাপাশি অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে। সবখানেই সম্প্রীতি বৈঠক করে পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস বাড়ানোর কাজ চলছে। ভবিষ্যতে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবে না বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।</p> <p>এদিকে অবরোধের শেষ দিন খাগড়াছড়িতে শহরতলিকেন্দ্রিক অটোরিকশা, ইজি বাইক ও মোটরসাইকেল চলাচল স্বাভাবিক ছিল। অবরোধকে কেন্দ্র করে জেলার কোথাও তেমন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। জেলার মানিকছড়ি কলেজ এলাকায় দুপুর পর্যন্ত অবরোধের সমর্থনে খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা। কিছু স্থানে সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। পানছড়ি সড়কেও ব্যারিকেড ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল কম। খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ লে. কর্নেল রুবায়েত জানান, বিশেষ পরিস্থিতির কারণে শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। মঙ্গলবার (আজ) থেকে যথারীতি ক্লাস ও অন্যান্য পরীক্ষা কার্যক্রম চলবে।</p> <p>অবরোধ কর্মসূচিতে সমর্থন দেওয়া আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) জেলা সংগঠক ও মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেন, ‘বাহাত্তর ঘণ্টার সড়ক অবরোধ বড় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শেষ হয়েছে। এ জন্য পার্বত্য জেলাবাসীর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পরিকল্পিতভাবে সহিংসতা ঘটানো হয়েছে। অতীতের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। তিনি আন্তর্জাতিক মানের তদন্ত করে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সহিংসতায় জড়িতদের বিচার করার দাবি জানান।</p> <p>প্রসঙ্গত, গত ১৮ সেপ্টেম্বর ভোরে জেলা সদরের শালবন এলাকার বাসিন্দা মো. মামুনকে চুরির অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার জেরে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সহিংসতায় চারজন নিহত ও বহু লোক আহত হয়।</p> <p>পানছড়ি থেকে সশস্ত্র গ্রুপ সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান : এদিকে ইউপিডিএফের খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সংগঠক ও মুখপাত্র অংগ্য মারমা অবিলম্বে পানছড়ি থেকে জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সদস্যদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য জেএসএস সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল সংবাদমাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়—গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাত থেকে জেএসএসের সশস্ত্র কর্মীরা আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে খাগড়াছড়ির পানছড়িতে অবস্থান করছেন এবং বিভিন্নজনকে হুমকি দিচ্ছেন। এর ফলে দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে হামলার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা চলমান ছাত্র-গণ-আন্দোলনে স্বাভাবিকভাবে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ ব্যাপারে জনসংহতি সমিতির কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।</p> <p>‘সরকার পার্বত্য জনগোষ্ঠীর মানোন্নয়নে কাজ করছে’ : পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে শক্তিশালী করতে চাই। এর ধারাবাহিকতায় পরিবেশ রক্ষা, ইকো ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসহ সব ক্ষেত্রে পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবন মানোন্নয়নের জন্য সরকার কাজ করছে।’</p> <p>গতকাল বাংলাদেশ সচিবালয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নিজ অফিসকক্ষে ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মিজ হেলেন লাফাভের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলাপকালে উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।</p> <p> </p> <p> </p>